আবদুল হাই শিকদার
এক
আমাদের কবিতা মাত্র একবার বিশ্ব জয় করেছিল ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ভেতর দিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং সৃজনশীলতাকে আমূল বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের যেসব জনপদ তার অন্যতম নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার পতিসর। শুধুই কি পতিসর? আত্রাই, নাগোর, রাতোয়াল, কামতা- কোথায় নেই রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্র জীবনীকারদের চোখে ব্রাত্য হলেও, বহুদিন আলোকের বাইরে থাকলেও, সেদিন পতিসর হয়ে উঠেছিল তার সন্ধ্যার মেঘমালা। পতিসরই হয়ে উঠেছিল তার অনেক সাধের সাধনা।
বাংলাদেশের যে অখ্যাত গ্রমাগুলো ভঙ্গুর মৃৎপাত্র হাতে রবীন্দ্রনাথের জন্য অমৃত নিয়ে অপেক্ষা করেছিল, যে জনপদ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি হওয়ার জন্য খুলে দিয়েছিল ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্যের অনির্বচনীয় সিংহ দরজা, যে জনপদে পদার্পণের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার ঘটেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যে জনপদে এসে জনমানুষের সঙ্গে মিশে জমিদার রবীন্দ্রনাথ সত্যিকারার্থে হয়ে উঠেছিলেন ভিন্ন রবীন্দ্রনাথ-সেই জনপদের নাম পতিসর।
পতিসরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংযোগ সাধিত হয় ১৮৯১ সালের ১৫ জানুয়ারি। পিতার নির্দেশে তিনি সেবার জমিদারি দেখাশোনার জন্য এসেছিলেন পতিসর। এরপর থেকে টানা ৪৬ বছর পর্যন্ত চলে পতিসরে আসা-যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে শেষবারের মতো এসেছিলেন ১৯৩৭ সালে। চলনবিল, আত্রাই, নাগোর বিধৌত শ্যামল-কোমল সবুজ নিস্তরঙ্গ পতিসরের প্রতিটি পরতে পরতে আজও লেগে আছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি।
সেই পতিসর দীর্ঘদিন ছিল আমাদের সবার মনোযোগের বাইরে। এই পতিসরে এসেই রবীন্দ্রনাথ গণমানুষের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন আত্মিক সচ্ছলতা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব কৃষক-প্রজা, কামার, কুমার, জেলে, মাঝির অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে না পারলে, অশিক্ষার অন্ধকার থেকে তাদের উদ্ধার করা না গেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেজন্যই তিনি প্রথমবারের মতো গ্রাম উন্নয়নের জন্য শুরু করেন এক কর্মযজ্ঞ। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, গণমুখী শিক্ষা, সমবায়, তাঁত শিল্প, রেশম শিল্প, কৃষি ব্যাংক স্থাপন, কৃষিঋণ বিতরণ, আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রবর্তন, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় গ্রামীণ বিচারের ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি ছিল তার মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তিনি এখানে ১৯০০ সালে গড়ে তোলেন কালিগ্রাম হিতৈষী সংঘ। প্রতিষ্ঠা করেন দাতব্য চিকিৎসালয়, বয়স্ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেশম শিল্প এবং আরো অনেক কিছু। তার এ উদ্দেশ্যকে সফল করতে এখন থেকে ১০০ বছর আগে ১৯০৫ সালে তিনি পতিসরে প্রতিষ্ঠা করেন কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়বুদ্ধিও হয়তো ছিল। রবীন্দ্রনাথ পতিসরকে, পতিসরের মানুষকে, পতিসরের প্রকৃতিকে ভালোবেসেছিলেন। পতিসরের মানুষও সর্বদা কবিকে জানিয়েছে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, যার রেশ আজও বহমান।
দুই
পতিসরের কিনারঘেঁষে বয়ে গেছে ছোট নদী নাগোর। এই নাগোর নদীর উত্তর পাড়ে রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ির অবস্থান। মাঝখানে খোলা চত্বর। এখানে প্রতি বছর স্থানীয় এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠানমালা। কাছারিবাড়ির ভেতরে প্রবেশপথের দুপাশে একটি করে ফলক উন্মোচিত হয়েছে। ডানের ফলকে লেখা রয়েছে পতিসরে রবীন্দ্র রচনাবলীর তালিকা, ২০০৪ সালে ফলকটি বসানো হয়। বাম পাশের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যু তারিখ, কবির পতিসরে আসার সময়, শেষ আগমনের তারিখ এবং পতিসরে কবির রচিত হতভাগ্যের গানের শেষাংশ। এ দুটি ফলকে অর্থায়ন করেছে উপজেলা পরিষদ, আত্রাই এবং বাস্তবায়ন করেছে মনিয়ার ইউনিয়ন পরিষদ। সিংহ দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই একটি খোলা চত্বর। এখানেই বসত জমজমাট অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ বসতেন ইজিচেয়ারে একবারে উত্তর প্রান্তে উঁচু বারান্দার মাঝখানে। ডান পাশের কক্ষগুলোতে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নামে জাদুঘর। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন স্মৃতি দিয়ে দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছে। এ জাদুঘরে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত যেসব জিনিস সংরক্ষিত রয়েছে, তার মধ্যে একটি আছে ইজিচেয়ার, মোজাইক করা ইট-পাথরে নির্মিত রবীন্দ্রনাথের বাথটাব। এ বাথটাব রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করতেন। বাথটাবের পাশেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বোটের সেই নোঙর। জাদুঘরের মেঝেতে সংরক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত একটি সিন্দুক। মূল্যবান দলিলপত্র অথবা অর্থ রাখার জন্য এটিকে তিনি ব্যবহার করতেন। সিন্দুকের ভেতরে ১৯৫১ সালের কিছু সরকারি দলিল রয়েছে। হয়তো জমিদারি সংক্রান্ত এবং বিভিন্ন জমির দাগ নম্বরসংবলিত কিছু কাগজপত্র রয়েছে। আর তেমন কিছু নেই। জাদুঘরের মেঝেতে সংরক্ষিত আছে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক সেই ট্রাক্টরের একটি ফলা। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চাষাবাদ প্রবর্তনের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তারই একটি স্মারক এ ট্রাক্টরের ফলাটি। পতিসরে প্রথম ট্রাক্টরটি চালিয়েছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে। উত্তরের কক্ষটি কাছারিবাড়ির সবচেয়ে বড় কক্ষ। এখন এটাকে হলরুম বলা হয়। ধারণা করা হয়, এ কক্ষেই রবীন্দ্রনাথের জন্য রচিত হতো রাতযাপনের শয্যা। পতিসরের নিবিড়, নির্জন, স্তব্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বিশ্বকবি হয়তো কখনো কখনো উঠে যেতেন কাছারিবাড়ির ছাদে। এই কাছারিবাড়ির ছাদে বসেই কবি নিঝুম দুপুরে অথবা অলস অপরাহ্নে রচনা করেছিলেন মধ্যাহ্ন, দুর্লভ জন্ম কিংবা সন্ধ্যার মতো
কবিতা :
যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীয় লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।
যা পাইনি তাও থাক যা পেয়েছি তাও,
তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও।
[দুর্লভ জন্ম]
কাছারিবাড়ির উত্তর পাশে রয়েছে নামেই একটা ছাত্রাবাস। এটা এখন পরিত্যক্ত। তবে ধারণা করা হয়, এ ছাত্রাবাসেই কাছারিবাড়িতে কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা থাকতেন। দেয়াল দিয়ে ঘেরা এ কাছারিবাড়ির দক্ষিণের খোলা মাঠের পরই নাগোর নদী। কাছারিবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত রবি-সরোবর। কাছারিবাড়ির পশ্চিমে কিছুটা খোলা জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পতিসর ডাকবাংলো। পতিসরে এসে যারা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ভুবনের ভেতরে প্রবেশ করতে চান, তারা এখানে দিব্যি রাত কাটাতে পারবেন। পতিসর কাছারিবাড়ি থেকে নাগোরের তীরঘেঁষে পূর্বদিকে কিছুটা এগোলে সেই বিখ্যাত মণিতলা। এ মণিতলাতে অনেক তালগাছ গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এ তালগাছগুলো বিশ্বকবিকে আলোড়িত করেছিল। তারই প্রকাশ ঘটে ‘তালগাছ’ লেখাটিতে :
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে,
মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায়-
কোথা পাবে পাখা সে-
সেই তালগাছগুলো এখন আর এখানে নেই। পতিসরে শিক্ষা বিস্তারের জন্য রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার একটি এই কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট। শেষবার যখন রবীন্দ্রনাথ পতিসরে আসেন, তখন তার পুত্রের নামে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। পতিসরে কাছারিবাড়ির কাছে আছে একটি ছোট বাজার। এ বাজারের উপকণ্ঠে ১৯৮৬ সালে স্থানীয় সাহিত্যামোদিদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ’। এটা এখানকার, রবীন্দ্রচর্চার প্রাণকেন্দ্র।
তিন
পতিসরের নাগোর নদী মানেই রবীন্দ্রনাথের নাগোর নদী। রবীন্দ্র রচনায় এই নদী চিরকালের জন্য অক্ষয় হয়ে আছে। প্রমত্ত পদ্মা দেখার পর রবীন্দ্রনাথ আঁকাবাঁকা ছোট ক্ষীণকায় নদী দেখে ভিন্ন স্বাদ লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যেন নাগোরের একটা মজার সম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য :
কেবল একটি ছোট নদী আছে। যেন সে কেবল এই কয়খানি গ্রামের ঘরের ছেলেমেয়েদের নদী। অন্য কোন বৃহৎ নদী সুদূর সমুদ্র অপরিচিত গ্রাম-নগরের সাথে যে তার যাতায়াত আছে তা এখানকার গ্রামের লোকেরা যেন জানতে পারেনি। তাই তারা অত্যন্ত সুমিষ্ট একটা আদরের নাম দিয়া একটাকে আত্মীয় করে নিয়েছে।
বৈশাখ মাসে যে নদীতে হাঁটু জল থাকত, সে নদী এখন ফাল্গুন মাসেই শুকিয়ে খটখটে হয়ে থাকে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবের কারণেই বাংলাদেশের অন্য দশটি নদীর মতোই নাগোরও আজ মরেছে। নাগোর দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন, নাগোরও দুহাত ভরে রবীন্দ্রনাথকে উজাড় করে তার সৌন্দর্য দিয়েছিল। নাগোর নদীর বোটে বসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার অসাধারণ গান ‘আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা।’ সব মিলিয়ে নাগোর অমর হয়ে আছে আমাদের ছোট নদীর জন্য :
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ী,
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
এক
আমাদের কবিতা মাত্র একবার বিশ্ব জয় করেছিল ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ভেতর দিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং সৃজনশীলতাকে আমূল বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের যেসব জনপদ তার অন্যতম নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার পতিসর। শুধুই কি পতিসর? আত্রাই, নাগোর, রাতোয়াল, কামতা- কোথায় নেই রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্র জীবনীকারদের চোখে ব্রাত্য হলেও, বহুদিন আলোকের বাইরে থাকলেও, সেদিন পতিসর হয়ে উঠেছিল তার সন্ধ্যার মেঘমালা। পতিসরই হয়ে উঠেছিল তার অনেক সাধের সাধনা।
বাংলাদেশের যে অখ্যাত গ্রমাগুলো ভঙ্গুর মৃৎপাত্র হাতে রবীন্দ্রনাথের জন্য অমৃত নিয়ে অপেক্ষা করেছিল, যে জনপদ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি হওয়ার জন্য খুলে দিয়েছিল ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্যের অনির্বচনীয় সিংহ দরজা, যে জনপদে পদার্পণের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার ঘটেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যে জনপদে এসে জনমানুষের সঙ্গে মিশে জমিদার রবীন্দ্রনাথ সত্যিকারার্থে হয়ে উঠেছিলেন ভিন্ন রবীন্দ্রনাথ-সেই জনপদের নাম পতিসর।
পতিসরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংযোগ সাধিত হয় ১৮৯১ সালের ১৫ জানুয়ারি। পিতার নির্দেশে তিনি সেবার জমিদারি দেখাশোনার জন্য এসেছিলেন পতিসর। এরপর থেকে টানা ৪৬ বছর পর্যন্ত চলে পতিসরে আসা-যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে শেষবারের মতো এসেছিলেন ১৯৩৭ সালে। চলনবিল, আত্রাই, নাগোর বিধৌত শ্যামল-কোমল সবুজ নিস্তরঙ্গ পতিসরের প্রতিটি পরতে পরতে আজও লেগে আছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি।
সেই পতিসর দীর্ঘদিন ছিল আমাদের সবার মনোযোগের বাইরে। এই পতিসরে এসেই রবীন্দ্রনাথ গণমানুষের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন আত্মিক সচ্ছলতা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব কৃষক-প্রজা, কামার, কুমার, জেলে, মাঝির অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে না পারলে, অশিক্ষার অন্ধকার থেকে তাদের উদ্ধার করা না গেলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেজন্যই তিনি প্রথমবারের মতো গ্রাম উন্নয়নের জন্য শুরু করেন এক কর্মযজ্ঞ। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, গণমুখী শিক্ষা, সমবায়, তাঁত শিল্প, রেশম শিল্প, কৃষি ব্যাংক স্থাপন, কৃষিঋণ বিতরণ, আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রবর্তন, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় গ্রামীণ বিচারের ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি ছিল তার মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তিনি এখানে ১৯০০ সালে গড়ে তোলেন কালিগ্রাম হিতৈষী সংঘ। প্রতিষ্ঠা করেন দাতব্য চিকিৎসালয়, বয়স্ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেশম শিল্প এবং আরো অনেক কিছু। তার এ উদ্দেশ্যকে সফল করতে এখন থেকে ১০০ বছর আগে ১৯০৫ সালে তিনি পতিসরে প্রতিষ্ঠা করেন কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়বুদ্ধিও হয়তো ছিল। রবীন্দ্রনাথ পতিসরকে, পতিসরের মানুষকে, পতিসরের প্রকৃতিকে ভালোবেসেছিলেন। পতিসরের মানুষও সর্বদা কবিকে জানিয়েছে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, যার রেশ আজও বহমান।
দুই
পতিসরের কিনারঘেঁষে বয়ে গেছে ছোট নদী নাগোর। এই নাগোর নদীর উত্তর পাড়ে রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ির অবস্থান। মাঝখানে খোলা চত্বর। এখানে প্রতি বছর স্থানীয় এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠানমালা। কাছারিবাড়ির ভেতরে প্রবেশপথের দুপাশে একটি করে ফলক উন্মোচিত হয়েছে। ডানের ফলকে লেখা রয়েছে পতিসরে রবীন্দ্র রচনাবলীর তালিকা, ২০০৪ সালে ফলকটি বসানো হয়। বাম পাশের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যু তারিখ, কবির পতিসরে আসার সময়, শেষ আগমনের তারিখ এবং পতিসরে কবির রচিত হতভাগ্যের গানের শেষাংশ। এ দুটি ফলকে অর্থায়ন করেছে উপজেলা পরিষদ, আত্রাই এবং বাস্তবায়ন করেছে মনিয়ার ইউনিয়ন পরিষদ। সিংহ দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই একটি খোলা চত্বর। এখানেই বসত জমজমাট অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ বসতেন ইজিচেয়ারে একবারে উত্তর প্রান্তে উঁচু বারান্দার মাঝখানে। ডান পাশের কক্ষগুলোতে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নামে জাদুঘর। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন স্মৃতি দিয়ে দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছে। এ জাদুঘরে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত যেসব জিনিস সংরক্ষিত রয়েছে, তার মধ্যে একটি আছে ইজিচেয়ার, মোজাইক করা ইট-পাথরে নির্মিত রবীন্দ্রনাথের বাথটাব। এ বাথটাব রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করতেন। বাথটাবের পাশেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বোটের সেই নোঙর। জাদুঘরের মেঝেতে সংরক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত একটি সিন্দুক। মূল্যবান দলিলপত্র অথবা অর্থ রাখার জন্য এটিকে তিনি ব্যবহার করতেন। সিন্দুকের ভেতরে ১৯৫১ সালের কিছু সরকারি দলিল রয়েছে। হয়তো জমিদারি সংক্রান্ত এবং বিভিন্ন জমির দাগ নম্বরসংবলিত কিছু কাগজপত্র রয়েছে। আর তেমন কিছু নেই। জাদুঘরের মেঝেতে সংরক্ষিত আছে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক সেই ট্রাক্টরের একটি ফলা। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চাষাবাদ প্রবর্তনের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তারই একটি স্মারক এ ট্রাক্টরের ফলাটি। পতিসরে প্রথম ট্রাক্টরটি চালিয়েছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে। উত্তরের কক্ষটি কাছারিবাড়ির সবচেয়ে বড় কক্ষ। এখন এটাকে হলরুম বলা হয়। ধারণা করা হয়, এ কক্ষেই রবীন্দ্রনাথের জন্য রচিত হতো রাতযাপনের শয্যা। পতিসরের নিবিড়, নির্জন, স্তব্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বিশ্বকবি হয়তো কখনো কখনো উঠে যেতেন কাছারিবাড়ির ছাদে। এই কাছারিবাড়ির ছাদে বসেই কবি নিঝুম দুপুরে অথবা অলস অপরাহ্নে রচনা করেছিলেন মধ্যাহ্ন, দুর্লভ জন্ম কিংবা সন্ধ্যার মতো
কবিতা :
যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীয় লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।
যা পাইনি তাও থাক যা পেয়েছি তাও,
তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও।
[দুর্লভ জন্ম]
কাছারিবাড়ির উত্তর পাশে রয়েছে নামেই একটা ছাত্রাবাস। এটা এখন পরিত্যক্ত। তবে ধারণা করা হয়, এ ছাত্রাবাসেই কাছারিবাড়িতে কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা থাকতেন। দেয়াল দিয়ে ঘেরা এ কাছারিবাড়ির দক্ষিণের খোলা মাঠের পরই নাগোর নদী। কাছারিবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত রবি-সরোবর। কাছারিবাড়ির পশ্চিমে কিছুটা খোলা জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পতিসর ডাকবাংলো। পতিসরে এসে যারা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ভুবনের ভেতরে প্রবেশ করতে চান, তারা এখানে দিব্যি রাত কাটাতে পারবেন। পতিসর কাছারিবাড়ি থেকে নাগোরের তীরঘেঁষে পূর্বদিকে কিছুটা এগোলে সেই বিখ্যাত মণিতলা। এ মণিতলাতে অনেক তালগাছ গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এ তালগাছগুলো বিশ্বকবিকে আলোড়িত করেছিল। তারই প্রকাশ ঘটে ‘তালগাছ’ লেখাটিতে :
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে,
মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায়-
কোথা পাবে পাখা সে-
সেই তালগাছগুলো এখন আর এখানে নেই। পতিসরে শিক্ষা বিস্তারের জন্য রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার একটি এই কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট। শেষবার যখন রবীন্দ্রনাথ পতিসরে আসেন, তখন তার পুত্রের নামে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। পতিসরে কাছারিবাড়ির কাছে আছে একটি ছোট বাজার। এ বাজারের উপকণ্ঠে ১৯৮৬ সালে স্থানীয় সাহিত্যামোদিদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ’। এটা এখানকার, রবীন্দ্রচর্চার প্রাণকেন্দ্র।
তিন
পতিসরের নাগোর নদী মানেই রবীন্দ্রনাথের নাগোর নদী। রবীন্দ্র রচনায় এই নদী চিরকালের জন্য অক্ষয় হয়ে আছে। প্রমত্ত পদ্মা দেখার পর রবীন্দ্রনাথ আঁকাবাঁকা ছোট ক্ষীণকায় নদী দেখে ভিন্ন স্বাদ লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যেন নাগোরের একটা মজার সম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য :
কেবল একটি ছোট নদী আছে। যেন সে কেবল এই কয়খানি গ্রামের ঘরের ছেলেমেয়েদের নদী। অন্য কোন বৃহৎ নদী সুদূর সমুদ্র অপরিচিত গ্রাম-নগরের সাথে যে তার যাতায়াত আছে তা এখানকার গ্রামের লোকেরা যেন জানতে পারেনি। তাই তারা অত্যন্ত সুমিষ্ট একটা আদরের নাম দিয়া একটাকে আত্মীয় করে নিয়েছে।
বৈশাখ মাসে যে নদীতে হাঁটু জল থাকত, সে নদী এখন ফাল্গুন মাসেই শুকিয়ে খটখটে হয়ে থাকে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবের কারণেই বাংলাদেশের অন্য দশটি নদীর মতোই নাগোরও আজ মরেছে। নাগোর দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন, নাগোরও দুহাত ভরে রবীন্দ্রনাথকে উজাড় করে তার সৌন্দর্য দিয়েছিল। নাগোর নদীর বোটে বসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার অসাধারণ গান ‘আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা।’ সব মিলিয়ে নাগোর অমর হয়ে আছে আমাদের ছোট নদীর জন্য :
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ী,
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অক্ষে আবর্তন করে চাঁদ। দুটি আবর্তন একই সঙ্গে হওয়ায় আমরা সব সময়ই চাঁদের একটি পাশ শুধু দেখে আসছি।
১৪ ঘণ্টা আগেঅনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বর্তমান সময়ে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের নানা দিক তাত্ত্বিকভাবে অনুধাবনের জন্য, মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা সহজবোধ্য ভাবে উপলব্ধি এবং কার্যকরী ভাবে তা বাস্তবায়ন জন্য বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
১৮ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেদিন কী ঘটেছিল সেটি আমার দেশকে জানিয়েছেন ঘটনাস্থলে থাকা সাম্যের দুই বন্ধ আশরাফুল আলম রাফি ও মো. আব্দুল্লাহ আল বায়েজিদ।
১৮ ঘণ্টা আগেরাজধানী ঢাকার রাশিদা বেগম একজন রত্নগর্ভা মা। তিন সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর ‘রত্নগর্ভা মা অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। আরেক মা পঞ্চরত্নের জননী মোছা. ফরিদা বেগম।
২০ ঘণ্টা আগে