Ad T1

সুন্দরবনে ‘বাঘের বাড়ি’ শেখেরটেক

এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১৪: ১১
সুন্দরবনে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের নতুন গন্তব্য ‘শেখেরটেক’। এখানে বাঘের আনাগোনা সর্বাধিক। পর্যটকরা প্রায়ই দেখা পান বাঘের। গা ছমছম করা এই অনুভূতি নিতে তাই অনেকেই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসছেন ‘বাঘের বাড়ি’ খ্যাত এই এলাকায়। এ ছাড়া এখানে রয়েছে মোগল আমলে নির্মিত বেশকিছু স্থাপনার ভগ্নাবশেষ।
ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, শেখের খাল আর কালীর খালের মধ্যবর্তী উঁচু জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটি সুন্দরবনের ১৩৩ নম্বর লটে শেখেরটেক। এখানে বনের মধ্যে যে স্থাপত্যগুলোর ভগ্নাবশেষ দেখা যায়, সেগুলো মোগল আমলের স্থাপত্য। যশোর রাজ প্রতাপাদিত্য তার সময়ে এখানে শিবসা দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন, যেটাকে বাওয়ালিরা বড় বাড়ি বলে। এর আশপাশে আরো প্রাচীন ইটের বাড়ির ভগ্নাবশেষের স্তূপ আর প্রচুর গাবগাছ রয়েছে। এখানে রয়েছে একটি মন্দির। আশপাশের জায়গা থেকে মন্দির আর প্রাচীন বসতবাড়ির ঢিবিগুলো একটু উঁচু। ফলে জোয়ারের সময় এখানে বাঘ আশ্রয় নেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক এম এ আজিজের লেখা ‘সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ইতিহাস’ বইয়েও ওই স্থাপনাগুলোর কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, সম্ভবত ১৫৯৭ সালে সুন্দরবন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন বারোভূঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য। সুন্দরবনের শিবসা নদীর পাড়ে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। শিবসা নদীসংলগ্ন মন্দির এলাকা ওই দুর্গের অধীন ছিল।
ইকোট্যুরিজমের সূচনা
ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় শেখেরটেক দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বন বিভাগের অর্থায়নে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সম্প্রতি মন্দিরের সংস্কারকাজ শেষ করেছে।
শেখেরটেক খাল থেকে মন্দিরের চারপাশ দিয়ে পাকা পথ তৈরি করা হয়েছে। বনের ভেতর দিয়ে ঘুরে আসার জন্য তৈরি হয়েছে কংক্রিটের ফুট ট্রেইল। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে এক থেকে দেড় কিলোমিটারের দীর্ঘ পাকা পথ ধরে বনের মধ্যে অনায়াসে হেঁটে হেঁটে দেখা যায় সুন্দরবনের সৌন্দর্য। পাখির চোখে সুন্দরবনকে দেখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ৫০ ফুট উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশ্রামঘর। পাশেই রয়েছে পুকুর। পুকুরের চারপাশের মাটিতে শত শত হরিণ আর বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ নজরে পড়বে।
মন্দিরটির সংস্কারকাজে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা গ্রামের বাপ্পি সরদার। তিনি বলেন, ‘এখানে বাঘের আনাগোনা বেশি। আমি ১৫-২০ হাত দূর থেকে বাঘ দেখেছি। আমার সঙ্গে আরেকজন ছিল। আমরা মন্দিরের কাজ শেষে ফেরার সময় দেখি পাকা পথের ওপর বসে আছে বাঘ। তখন আমাদের সঙ্গে থাকা বাজি ফুটিয়ে বাঘটি তাড়িয়েছিলাম।’
পর্যটকের ভিড়
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শাকবাড়িয়া নদী। নদীর তীরে কাটকাটা বাজার আর লঞ্চঘাট। নদীর এপারে জনপদ আর ওপারে সুন্দরবন। শেখেরটেকে যেতে হলে এখান থেকেই নৌযান ভাড়া নিতে হবে। বনে প্রবেশের পাসও নিতে হবে কাশিরাবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে। ঈদের দিন সকাল থেকে গভীর রাত অবধি সম্পূর্ণ এলাকা ছিল হাজার হাজার মানুষের পদভারে মুখরিত। ঈদের তৃতীয় দিনও এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। পর্যটকদের জন্য বেশ কয়েকটি ট্রলার ও জালি বোট ছিল নদীতে। নির্মিত হয়েছে মিনি রেস্টুরেন্ট-কফিশপ।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন জানালেন, পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তারা স্বল্প খরচে শেখেরটেক যাওয়ার ট্যুর প্যাকেজ করেছেন। অনেকেই সাড়া দিয়েছেন। তবে এখানে ভালোমানের আবাসিক হোটেল নেই। অভয়ারণ্যে প্রবেশের পাস মাথাপিছু ১৫০ টাকা, নৌযানের কর দেড় হাজার টাকা। দুজন ফরেস্ট গার্ড নিতে হয়, যার খরচ এক হাজার টাকা। এর সঙ্গে ২৫ শতাংশ ভ্যাট। সব মিলিয়ে খরচের পরিমাণ কম নয়। এসব সমস্যা দূর করা গেলে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এজেডএম হাসানুর রহমান বলেন, শেখেরটেক যাওয়ার জন্য কালাবগি, নলিয়ান ও কাশিরাবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে পাস দেওয়া হচ্ছে। তবে এখনো সবাইকে সেখানে যাওয়ার জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ করি না। বাঘের উপদ্রবে নিরাপত্তার অভাবে সেখানে আমাদের স্থায়ী জনবল নেই। তা ছাড়া শীতকাল ছাড়া অন্য মৌসুমে নদী উত্তাল থাকে। নিকটবর্তী আদাচাই স্টেশন থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চেষ্টা করা হচ্ছে একটি স্থায়ী ক্যাম্প করার। সেটা সম্ভব হলে পর্যটকরা নির্বিঘ্নে যেতে পারবেন।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত