Ad T1

এনবিআর ভেঙে দুই বিভাগ

খসড়া অধ্যাদেশ বাতিলেই কি সমাধান

কাওসার আলম
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ০৯: ১৭
আপডেট : ০৮ মে ২০২৫, ০৯: ৩৪

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুই বিভাগ গঠনের খসড়া অধ্যাদেশে প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে সচিবসহ অন্যান্য পদে জনবল নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। এতে রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি ও হতাশা তৈরি হয়েছে।

এ কারণে খসড়া অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি তুলেছেন বিসিএস কর এবং কাস্টমস ও শুল্ক কর্মকতারা। খসড়া অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়ে মূলত এনবিআরের বিদ্যমান কাঠামো বহাল রাখার পক্ষেই তারা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। কিন্তু খসড়া অধ্যাদেশ বাতিল করে বিদ্যমান কাঠামোকে বহাল রেখে এনবিআরের সংস্কার কার্যক্রম এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে কিংবা খসড়া অধ্যাদেশ বাতিল হলেই কি বিদ্যমান সমস্যার সামধান হবে- এমন প্রশ্ন উঠেছে।

তবে রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সংস্কারের বিপক্ষে নন। কিন্তু সংস্কারের নামে যদি এমন কিছু হয়, যাতে জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, তাহলে আমার তা মানতে পারি না। এমনকি যে সংস্কার কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এনবিআরকে দুটি বিভাগে পরিণত করা হচ্ছে, ওই কমিটির সুপারিশকেই যদি আমলে নেওয়া না হয় তাহলে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলো কীভাবে?

সংস্কার কমিটি ও এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে যে সুপারিশ করেছি, তার প্রতিফলন খসড়া অধ্যাদেশে দেখতে পাচ্ছি না। এর ফলে যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এনবিআরকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে, তা অর্জিত হবে না; বরং এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।’

দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী রাজস্ব আদায়ে গতি ফেরানো এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একই সংস্থার অধীন হওয়ায় ‘স্বার্থ সংঘাত’ এড়াতে এনবিআরকে ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন নামে দুটি আলাদা বিভাগ গঠনের দাবি জানিয়ে আসছিল। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে দুটি বিভাগ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটি আর এগোয়নি।

তবে জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে এনবিআর সংস্কারে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। পরামর্শক কমিটি তাদের সংস্কার প্রস্তাবে এনবিআরকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন নামে দুটি আলাদা বিভাগ গঠনের সুপারিশ করে। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে বিভাগ দুটি গঠনে একটি খসড়া অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।

আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং (কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার প্রক্রিয়া) শেষে এটি গেজেট আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু খসড়া অধ্যাদেশে বিভাগ দুটির সর্বোচ্চ পদে রাজস্ব ক্যাডার ছাড়াও প্রশাসন ক্যাডার থেকে এবং এর আওতায় যেসব অনুবিভাগ হবে সেগুলোর বিভিন্ন পদেও প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগের বিধান থাকায় তা নিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

ইতোমধ্যে বিসিএস (কর এবং ভ্যাট ও কাস্টমস) অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের উদ্বেগ-হতাশার কথা জানিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা আপাতত খসড়া অধ্যাদেশের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং স্থগিত রেখেছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ৫৮তম সাধারণ সভায় অংশ নিতে বর্তমানে ইতালি সফরে রয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। আগামী ৯ মে তিনি দেশে ফিরবেন। দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন।

এদিকে কর এবং শুল্ক-ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১০ জনের কমিটিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমানকে আহবায়ক ও বরিশালে কর্মরত কর কমিশনার মো. শব্বির আহমেদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কিন্তু খসড়া অধ্যাদেশ স্থগিতে অর্থ উপদেষ্টার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয় কমিটি তাদের কার্যক্রম বিলুপ্ত করেছে।

সমন্বয় কমিটির আহবায়ক সৈয়দ মুশফিকুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘সমন্বয় কমিটি থেকে আমি ও সদস্য সচিবসহ প্রায় সবাই পদত্যাগ করেছেন। যেহেতু খসড়া অধ্যাদেশ আপাতত স্থগিত রয়েছে, এখন দুই অ্যাসোসিয়েশনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে খসড়ায় যেসব পরিবর্তন বা সংশোধন প্রয়োজন হবে সে বিষয়ে কাজ করবে। এতে প্রয়োজনবোধে অর্থনীতিবিদ, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে।

এদিকে খসড়া অধ্যাদেশ বাতিল ও বর্তমান ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে একটি গ্রুপ নানাভাবে এনবিআরে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিভাগ তৈরি নিয়ে খসড়ার কিছু বিষয়ে আপত্তি ওঠার যথেষ্ঠ যৌক্তিকতা রয়েছে। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী এক ধরনের অস্থিরতা তৈরির পাঁয়তারা করছে। নানাভাবে পরিস্থিতিকে উসকে দিয়ে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ব্যাঘাত তৈরি করে একটি সংকট তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদের মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পাশাপাশি যেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান এবং চাকরির সময়সীমা ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, তারা নানাভাবে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। কর্মবিরতি পালন কিংবা এনবিআর ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে তরুণ কর্মকর্তাদের তারা নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন বলে বেশ কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, খসড়া অধ্যাদেশের বেশকিছু ধারা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরাজমান ক্ষোভকে কাজে লাগাতে তৎপরতা থাকলেও এখন পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। তবে খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে সংকট বাড়বে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিসিএস (কর) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতাসিম বিল্লাহ ফারুকির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সৈয়দ মহিদুল হাসান বলেন, ‘আমি কয়েকদিন ধরেই একটি প্রশিক্ষণে ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে আমি এখন কিছু বলতে পারব না।

খসড়া বাতিলের দাবি ও সংকট

খসড়া বাতিল হলে বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) অধীন একটি সংস্থা হিসেবেই কাজ করবে এনবিআর। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ প্রশাসন ক্যাডারের জনবল দ্বারা পরিচালিত। এতে এনবিআরকে তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কিংবা যেকোনো একটি সরকারি আদেশের (জিও) জন্য একটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখে পড়তে হয়। এ ছাড়া বর্তমানে এনবিআরে বোর্ড প্রশাসন নামে একটি শাখা রয়েছে এবং এ শাখায় প্রথম সচিব ও সদস্য অ্যাডমিন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা হয়।

অন্যদিকে ট্যাক্স ও কাস্টমস প্রশাসনের প্রথম সচিব ও দ্বিতীয় সচিবের পদটিও প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার বিদ্যমান কাঠামোয় প্রশাসন ক্যাডার থেকেই (দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) এনবিআর চেয়ারম্যান নিয়োগ পান। ফলে একদিকে আইআরডির কর্তৃত্ব, অন্যদিকে খোদ এনবিআরে প্রশাসন ক্যাডারের জনবল- সব মিলিয়ে বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো একটি প্রশাসন ক্যাডারনির্ভর ব্যবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় এনবিআরকে বিলুপ্ত করে আলাদা দুটি বিভাগ গঠন করা হলে তখন আইআরডির কর্তৃত্ব থেকে এনবিআর মুক্ত হবে এবং নিজস্ব একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হলে সরকারের রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা তৈরি হবে বলে মনে করা হয়।

খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন লাভের পরই সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা প্রয়োজন। তবে এ নিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে যদি তাদের আশ্বাস দেওয়া হয় তাহলে বিভাগ গঠনে তাদের আপত্তি থাকবে না। অন্যদিকে অধ্যাদেশ জারির আগে খসড়ার যেসব বিধান নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে বঞ্চনা কিংবা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেগুলো আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান হওয়া উচিত বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।

বিষয়:

এনবিআর
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত