ড. আহমদ আনিসুর রহমান
মুকুল চৌধুরীও চলে গেলেন। শক্তিশালী কবি ছিলেন । একে একে সতীর্থরা অনেকেই চলে যাচ্ছেন। আলী ইমাম, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর ও মাহফুজউল্লাহ। সম্প্রতিই গেলেন এরা। এবার মুকুলও।
তার নাম ছিল মঞ্জুরুল করীম চৌধুরী। মুকুল সম্ভবত তার ডাকনাম। কবি হিসেবে মুকুল চৌধুরী নামেই নিজেকে প্রকাশিত করেন। তার সঙ্গে ঠিক কোথায়, কীভাবে পরিচয় হয়, মনে নেই। কিন্তু কালে তার সঙ্গে অতিমধুর বন্ধুত্বপূর্ণ নৈকট্য হয়। আমি চিরকালই দলীয় সংশ্লিষ্টতা, এমনকি কোনো দলের প্রতি দুর্বলতা পরিহার করে চলেছি, সারাজীবন।
আমাদের ভাবের একটি সাধারণ জায়গা ছিল, ধর্মানুরাগ। আমার মার্কসীয় বিশ্লেষণপদ্ধতি ও সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আগ্রহ সত্ত্বেও ধর্মানুরাগ থেকেছে আশৈশব, নানা কারণে। এটা হয়তো অনেকটা ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী উবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও ‘লাল মওলানা’ বলে পরিচিত মওলানা ভাসানীর মতো। অন্যদিকে মুকুল চৌধুরীরও সম্ভবত আশৈশব ধর্মানুরাগ ছিলো। পরে দুজনকে বিশেষভাবে নিকটতর করেছিল নীরব ধর্ম সাধনার চেষ্টা।
১৯৭১ সাল, যুদ্ধসমাপ্তির অল্প পরেই সিলেটনিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সাংসদ মানিক চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়, ঢাকায়। কী সুবাদে, এখন ঠিক মনে নেই। আমাদের বাসাটি সংসদ ভবনের পশ্চিম দিকে আর সাংসদদের ঢাকায় এসে বসবাসের জন্য সরকারি জায়গাটি ছিল সংসদ ভবনের দক্ষিণে। আমাদের এলাকার স্থানীয় মুক্তিফৌজ কমান্ডার, জেনারেল ওসমানীর ভাগিনা, সিলেটনিবাসী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মনোয়ার আলীর বাসাটিও একই এলাকায়, আমাদের বাসার পাশেই। যুদ্ধ-পরবর্তী সময় মুক্তিফৌজের বড় নেতাসহ অনেকেই তার দুই কক্ষের ছোট্ট ফ্ল্যাটে আসতেন। ১৯ বছর বয়সি আমিসহ নবতারুণ্যে সবে প্রবেশ করা তরুণরা তাকে ‘মনোয়ার ভাই’ বলতাম। তার বাসায় যেতাম। তিনি ছিলেন আমার প্রতি বিশেষ স্নেহশীল। খুব সম্ভবত পাশের বাসার সিলেটনিবাসী কমান্ডার ‘মনোয়ার ভাই’-এর মাধ্যমেই সাংসদ মানিক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি সদ্যোমুক্ত বাংলাদেশে বাঙালিদের ভাষায়ও কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক সংস্কারের চেষ্টা শুরু করেন। আমি নিজেও, যুদ্ধের আগে থেকেই দেশে বাংলা ভাষায় প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর কাজে অগ্রগামীদের একজন হিসেবে যুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহারে সংস্কারের কিছু প্রস্তাবের কথা বলতে শুরু করেছিলাম। যদিও তার প্রস্তাব আর আমার প্রস্তাবিত সংস্কারের গতিমুখ ছিল পরস্পরবিরোধী, কোনো কোনো দিক দিয়ে। এসব কারণেই হয়তো মানিক চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। সে সূত্র ধরে তার ভাই, সেকালের শক্তিশালী কবি, আফজাল চৌধুরীর সঙ্গেও। তার মাধ্যমেই সম্ভবত তার ঘনিষ্ঠ কবি মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় । সেই পরিচয়ের সূত্রে মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।
ষাটের দশকের শেষ থেকে, কৈশোর নব-তারুণ্য থেকে, আমরা পুরানা পল্টনকেই পত্রিকা-প্রকাশনাপাড়া হিসেবে জেনে এসেছি। পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে অনেক আগে থেকে বই প্রকাশনার প্রতিষ্ঠান ছিল। সংবাদের মতো দৈনিকের অফিসও ছিল পুরান ঢাকায়, দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস ছিল পুরান ঢাকারই প্রান্তে, মতিঝিলের ধার ঘেঁষে– রামকৃষ্ণ মিশন রোডে। কিন্তু তুলনামূলক আধুনিকতর প্রকাশনা, বিশেষ করে পত্রপত্রিকা প্রকাশনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল পুরানা পল্টন। এর কেন্দ্র ছিল সেকালে ছোট একটি দোতলা বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে প্রখ্যাত চিন্তক বদরুদ্দীন উমরের বাবা, সেকালের আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন পণ্ডিত আবুল হাশিমের পরিচালনাধীন ইসলামিক একাডেমি। কিছুটা দূরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তে ছিল এককালে আরেক আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পরিচালনাধীন বাংলা একাডেমি। দুটো একাডেমিই পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করত, যেমনটি এখনো করে। কিন্তু ইসলামিক একাডেমিতে তারও অতিরিক্ত একটি শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সবুজ পাতা’। ‘কিশোর সাহিত্য মজলিস’ নামে সাপ্তাহিক বৈঠকসহ অন্যান্য সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও হতো, যার জন্য সেকালে আমরা, কিশোর ও নব্য তরুণরা, সেখানে আকৃষ্ট হয়ে যেতাম। জাতি-ধর্ম, পারিবারিক বা কারো কারো তখন উদীয়মান নিজস্ব মতাদর্শিক অবস্থান নির্বিশেষে।
ষাটের দশকের শেষ দিক থেকেই শুরু করে আমিসহ, তখনকার উদীয়মান লেখক, কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিকদের দৈনন্দিন হাজিরাকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরানা পল্টন। আর তার কেন্দ্রে, বিশেষ করে আমাদের মতো উদীয়মান কিশোর-তরুণ লিখিয়ে ও সাংস্কৃতিককর্মীদের জন্য, ছিল ইসলামিক একাডেমির সেই দোতলা বাড়িটি। সেই একাডেমি আর তার বাড়িটিই ১৯৭১-এর পর এক সময় বিশালতর ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এই ফাউন্ডেশনটি দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা পরে শেরেবাংলা নগর রূপে পরিচিত হয়, সেখানে স্থানান্তরিত হয়।
এক সময় এই ফাউন্ডেশনে মুকুল চৌধুরীর চাকরি হয়। দেশে এলে প্রায় রোজই পুরানা পল্টনের পত্রিকাপাড়ায় যেতাম। আগে যেমন। সেই সুবাদে মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কিছু ছোটই ছিলেন বলে জানি। যদিও যেকোনো কারণেই হোক, একসময় তার চুল, এমনকি চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়, আমার অনেক আগে। অগ্রজের মতোই দেখতেন তিনি।
আমি নিজে, ১৯৮৮ সালে, আত্মশুদ্ধি-সাধনার দীক্ষা গ্রহণ করি। ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে আমাকে অন্যদের দীক্ষাদানের দায়িত্ব ও অনুমতি দেওয়া হলেও তা পূর্ণাঙ্গ, আনুষ্ঠানিক ও লিখিতভাবে দেওয়া হয় ২০০৪ সালের মাঝামাঝি। বিষয়টি আমি কাউকে বলতাম না, এখনো সাধারণত বলি না। আত্মশুদ্ধি একান্ত নীরবে করে যাওয়া ব্যক্তিগত সাধনা, বলে বেড়ানোর বিষয় নয়। কিন্তু না জানি কীভাবে, কী আন্দাজ করে একদিন মুকুল চৌধুরী আমাকে চেপে ধরলেন তাকে দীক্ষাদানের জন্য।
আমি তখনো দীক্ষাদান তেমন শুরু করিনি। এখনো খুবই বিরলে তা করি, দায়িত্ববোধ থেকে খুবই আগ্রহী বা প্রতিশ্রুতিশীল কাউকে দেখলে। আমার দীক্ষাগুরু যেভাবে করেছিলেন, আমার প্রায় এক যুগ ধরে বিশ্বময় সফরে দীক্ষাগুরুর নীরব সন্ধানের পর ঘটনাচক্রেই যেন তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই। সাধারণত তিনি তা করতেন না। দীক্ষাদানের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার কারণে কখনো বিরল দু-একজনকে দীক্ষিত জীবনের নীরব-কঠিন সাধনার পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পর্যায়গুলোর দু-চারটি পর্যায়ের কিছু শিখিয়ে দিই নীরবে।
মুকুল চৌধুরীর দীক্ষা অনুরোধ প্রথমে কাটিয়ে যেতে চাইলেও একপর্যায়ে অনেকটা অপারগ হয়ে– অবশ্যই তার অসাধারণ আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতিশীলতা লক্ষ্য করে- তা দান করি। তিনি নবী (সা.)-এর প্রশস্তিমূলক, নবীপত্নীসহ নবীসঙ্গীদের (রা.) রচিত কবিতাগুলোর অনুবাদ করে এক অনবদ্য সংকলন প্রকাশ করেন। এ পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য এটি তার যোগ্যতার নিদর্শন। এরপর তিনি আমার দীক্ষিত শিষ্যরূপে এক অন্য ও উচ্চতর স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্কে সম্পৃক্ত হন।
তার বাড়ির কাছে অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের সন্ত-সাধক-দীক্ষাগুরু থাকতেও তিনি কেন আমার মতো অধমকে এই সম্পর্কে ভূষিত করেন, আমি জানি না। তবে পরম দয়াশীল, পরম প্রাজ্ঞের প্রজ্ঞায় তার কর্মের রহস্য আমরা সব না বুঝলেও তাকে তার পরম দান বলেই শুকরিয়া জানাই।
এরপর প্রায় দুদশক ধরে মুকুল চৌধুরী এই সম্পর্কের দাবি যেভাবে নীরবে, নিষ্ঠায়, আমার কখনো বলে-কয়ে না চাইতেও পূরণ করে গিয়েছেন, তা তারই মতো বিরল। ২০১২/১৩-এর কোনো একসময় বা তার কিছু পরে, আমি তাকেও দীক্ষাদানের অনুমতি ও দায়িত্ব অর্পণ করি। তখন থেকেই তার স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছিল বেশ। কখনো তা নিয়ে হা-হুতাশ করতে দেখিনি। অসাধারণ ধৈর্যে তিনি তা সহ্য করে, যা কিছু সম্ভব তার প্রতিকারে, চেষ্টা করে গিয়েছেন। স্বাস্থ্যগত কারণে দীক্ষাদান হয়তো তিনি তেমন করতে পারেননি। কিন্তু আত্মশুদ্ধির সাধনায় আশা করি তিনি চূড়ান্ত সফলতাই অর্জন করে এই নশ্বর জগৎ থেকে চিরন্তন গিয়েছেন। আমরাও যাতে তেমনি চূড়ান্ত সফলতার দানে ধন্য হই।
এক সময় কোনো এক কারণে সুগন্ধি আগর গাছের শাখা দিয়ে আমার একটি ছড়ি করার শখ হলে তিনি সিলেটের কোনো আগর বাগান থেকে একটি ছড়ি জোগাড় করে নিয়ে আসেন। আমার বিশ্বময় সফরের জীবনে তা একপর্যায়ে হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনি যেন আগর সুবাসিত জগতে সুবাসিত থাকুন, আমরাও যেন।
মুকুল চৌধুরীও চলে গেলেন। শক্তিশালী কবি ছিলেন । একে একে সতীর্থরা অনেকেই চলে যাচ্ছেন। আলী ইমাম, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর ও মাহফুজউল্লাহ। সম্প্রতিই গেলেন এরা। এবার মুকুলও।
তার নাম ছিল মঞ্জুরুল করীম চৌধুরী। মুকুল সম্ভবত তার ডাকনাম। কবি হিসেবে মুকুল চৌধুরী নামেই নিজেকে প্রকাশিত করেন। তার সঙ্গে ঠিক কোথায়, কীভাবে পরিচয় হয়, মনে নেই। কিন্তু কালে তার সঙ্গে অতিমধুর বন্ধুত্বপূর্ণ নৈকট্য হয়। আমি চিরকালই দলীয় সংশ্লিষ্টতা, এমনকি কোনো দলের প্রতি দুর্বলতা পরিহার করে চলেছি, সারাজীবন।
আমাদের ভাবের একটি সাধারণ জায়গা ছিল, ধর্মানুরাগ। আমার মার্কসীয় বিশ্লেষণপদ্ধতি ও সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আগ্রহ সত্ত্বেও ধর্মানুরাগ থেকেছে আশৈশব, নানা কারণে। এটা হয়তো অনেকটা ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী উবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও ‘লাল মওলানা’ বলে পরিচিত মওলানা ভাসানীর মতো। অন্যদিকে মুকুল চৌধুরীরও সম্ভবত আশৈশব ধর্মানুরাগ ছিলো। পরে দুজনকে বিশেষভাবে নিকটতর করেছিল নীরব ধর্ম সাধনার চেষ্টা।
১৯৭১ সাল, যুদ্ধসমাপ্তির অল্প পরেই সিলেটনিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সাংসদ মানিক চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়, ঢাকায়। কী সুবাদে, এখন ঠিক মনে নেই। আমাদের বাসাটি সংসদ ভবনের পশ্চিম দিকে আর সাংসদদের ঢাকায় এসে বসবাসের জন্য সরকারি জায়গাটি ছিল সংসদ ভবনের দক্ষিণে। আমাদের এলাকার স্থানীয় মুক্তিফৌজ কমান্ডার, জেনারেল ওসমানীর ভাগিনা, সিলেটনিবাসী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মনোয়ার আলীর বাসাটিও একই এলাকায়, আমাদের বাসার পাশেই। যুদ্ধ-পরবর্তী সময় মুক্তিফৌজের বড় নেতাসহ অনেকেই তার দুই কক্ষের ছোট্ট ফ্ল্যাটে আসতেন। ১৯ বছর বয়সি আমিসহ নবতারুণ্যে সবে প্রবেশ করা তরুণরা তাকে ‘মনোয়ার ভাই’ বলতাম। তার বাসায় যেতাম। তিনি ছিলেন আমার প্রতি বিশেষ স্নেহশীল। খুব সম্ভবত পাশের বাসার সিলেটনিবাসী কমান্ডার ‘মনোয়ার ভাই’-এর মাধ্যমেই সাংসদ মানিক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি সদ্যোমুক্ত বাংলাদেশে বাঙালিদের ভাষায়ও কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক সংস্কারের চেষ্টা শুরু করেন। আমি নিজেও, যুদ্ধের আগে থেকেই দেশে বাংলা ভাষায় প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর কাজে অগ্রগামীদের একজন হিসেবে যুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহারে সংস্কারের কিছু প্রস্তাবের কথা বলতে শুরু করেছিলাম। যদিও তার প্রস্তাব আর আমার প্রস্তাবিত সংস্কারের গতিমুখ ছিল পরস্পরবিরোধী, কোনো কোনো দিক দিয়ে। এসব কারণেই হয়তো মানিক চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। সে সূত্র ধরে তার ভাই, সেকালের শক্তিশালী কবি, আফজাল চৌধুরীর সঙ্গেও। তার মাধ্যমেই সম্ভবত তার ঘনিষ্ঠ কবি মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় । সেই পরিচয়ের সূত্রে মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।
ষাটের দশকের শেষ থেকে, কৈশোর নব-তারুণ্য থেকে, আমরা পুরানা পল্টনকেই পত্রিকা-প্রকাশনাপাড়া হিসেবে জেনে এসেছি। পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে অনেক আগে থেকে বই প্রকাশনার প্রতিষ্ঠান ছিল। সংবাদের মতো দৈনিকের অফিসও ছিল পুরান ঢাকায়, দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস ছিল পুরান ঢাকারই প্রান্তে, মতিঝিলের ধার ঘেঁষে– রামকৃষ্ণ মিশন রোডে। কিন্তু তুলনামূলক আধুনিকতর প্রকাশনা, বিশেষ করে পত্রপত্রিকা প্রকাশনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল পুরানা পল্টন। এর কেন্দ্র ছিল সেকালে ছোট একটি দোতলা বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে প্রখ্যাত চিন্তক বদরুদ্দীন উমরের বাবা, সেকালের আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন পণ্ডিত আবুল হাশিমের পরিচালনাধীন ইসলামিক একাডেমি। কিছুটা দূরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তে ছিল এককালে আরেক আন্তর্জাতিক পরিচিতিসম্পন্ন পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পরিচালনাধীন বাংলা একাডেমি। দুটো একাডেমিই পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করত, যেমনটি এখনো করে। কিন্তু ইসলামিক একাডেমিতে তারও অতিরিক্ত একটি শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সবুজ পাতা’। ‘কিশোর সাহিত্য মজলিস’ নামে সাপ্তাহিক বৈঠকসহ অন্যান্য সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও হতো, যার জন্য সেকালে আমরা, কিশোর ও নব্য তরুণরা, সেখানে আকৃষ্ট হয়ে যেতাম। জাতি-ধর্ম, পারিবারিক বা কারো কারো তখন উদীয়মান নিজস্ব মতাদর্শিক অবস্থান নির্বিশেষে।
ষাটের দশকের শেষ দিক থেকেই শুরু করে আমিসহ, তখনকার উদীয়মান লেখক, কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিকদের দৈনন্দিন হাজিরাকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরানা পল্টন। আর তার কেন্দ্রে, বিশেষ করে আমাদের মতো উদীয়মান কিশোর-তরুণ লিখিয়ে ও সাংস্কৃতিককর্মীদের জন্য, ছিল ইসলামিক একাডেমির সেই দোতলা বাড়িটি। সেই একাডেমি আর তার বাড়িটিই ১৯৭১-এর পর এক সময় বিশালতর ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এই ফাউন্ডেশনটি দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা পরে শেরেবাংলা নগর রূপে পরিচিত হয়, সেখানে স্থানান্তরিত হয়।
এক সময় এই ফাউন্ডেশনে মুকুল চৌধুরীর চাকরি হয়। দেশে এলে প্রায় রোজই পুরানা পল্টনের পত্রিকাপাড়ায় যেতাম। আগে যেমন। সেই সুবাদে মুকুল চৌধুরীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কিছু ছোটই ছিলেন বলে জানি। যদিও যেকোনো কারণেই হোক, একসময় তার চুল, এমনকি চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়, আমার অনেক আগে। অগ্রজের মতোই দেখতেন তিনি।
আমি নিজে, ১৯৮৮ সালে, আত্মশুদ্ধি-সাধনার দীক্ষা গ্রহণ করি। ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে আমাকে অন্যদের দীক্ষাদানের দায়িত্ব ও অনুমতি দেওয়া হলেও তা পূর্ণাঙ্গ, আনুষ্ঠানিক ও লিখিতভাবে দেওয়া হয় ২০০৪ সালের মাঝামাঝি। বিষয়টি আমি কাউকে বলতাম না, এখনো সাধারণত বলি না। আত্মশুদ্ধি একান্ত নীরবে করে যাওয়া ব্যক্তিগত সাধনা, বলে বেড়ানোর বিষয় নয়। কিন্তু না জানি কীভাবে, কী আন্দাজ করে একদিন মুকুল চৌধুরী আমাকে চেপে ধরলেন তাকে দীক্ষাদানের জন্য।
আমি তখনো দীক্ষাদান তেমন শুরু করিনি। এখনো খুবই বিরলে তা করি, দায়িত্ববোধ থেকে খুবই আগ্রহী বা প্রতিশ্রুতিশীল কাউকে দেখলে। আমার দীক্ষাগুরু যেভাবে করেছিলেন, আমার প্রায় এক যুগ ধরে বিশ্বময় সফরে দীক্ষাগুরুর নীরব সন্ধানের পর ঘটনাচক্রেই যেন তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই। সাধারণত তিনি তা করতেন না। দীক্ষাদানের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার কারণে কখনো বিরল দু-একজনকে দীক্ষিত জীবনের নীরব-কঠিন সাধনার পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পর্যায়গুলোর দু-চারটি পর্যায়ের কিছু শিখিয়ে দিই নীরবে।
মুকুল চৌধুরীর দীক্ষা অনুরোধ প্রথমে কাটিয়ে যেতে চাইলেও একপর্যায়ে অনেকটা অপারগ হয়ে– অবশ্যই তার অসাধারণ আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতিশীলতা লক্ষ্য করে- তা দান করি। তিনি নবী (সা.)-এর প্রশস্তিমূলক, নবীপত্নীসহ নবীসঙ্গীদের (রা.) রচিত কবিতাগুলোর অনুবাদ করে এক অনবদ্য সংকলন প্রকাশ করেন। এ পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য এটি তার যোগ্যতার নিদর্শন। এরপর তিনি আমার দীক্ষিত শিষ্যরূপে এক অন্য ও উচ্চতর স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্কে সম্পৃক্ত হন।
তার বাড়ির কাছে অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের সন্ত-সাধক-দীক্ষাগুরু থাকতেও তিনি কেন আমার মতো অধমকে এই সম্পর্কে ভূষিত করেন, আমি জানি না। তবে পরম দয়াশীল, পরম প্রাজ্ঞের প্রজ্ঞায় তার কর্মের রহস্য আমরা সব না বুঝলেও তাকে তার পরম দান বলেই শুকরিয়া জানাই।
এরপর প্রায় দুদশক ধরে মুকুল চৌধুরী এই সম্পর্কের দাবি যেভাবে নীরবে, নিষ্ঠায়, আমার কখনো বলে-কয়ে না চাইতেও পূরণ করে গিয়েছেন, তা তারই মতো বিরল। ২০১২/১৩-এর কোনো একসময় বা তার কিছু পরে, আমি তাকেও দীক্ষাদানের অনুমতি ও দায়িত্ব অর্পণ করি। তখন থেকেই তার স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছিল বেশ। কখনো তা নিয়ে হা-হুতাশ করতে দেখিনি। অসাধারণ ধৈর্যে তিনি তা সহ্য করে, যা কিছু সম্ভব তার প্রতিকারে, চেষ্টা করে গিয়েছেন। স্বাস্থ্যগত কারণে দীক্ষাদান হয়তো তিনি তেমন করতে পারেননি। কিন্তু আত্মশুদ্ধির সাধনায় আশা করি তিনি চূড়ান্ত সফলতাই অর্জন করে এই নশ্বর জগৎ থেকে চিরন্তন গিয়েছেন। আমরাও যাতে তেমনি চূড়ান্ত সফলতার দানে ধন্য হই।
এক সময় কোনো এক কারণে সুগন্ধি আগর গাছের শাখা দিয়ে আমার একটি ছড়ি করার শখ হলে তিনি সিলেটের কোনো আগর বাগান থেকে একটি ছড়ি জোগাড় করে নিয়ে আসেন। আমার বিশ্বময় সফরের জীবনে তা একপর্যায়ে হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনি যেন আগর সুবাসিত জগতে সুবাসিত থাকুন, আমরাও যেন।
‘শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। দীর্ঘদিনের আবাসন সংকট নিরসনে অস্থায়ী হল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন প্রকল্পও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।’
১২ ঘণ্টা আগে‘সামান্য পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষার্থীকে ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদে নেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক ও সহপাঠীরা আন্দোলনের সময় বারবার হামলার শিকার হয়েছেন, সে বিষয়ে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’
১৪ ঘণ্টা আগেপ্রগতিশীল নেত্রীরা বলেন, এ কর্মসূচি কেবল নারীদের স্বার্থরক্ষা নয় বরং এটি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলনের অংশ।
১৫ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) ‘বোতলকাণ্ড’ ঘিরে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া সহপাঠী ইসতিয়াককে আটকের ঘটনায় যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে ডিবি অফিস ঘেরাও করা হবে।
১৫ ঘণ্টা আগে