এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজকল খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলের পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ও মালামাল পানির দরে কিনে নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ১০ হাজার টাকা দরে ১৭টি শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়ে মাত্র একটি। পতিত হাসিনার তিন চাচাতো ভাইকে ৫০ কোটি টাকা ঘুস দিয়ে কাজটি বাগিয়ে নেয় বিতর্কিত ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মালামাল বিক্রির কাজ শুরু করলে মিলের সাবেক শ্রমিক, স্থানীয় জনসাধারণ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েন তারা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সব পক্ষকে নিষ্ক্রিয় করে এবং কাউকে কাউকে হাত করে দ্রুততার সঙ্গে মালামাল সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পরিচালিত এই মিল চত্বর খালি করা শেষ হলেই প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বড় ধরনের মুনাফা হাঁকানোর প্রত্যাশায় প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের গেওয়া কাঠের ওপর ভিত্তি করে ১৯৫৭ সালে খালিশপুরে ভৈরব নদের তীরে ৮৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় নিউজপ্রিন্ট মিল। ১৯৫৯ সালে মিলের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়, তখন মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৮ হাজার টন। দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা রাখা মিলটি চার দশকেরও বেশি সময় লাভজনক ছিল; কিন্তু ১৯৯২ সাল থেকে লোকসানে পতিত হয়। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে নিউজপ্রিন্টের ওপর ৭৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পর অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি শুরু করেন। এতে মিলে উৎপাদিত কাগজের চাহিদা কমে যায়। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা হলে বনজ সম্পদ আহরণ বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচামাল সংকটে ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
অস্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়া, কাজ পান বিতর্কিত ঠিকাদার
২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের অভ্যন্তরে অবস্থিত মেশিনারিজ ও পুরোনো স্থাপনা বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। বিক্রির তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মেশিন, বয়লার, শত শত টন লোহা-লক্কর, ওভারব্রিজের যন্ত্রাংশ, বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ব্যবহৃত ভারী তামার তার প্রভৃতি। টেন্ডার ওপেন করা হয় ১ নভেম্বর। সে সময় ১৭টি দরপত্র বিক্রি হলেও জমা পড়ে মাত্র একটি। দরপত্র জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মিল কর্তৃপক্ষ। মিলের বিপুল পরিমাণ মালামালের জন্য প্রতিষ্ঠানটি দর দিয়েছে মাত্র ৬৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। মিলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে নিউজপ্রিন্ট মিল অভ্যন্তরে। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইদের যোগসাজশে অর্ধশত কোটি টাকা লেনদেনের বিনিময়ে পানির দরে তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত শেখবাড়ির হস্তক্ষেপের কারণেই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দিতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা কারণে বিতর্কিত ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড। তাদের হেড অফিস ঢাকার কারওয়ান বাজার টিসিবি ভবনে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়া। তিন দশক আগে তিনি একজন ছোটখাটো ঠিকাদার হিসেবে জীবন শুরু করেন। শুরুতে কুষ্টিয়া বিএনপি মনোনীত একজন এমপির সঙ্গে পার্টনারশিপে কাজ করতেন।
মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করত তার প্রতিষ্ঠান। পরে অবকাঠামো খাত, বিদ্যুৎ ও পাট সেক্টরে বিনিয়োগ করেন তিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মাহবুব-উল আলম হানিফের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় বশিরের। এরপর থেকেই মূলত ঠিকাদারিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডে একচেটিয়া দাপট ছিল ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। অত্যন্ত নিম্নমানের এসব কাজ শেষ হওয়ার আগেই অনেক স্থানে বাঁধ ধসে পড়ার ঘটনা ঘটলেও কখনোই শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। বরং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ এলেই তা একরকম অবধারিতভাবেই সেটি চলে যায় বশির আহমেদের কব্জায়।
২০২২ সালের আগস্টে ৪৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এমডি বশির আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
মিলে হরিলুট বন্ধের দাবিতে নানা তৎপরতা
২০২৩ সালে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মালামাল অপসারণ শুরু হয়। শুরুতেই এ কাজ ছাত্র-জনতার তীব্র বাধার মুখে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি মিল থেকে ট্রাকভর্তি স্ক্র্যাপ বের হওয়ার সময় শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষ তা আটকে দেয়। চরম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যৌথবাহিনী ঘটনাস্থলে যায়। পরে বাহিনীর কাছে অভিযোগ তুলে ধরেন এলাকাবাসী। নিউজপ্রিন্ট মিলের চাকরিচ্যুত শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. বারেক হাওলাদার বলেন, মিলে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ আছে, যা ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংকে মাত্র ৬৮ কোটি টাকায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার সরকারের ফান্ডে টাকা জমা না দিয়ে যা তাদের কব্জায় নেওয়ার কথা নয়, সেসব মালামালও তারা নিয়ে যাচ্ছে। এই লুটপাটে ঠিকাদারকে সহায়তা করেছেন বিসিআইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সংগ্রাম পরিষদের অভিযোগ, কাজটি পেতে ঠিকাদার ২০২৩ সালে শেখ হাসিনার তিন চাচাতো ভাই শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলকে ৫০ কোটি টাকা দেন। এর মধ্যে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকে ১০ কোটি টাকা, শিল্প সচিবকে ৫ কোটি ও মিলের এমডি আবু সাঈদকে এক কোটি টাকা দেওয়া হয়।
সাব-কন্ট্রাক্টরদের পোয়াবারো, পাচার হয়েছে বিস্ফোরক
ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হয়ে মালামাল সরবরাহের কাজ করছেন মূলত চারজন। মো. রাকিব হাসান, আনিসুর রহমান রিপন, রিপনের সহযোগী শাওন ও শামীম আরা নীলা। স্ক্র্যাপ বিক্রির জন্য বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ, লেনদেন ও সরবরাহের বিষয়টি সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও নগদ টাকার অবাধ প্রবাহের কারণে এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন আসছে ব্যবসায়ীদের নানা গ্রুপ। লেনদেন ও কেনাবেচা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অর্থ আত্মসাৎ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মারপিট নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিসিআইসি ঘোষিত নিলামযোগ্য মালামালের পাশাপাশি পাচার হয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের বিস্ফোরক ও দাহ্য কেমিক্যাল। যদিও মিলের এমডি আবু সাঈদ বলছেন, গোডাউনে কোনো ধরনের বিস্ফোরক পদার্থ নেই।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র অনুযায়ী, মিলের ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর গোডাউনে অন্তত ৮০ টন সালফার (গন্ধক) মজুত ছিল। ছিল আরো বেশ কিছু তরল কেমিক্যাল। গন্ধক আগরবাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হলেও ককটেল ও বোমা তৈরির অন্যতম কাঁচামাল এটি। মালামাল সরবরাহের সঙ্গে জড়িতরা সবাই সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদের একজন কুখ্যাত ‘ইয়াবাসম্রাট বদির’ সঙ্গে ব্যবসা করতেন এবং সীমানা পিলার কেনাবেচাসহ প্রতারণা-জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অপর একজন নিজেকে পলাতক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ভাগ্নি পরিচয় দিয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তারাই এখন নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রির আড়ালে স্পর্শকাতর কেমিক্যাল বিক্রি করেছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রমতে, গন্ধকের কয়েকটি চালানের মধ্যে অন্তত দুটি চালানের একটি নারায়ণগঞ্জের পারাগাঁও, অন্যটি ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে গেছে। তবে এই চালানগুলো সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছেন ঠিকাদার।
জানতে চাইলে শামীম আরা নীলা বলেন, গোডাউনে অল্প কিছু গন্ধক ছিল। ২০ বছর ধরে পড়ে থাকায় বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর কোনো কার্যকারিতা নেই। আমরা তা বিক্রি করেছি, যা আগরবাতি বানানোর কাজে ব্যবহার হবে।
ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের বক্তব্য
মিলের সম্পদ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথা বলা হচ্ছে দাবি করেন ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি সবকিছু একসঙ্গে ১১৫ কোটি টাকায় বিক্রি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সর্বোচ্চ দর উঠেছে ১১০ কোটি টাকা। আমাদের কাজ শুরু করতে অনেক দেরি হয়েছে। অনেক বাধা ছিল, বৈষম্যবিরোধীরা বাধা দিয়েছে। নানা অভিযোগের কারণে এ পর্যন্ত ৫টি তদন্ত কমিটি হয়েছে, সবগুলোর প্রতিবেদন আমার পক্ষে। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই।’
টাকা দিয়ে শেখবাড়িকে ম্যানেজ করা প্রসঙ্গে বশির আহমেদ বলেন, ‘যা বলা হচ্ছে, বিষয়টি সেরকম নয়। ভিন্ন মাধ্যমে তারা হয়তো কিছু টাকা নিয়েছে। আমার কাছ থেকে সরাসরি নেয়নি।’
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজকল খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলের পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ও মালামাল পানির দরে কিনে নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ১০ হাজার টাকা দরে ১৭টি শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়ে মাত্র একটি। পতিত হাসিনার তিন চাচাতো ভাইকে ৫০ কোটি টাকা ঘুস দিয়ে কাজটি বাগিয়ে নেয় বিতর্কিত ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মালামাল বিক্রির কাজ শুরু করলে মিলের সাবেক শ্রমিক, স্থানীয় জনসাধারণ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েন তারা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সব পক্ষকে নিষ্ক্রিয় করে এবং কাউকে কাউকে হাত করে দ্রুততার সঙ্গে মালামাল সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পরিচালিত এই মিল চত্বর খালি করা শেষ হলেই প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বড় ধরনের মুনাফা হাঁকানোর প্রত্যাশায় প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের গেওয়া কাঠের ওপর ভিত্তি করে ১৯৫৭ সালে খালিশপুরে ভৈরব নদের তীরে ৮৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় নিউজপ্রিন্ট মিল। ১৯৫৯ সালে মিলের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়, তখন মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৮ হাজার টন। দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা রাখা মিলটি চার দশকেরও বেশি সময় লাভজনক ছিল; কিন্তু ১৯৯২ সাল থেকে লোকসানে পতিত হয়। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে নিউজপ্রিন্টের ওপর ৭৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পর অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি শুরু করেন। এতে মিলে উৎপাদিত কাগজের চাহিদা কমে যায়। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা হলে বনজ সম্পদ আহরণ বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচামাল সংকটে ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
অস্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়া, কাজ পান বিতর্কিত ঠিকাদার
২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের অভ্যন্তরে অবস্থিত মেশিনারিজ ও পুরোনো স্থাপনা বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। বিক্রির তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মেশিন, বয়লার, শত শত টন লোহা-লক্কর, ওভারব্রিজের যন্ত্রাংশ, বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য ব্যবহৃত ভারী তামার তার প্রভৃতি। টেন্ডার ওপেন করা হয় ১ নভেম্বর। সে সময় ১৭টি দরপত্র বিক্রি হলেও জমা পড়ে মাত্র একটি। দরপত্র জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মিল কর্তৃপক্ষ। মিলের বিপুল পরিমাণ মালামালের জন্য প্রতিষ্ঠানটি দর দিয়েছে মাত্র ৬৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। মিলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে নিউজপ্রিন্ট মিল অভ্যন্তরে। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইদের যোগসাজশে অর্ধশত কোটি টাকা লেনদেনের বিনিময়ে পানির দরে তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত শেখবাড়ির হস্তক্ষেপের কারণেই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দিতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা কারণে বিতর্কিত ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড। তাদের হেড অফিস ঢাকার কারওয়ান বাজার টিসিবি ভবনে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়া। তিন দশক আগে তিনি একজন ছোটখাটো ঠিকাদার হিসেবে জীবন শুরু করেন। শুরুতে কুষ্টিয়া বিএনপি মনোনীত একজন এমপির সঙ্গে পার্টনারশিপে কাজ করতেন।
মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করত তার প্রতিষ্ঠান। পরে অবকাঠামো খাত, বিদ্যুৎ ও পাট সেক্টরে বিনিয়োগ করেন তিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মাহবুব-উল আলম হানিফের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় বশিরের। এরপর থেকেই মূলত ঠিকাদারিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডে একচেটিয়া দাপট ছিল ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। অত্যন্ত নিম্নমানের এসব কাজ শেষ হওয়ার আগেই অনেক স্থানে বাঁধ ধসে পড়ার ঘটনা ঘটলেও কখনোই শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। বরং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ এলেই তা একরকম অবধারিতভাবেই সেটি চলে যায় বশির আহমেদের কব্জায়।
২০২২ সালের আগস্টে ৪৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এমডি বশির আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
মিলে হরিলুট বন্ধের দাবিতে নানা তৎপরতা
২০২৩ সালে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মালামাল অপসারণ শুরু হয়। শুরুতেই এ কাজ ছাত্র-জনতার তীব্র বাধার মুখে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি মিল থেকে ট্রাকভর্তি স্ক্র্যাপ বের হওয়ার সময় শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষ তা আটকে দেয়। চরম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যৌথবাহিনী ঘটনাস্থলে যায়। পরে বাহিনীর কাছে অভিযোগ তুলে ধরেন এলাকাবাসী। নিউজপ্রিন্ট মিলের চাকরিচ্যুত শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. বারেক হাওলাদার বলেন, মিলে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ আছে, যা ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংকে মাত্র ৬৮ কোটি টাকায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার সরকারের ফান্ডে টাকা জমা না দিয়ে যা তাদের কব্জায় নেওয়ার কথা নয়, সেসব মালামালও তারা নিয়ে যাচ্ছে। এই লুটপাটে ঠিকাদারকে সহায়তা করেছেন বিসিআইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সংগ্রাম পরিষদের অভিযোগ, কাজটি পেতে ঠিকাদার ২০২৩ সালে শেখ হাসিনার তিন চাচাতো ভাই শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলকে ৫০ কোটি টাকা দেন। এর মধ্যে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকে ১০ কোটি টাকা, শিল্প সচিবকে ৫ কোটি ও মিলের এমডি আবু সাঈদকে এক কোটি টাকা দেওয়া হয়।
সাব-কন্ট্রাক্টরদের পোয়াবারো, পাচার হয়েছে বিস্ফোরক
ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হয়ে মালামাল সরবরাহের কাজ করছেন মূলত চারজন। মো. রাকিব হাসান, আনিসুর রহমান রিপন, রিপনের সহযোগী শাওন ও শামীম আরা নীলা। স্ক্র্যাপ বিক্রির জন্য বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ, লেনদেন ও সরবরাহের বিষয়টি সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও নগদ টাকার অবাধ প্রবাহের কারণে এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন আসছে ব্যবসায়ীদের নানা গ্রুপ। লেনদেন ও কেনাবেচা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অর্থ আত্মসাৎ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মারপিট নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিসিআইসি ঘোষিত নিলামযোগ্য মালামালের পাশাপাশি পাচার হয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের বিস্ফোরক ও দাহ্য কেমিক্যাল। যদিও মিলের এমডি আবু সাঈদ বলছেন, গোডাউনে কোনো ধরনের বিস্ফোরক পদার্থ নেই।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র অনুযায়ী, মিলের ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর গোডাউনে অন্তত ৮০ টন সালফার (গন্ধক) মজুত ছিল। ছিল আরো বেশ কিছু তরল কেমিক্যাল। গন্ধক আগরবাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হলেও ককটেল ও বোমা তৈরির অন্যতম কাঁচামাল এটি। মালামাল সরবরাহের সঙ্গে জড়িতরা সবাই সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদের একজন কুখ্যাত ‘ইয়াবাসম্রাট বদির’ সঙ্গে ব্যবসা করতেন এবং সীমানা পিলার কেনাবেচাসহ প্রতারণা-জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অপর একজন নিজেকে পলাতক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ভাগ্নি পরিচয় দিয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তারাই এখন নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রির আড়ালে স্পর্শকাতর কেমিক্যাল বিক্রি করেছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রমতে, গন্ধকের কয়েকটি চালানের মধ্যে অন্তত দুটি চালানের একটি নারায়ণগঞ্জের পারাগাঁও, অন্যটি ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে গেছে। তবে এই চালানগুলো সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছেন ঠিকাদার।
জানতে চাইলে শামীম আরা নীলা বলেন, গোডাউনে অল্প কিছু গন্ধক ছিল। ২০ বছর ধরে পড়ে থাকায় বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর কোনো কার্যকারিতা নেই। আমরা তা বিক্রি করেছি, যা আগরবাতি বানানোর কাজে ব্যবহার হবে।
ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের বক্তব্য
মিলের সম্পদ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথা বলা হচ্ছে দাবি করেন ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি সবকিছু একসঙ্গে ১১৫ কোটি টাকায় বিক্রি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সর্বোচ্চ দর উঠেছে ১১০ কোটি টাকা। আমাদের কাজ শুরু করতে অনেক দেরি হয়েছে। অনেক বাধা ছিল, বৈষম্যবিরোধীরা বাধা দিয়েছে। নানা অভিযোগের কারণে এ পর্যন্ত ৫টি তদন্ত কমিটি হয়েছে, সবগুলোর প্রতিবেদন আমার পক্ষে। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই।’
টাকা দিয়ে শেখবাড়িকে ম্যানেজ করা প্রসঙ্গে বশির আহমেদ বলেন, ‘যা বলা হচ্ছে, বিষয়টি সেরকম নয়। ভিন্ন মাধ্যমে তারা হয়তো কিছু টাকা নিয়েছে। আমার কাছ থেকে সরাসরি নেয়নি।’
কুমিল্লায় ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের হামলায় সময় টিভির কুমিল্লা প্রতিনিধি বাহার রায়হান আহত হয়েছেন। গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় নগরীর কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে এ ঘটনা ঘটে।
৪৪ মিনিট আগেপঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ৩৩ কেজি ৫০০ গ্ৰাম ওজনের কষ্টিপাথরের বিষ্ণুমূর্তিসহ আবু বক্কর ছিদ্দিক নামে এক যুবককে আটক করেছে র্যাব।
১ ঘণ্টা আগেবদরগঞ্জ থানার পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধারের বিষয় নিশ্চিত করেছেন। প্রাথমিকভাবে তাদের অপমৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।
২ ঘণ্টা আগেভারতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত পাঁচ রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে পুশ-ইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা। আটক ব্যক্তিরা একই পরিবারের সদস্য এবং ভারতের আসামের মাটিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন।
১১ ঘণ্টা আগে