কাজী নাসির মামুন
হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের কারণে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য হলে আদমশুমারিতে হিন্দুদের সংখ্যা কমার কথা, কিন্তু বেড়ে গেল কেন? বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব নিয়ে বোদ্ধা মহলে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় গবেষণা সম্ভবত অসীম রায়ের। The Islamic Syncretistic Tradition গ্রন্থে বাঙালি মুসলমানের উদ্ভবের সঙ্গে তিনি কৃষি বিস্তারের প্রক্রিয়াকে যুক্ত করেছেন। পূর্ব বাংলার পাললিক নিম্নভূমিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি বিস্তারের জন্য যে মুসলিম নেতৃস্থানীয় লোকেরা এখানে এসেছেন, তাদের সংস্পর্শে আদিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠী থেকেই বৃহত্তর মুসলিম সমাজের উদ্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। নেতৃস্থানীয় এই মুসলিম পাইওনিয়ারদের পীরের মর্যাদা দেওয়া হতো। দ্বিতীয় ধাপে মুসলিম সাহিত্যিকরা গ্রামীণ মুসলমানদের সঙ্গে নগরের মুসলমানদের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। এতে বাইরের ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় একটি সম্মিলিত সাহিত্য প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। আর এই মিথষ্ক্রিয়াই বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতিকে সমন্বয়বাদী করে তুলেছে। রিচার্ড ইটন তার The Rise Of Islam And The Bengal Frontier গ্রন্থে অসীম রায়ের মতোই প্রকল্পিত প্রচল ধারণাগুলো খণ্ডন করেন। বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব-সংক্রান্ত সঠিক সময় তথা মোগলদের বাংলা বিজয়ের কাল ও স্থান নির্ধারণ করেন। কাজেই এসব গবেষণার কোথাও এমন কথা নেই যে, মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নিপীড়নে বাধ্য হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান হয়েছে কিংবা নিম্নবর্ণের হিন্দু রক্তের অংশীজন হিসেবে মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে দাবিয়ে রাখার যে প্রবণতা, তাও একটি হীন প্রচেষ্টা বলে মনে করি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে হিন্দুত্ববাদ দ্বারা আক্রান্ত, পার্থ চ্যাটার্জির মতো বুদ্ধিজীবীরাও তা স্বীকার করেন। কাজেই বাঙালি মুসলমান বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। ফলে বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলিম সংস্কৃতি বুদ্ধিবৃত্তিক স্বীকৃতির জায়গায় কোণঠাসা। আবার হিন্দুত্ববাদ মানেই যে হিন্দু ধর্ম নয়, এ কথার বুঝ সবার সমান নয়। হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতাকে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক অবলোকন হিসেবে দেখতে চান। বাঙালিত্বের বিপরীতে যেমন দেখেন মুসলমান পরিচয়কে। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্য ধর্মাবলম্বীদের আত্মপরিচয়ের সংকট এতটা ঘনীভূত নয়। তবু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে এ দেশে বাস করা অবাঙালি নাগরিক তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সমাধান হবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সফল ছাত্র-জনতা যে বয়ান আভাসে-ইঙ্গিতে দিয়েছে, তার অর্থ হলো রাষ্ট্র মূলত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে ধারণ করে। সেই জনগোষ্ঠী কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত পোষণ করে রাষ্ট্রে একাত্ম হয়। রাষ্ট্রের কাছে তারা অধিকার চায়। রাষ্ট্র দাবি করে আনুগত্য। যে মৌলিক নীতির ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীর এই আনুগত্যের অঙ্গীকার, সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক; এরকম বাইনারি ভালো-মন্দ বিবেচনা চলে না। কারণ মুসলিম হয়ে ওঠা মানে নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে চাঙা করা বোঝায় না এখন, বরং হীনম্মন্যতা কাটিয়ে মুসলিম হিসেবে নিজের কালচারাল আইডেন্টিটিকে জারি রাখা বোঝায়। সেক্ষেত্রে মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া একজন বিশ্বাসহীন মানুষও আইডেন্টিটির প্রশ্নে মুসলিম। কেউ কেউ বলেন, মুসলমান হওয়ার আগে মানুষ হও। অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বী যে কেউ ধর্মীয় পরিচয় বজায় রেখেও ‘মানুষ’ হতে পারে। মুসলমানকে ‘মানুষ’ হতে হলে ধর্মীয় পরিচয় লুকাতে হয়। গত ২ মার্চ ২০২৫ তারিখে ইমরুল হাসান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন-
“খেয়াল কইরা দেখবেন, যা কিছু মুসলিম রিচুয়ালের ঘটনা, অইগুলা নিয়া লেখলে সেইটা আর ‘বাংলা সাহিত্য’ হইতে পারে না খুব একটা, ‘ইসলামি সাহিত্য’ বইলা আলাদা জিনিস হয়া পড়ে।”
এই স্ট্যাটাসের বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। ‘আলাদা জিনিস হয়া পড়ে’ মানে মুসলিম রিচুয়ালকে ‘আদার’ করে রাখা হয়। এমনকি আমাদের পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনের ঈদ সংখ্যাগুলোর প্রচ্ছদে ঈদের সাংস্কৃতিক ইমেজও ধরা পড়ে না বেশিরভাগ সময়।
বলা হয়ে থাকে ‘সংস্কৃতি শিক্ষিত মানুষের ধর্ম’। আপ্তবাক্যের মতো মনে হলেও সংস্কৃতির এই ধর্মীয় রূপান্তর সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। সেক্যুলারিজম এবং বাঙালিত্বের নামে যে কালচারাল হেজিমনি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, সেই সর্বগ্রাসী প্রভাব জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভাঙতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে লেখক, কবি, ভাবুক, বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক অভিলক্ষ্য নির্মাণে ঐকমত্য প্রয়োজন বলে মনে করি।
তার আগে বুঝতে হবে আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক বয়ান ঠেকিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার নতুন সাংস্কৃতিক সত্য প্রতিষ্ঠায় ভাষা হচ্ছে অনিবার্য নিয়ামক। যে ভাষিক রাজনীতি বাংলা ভাষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মীকৃত আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দকে পরিহার করতে শেখায়, সেই ইতিহাস জানাও জরুরি।
ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৮ সালে A Grammar Of The Bengal Language লেোর সময় ‘মুর’ মুসলমানের ভাষা থেকে বাংলা ভাষাকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন সংস্কৃত হচ্ছে ‘পারস্য উপসাগর থেকে চীন সাগর পর্যন্ত প্রচলিত প্রায় প্রতিটি কথ্যভাষার জন্মদাতা।’ আবার ১৭৮৬ সালে উইলিয়াম জোন্স বলেছেন, সংস্কৃত ভাষা ‘গ্রিকের চেয়ে নিখুঁত, প্রাচুর্যে লাতিনকে ছাড়িয়ে যায়।’ অথচ সবাই এখন জানে সাধারণ মানুষের চর্চিত প্রাকৃতের দুটি আঞ্চলিক রূপের একটি সংস্কৃত, অপরটি বাংলা। পাণিনি কর্তৃক ‘সংস্কারকৃত’ সংস্কৃতি কোনো জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা নয়। হয়তো এই দুই ভাগ্যান্বেষী ইংরেজের জানা ছিল না যে, “বাঙালি জাতির অর্ধেকই মুসলিম এবং ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ ধারণাগুলো সর্বপ্রথম মুসলমানরাই ব্যবহার করে পরিচিত করে তোলে।”
তার এ-ও জানা ছিল না, চর্যাপদের পরে প্রাচীনতম বাংলা কাব্যের রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীর ধর্মের দিক থেকে একজন মুসলমান। মুসলমানদের বাংলায় বসবাসের সূত্রে আরবি-ফারসি শব্দ, বাগধারা, বাগবিধি, অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে এবং সাড়ে ৫০০ বছরের মুসলিম শাসনামলের পরিচর্যায় বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষের মায়ের ভাষা হিসেবে যে ভাষা বিকশিত হয়, সেটিই বাংলা ভাষা, এ তথ্যও তার জানা থাকার কথা নয়। কাজেই মোহাম্মদ আজমের এই অভিমত অকাট্য যে, “ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অবিকশিত-অগঠিত মধ্যবিত্ত নিজের মুখের ভাষাকে ‘মানভাষা’ দাবির হিম্মত বা কাণ্ডজ্ঞান দেখাতে পারেনি... বশ্যতা মেনেছে শাসকের ভাষার। তাতে মানভাষার ক্রম গেছে উল্টে। ভাষা জিব থেকে কলমে না এসে কলম থেকে জিবে আসার চেষ্টা করেছে। ফল হয়েছে কথার ভাষায় ও লেখার ভাষায় দুরারোগ্য ফারাক।”
আশার কথা হচ্ছে, সেই ‘দুরারোগ্য ফারাক’ রোধের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের কবিতায় বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে। প্রমিত-অপ্রমিতের ভেদ রেখা মুছে দিয়ে কবিতাকে মুখের ভাষার আদলে কিংবা আঞ্চলিক রূপায়নে লেখার এই প্রয়াস তরুণ এবং বর্ষীয়ান সব কবির মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষায় ব্যবহৃত আরবি, ফারসি, তুর্কি ও ধর্মীয় শব্দ এবং স্ল্যাং পরিবেশনায় কোনো কবির মধ্যেই কোনো দ্বিধা বা আড়ষ্টতা লক্ষ্য করি না। কোলকাতাকেন্দ্রিক প্রমিত-প্রভাব কাটিয়ে ভাষার এই নিজস্ব গড়ন ঔপনিবেশিক ভাষা-রাজনীতির বিপক্ষে এক মোক্ষম জবাব।
বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে শিল্প-সাহিত্যে এরকম পরিবর্তনের ছোঁয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে ইংরেজি সাহিত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের হাত ধরে রোমান্টিকতার জন্ম হয়। ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’-এর ভূমিকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক কবিতার মেনিফেস্টো প্রদান করেন, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় কবিতা লেখার পক্ষে যুক্তি দেন। কেননা তার মতে, এই ‘রাস্টিক’ ভাষা স্ফূর্ত ও দার্শনিকতায় ঋদ্ধ। জুলাই গণআন্দোলনে ব্যবহৃত বিভিন্ন দেয়াল লিখন, স্লোগান, বিদ্রুপ-বাক্য, রাজনৈতিক বয়ান, ইঙ্গিতময় দিকনির্দেশনা, ফেসবুক স্ট্যাটাসসহ বিভিন্ন আলামত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আমাদের ভাষা আরো নিরাভরণ হতে চাইছে। তার গতিপথ স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ, সরাসরি অথচ শানিত ও তির্যক। আমাদের কবিতায় এই ভাষিক প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কিন্তু স্বেচ্ছাচার শিল্প-চৈতন্যের সব সীমানা তছনছ করে দিলে নতুন কাব্য-প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসূ হবে, সে বিষয়ে সংশয় আছে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমা শিল্পতত্ত্ব ও কলকাতাকেন্দ্রিক নন্দন-নৈকট্য এড়িয়ে নিজস্ব কাব্য-ঐতিহ্যকে আবিষ্কার করা জরুরি। আরো জরুরি হলো স্বদেশের মাটি খুঁড়ে তত্ত্ব-তালাশ। একটি কবিতার সামান্য উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই। অপরাপর অনেক কবিতার মতোই ফয়েজ আলমের এই কবিতার ভাষা আঞ্চলিক নয়, তবে অ-প্রমিত। একটি মায়াবি বেদনা রহস্যের মতো ছড়িয়ে আছে এখানে। এই বেদনা দৃশ্যমান কিন্তু অধরা-
‘গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা
ফুলার রোডের নিরালা ফুটপাতে বসি
শহীদ মিনারের সিঁড়ি পার্কের বেঞ্চিতে বইসাই থাকি
যেন কিছু একটা ঘটবে
এইখানে আপাতত গুমঘর গুলিবৃষ্টি কাঁদানে গ্যাস নাই
চাপাতি হকিস্টিক বুটের আওয়াজ নাই
তাই আমাদের গানগুলি যত্নে পকেটে রাখতেছি
রাষ্ট্রমঞ্চে ভিনদেশি পুরাণের আখ্যান
আর শাস্ত্রীয় সংগীত শেষ হইলে পরে
মনদিল ঢাইলা দিয়া দুএকটা গাইতে চাই
জনতার আসরে
আমরা টুকটাক চিনা বাদাম খাই, মামার লাল চা খাই
ভাবি দুনিয়া বদলায়া গেছে
পুরানা দিন শেষ
যদিও চাইরদিকে চিনা দৃশ্যগুলা আবার আঁকা হইতেছে চুপে
গলির কুকুর ফিরত, চাঅলা বসছে আগের ভাঙ্গা বেঞ্চিতে
কোনোখানে শানানো
ক্ষুরের ফলায় রৈদ—
আমরা দেইখাও দেখি না।’
হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের কারণে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য হলে আদমশুমারিতে হিন্দুদের সংখ্যা কমার কথা, কিন্তু বেড়ে গেল কেন? বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব নিয়ে বোদ্ধা মহলে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় গবেষণা সম্ভবত অসীম রায়ের। The Islamic Syncretistic Tradition গ্রন্থে বাঙালি মুসলমানের উদ্ভবের সঙ্গে তিনি কৃষি বিস্তারের প্রক্রিয়াকে যুক্ত করেছেন। পূর্ব বাংলার পাললিক নিম্নভূমিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি বিস্তারের জন্য যে মুসলিম নেতৃস্থানীয় লোকেরা এখানে এসেছেন, তাদের সংস্পর্শে আদিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠী থেকেই বৃহত্তর মুসলিম সমাজের উদ্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। নেতৃস্থানীয় এই মুসলিম পাইওনিয়ারদের পীরের মর্যাদা দেওয়া হতো। দ্বিতীয় ধাপে মুসলিম সাহিত্যিকরা গ্রামীণ মুসলমানদের সঙ্গে নগরের মুসলমানদের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। এতে বাইরের ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় একটি সম্মিলিত সাহিত্য প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। আর এই মিথষ্ক্রিয়াই বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতিকে সমন্বয়বাদী করে তুলেছে। রিচার্ড ইটন তার The Rise Of Islam And The Bengal Frontier গ্রন্থে অসীম রায়ের মতোই প্রকল্পিত প্রচল ধারণাগুলো খণ্ডন করেন। বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব-সংক্রান্ত সঠিক সময় তথা মোগলদের বাংলা বিজয়ের কাল ও স্থান নির্ধারণ করেন। কাজেই এসব গবেষণার কোথাও এমন কথা নেই যে, মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নিপীড়নে বাধ্য হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান হয়েছে কিংবা নিম্নবর্ণের হিন্দু রক্তের অংশীজন হিসেবে মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে দাবিয়ে রাখার যে প্রবণতা, তাও একটি হীন প্রচেষ্টা বলে মনে করি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে হিন্দুত্ববাদ দ্বারা আক্রান্ত, পার্থ চ্যাটার্জির মতো বুদ্ধিজীবীরাও তা স্বীকার করেন। কাজেই বাঙালি মুসলমান বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। ফলে বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলিম সংস্কৃতি বুদ্ধিবৃত্তিক স্বীকৃতির জায়গায় কোণঠাসা। আবার হিন্দুত্ববাদ মানেই যে হিন্দু ধর্ম নয়, এ কথার বুঝ সবার সমান নয়। হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতাকে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক অবলোকন হিসেবে দেখতে চান। বাঙালিত্বের বিপরীতে যেমন দেখেন মুসলমান পরিচয়কে। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্য ধর্মাবলম্বীদের আত্মপরিচয়ের সংকট এতটা ঘনীভূত নয়। তবু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে এ দেশে বাস করা অবাঙালি নাগরিক তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সমাধান হবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সফল ছাত্র-জনতা যে বয়ান আভাসে-ইঙ্গিতে দিয়েছে, তার অর্থ হলো রাষ্ট্র মূলত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে ধারণ করে। সেই জনগোষ্ঠী কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত পোষণ করে রাষ্ট্রে একাত্ম হয়। রাষ্ট্রের কাছে তারা অধিকার চায়। রাষ্ট্র দাবি করে আনুগত্য। যে মৌলিক নীতির ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীর এই আনুগত্যের অঙ্গীকার, সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক; এরকম বাইনারি ভালো-মন্দ বিবেচনা চলে না। কারণ মুসলিম হয়ে ওঠা মানে নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে চাঙা করা বোঝায় না এখন, বরং হীনম্মন্যতা কাটিয়ে মুসলিম হিসেবে নিজের কালচারাল আইডেন্টিটিকে জারি রাখা বোঝায়। সেক্ষেত্রে মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া একজন বিশ্বাসহীন মানুষও আইডেন্টিটির প্রশ্নে মুসলিম। কেউ কেউ বলেন, মুসলমান হওয়ার আগে মানুষ হও। অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বী যে কেউ ধর্মীয় পরিচয় বজায় রেখেও ‘মানুষ’ হতে পারে। মুসলমানকে ‘মানুষ’ হতে হলে ধর্মীয় পরিচয় লুকাতে হয়। গত ২ মার্চ ২০২৫ তারিখে ইমরুল হাসান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন-
“খেয়াল কইরা দেখবেন, যা কিছু মুসলিম রিচুয়ালের ঘটনা, অইগুলা নিয়া লেখলে সেইটা আর ‘বাংলা সাহিত্য’ হইতে পারে না খুব একটা, ‘ইসলামি সাহিত্য’ বইলা আলাদা জিনিস হয়া পড়ে।”
এই স্ট্যাটাসের বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। ‘আলাদা জিনিস হয়া পড়ে’ মানে মুসলিম রিচুয়ালকে ‘আদার’ করে রাখা হয়। এমনকি আমাদের পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনের ঈদ সংখ্যাগুলোর প্রচ্ছদে ঈদের সাংস্কৃতিক ইমেজও ধরা পড়ে না বেশিরভাগ সময়।
বলা হয়ে থাকে ‘সংস্কৃতি শিক্ষিত মানুষের ধর্ম’। আপ্তবাক্যের মতো মনে হলেও সংস্কৃতির এই ধর্মীয় রূপান্তর সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। সেক্যুলারিজম এবং বাঙালিত্বের নামে যে কালচারাল হেজিমনি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, সেই সর্বগ্রাসী প্রভাব জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভাঙতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে লেখক, কবি, ভাবুক, বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক অভিলক্ষ্য নির্মাণে ঐকমত্য প্রয়োজন বলে মনে করি।
তার আগে বুঝতে হবে আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক বয়ান ঠেকিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার নতুন সাংস্কৃতিক সত্য প্রতিষ্ঠায় ভাষা হচ্ছে অনিবার্য নিয়ামক। যে ভাষিক রাজনীতি বাংলা ভাষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মীকৃত আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দকে পরিহার করতে শেখায়, সেই ইতিহাস জানাও জরুরি।
ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৮ সালে A Grammar Of The Bengal Language লেোর সময় ‘মুর’ মুসলমানের ভাষা থেকে বাংলা ভাষাকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন সংস্কৃত হচ্ছে ‘পারস্য উপসাগর থেকে চীন সাগর পর্যন্ত প্রচলিত প্রায় প্রতিটি কথ্যভাষার জন্মদাতা।’ আবার ১৭৮৬ সালে উইলিয়াম জোন্স বলেছেন, সংস্কৃত ভাষা ‘গ্রিকের চেয়ে নিখুঁত, প্রাচুর্যে লাতিনকে ছাড়িয়ে যায়।’ অথচ সবাই এখন জানে সাধারণ মানুষের চর্চিত প্রাকৃতের দুটি আঞ্চলিক রূপের একটি সংস্কৃত, অপরটি বাংলা। পাণিনি কর্তৃক ‘সংস্কারকৃত’ সংস্কৃতি কোনো জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা নয়। হয়তো এই দুই ভাগ্যান্বেষী ইংরেজের জানা ছিল না যে, “বাঙালি জাতির অর্ধেকই মুসলিম এবং ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ ধারণাগুলো সর্বপ্রথম মুসলমানরাই ব্যবহার করে পরিচিত করে তোলে।”
তার এ-ও জানা ছিল না, চর্যাপদের পরে প্রাচীনতম বাংলা কাব্যের রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীর ধর্মের দিক থেকে একজন মুসলমান। মুসলমানদের বাংলায় বসবাসের সূত্রে আরবি-ফারসি শব্দ, বাগধারা, বাগবিধি, অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে এবং সাড়ে ৫০০ বছরের মুসলিম শাসনামলের পরিচর্যায় বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষের মায়ের ভাষা হিসেবে যে ভাষা বিকশিত হয়, সেটিই বাংলা ভাষা, এ তথ্যও তার জানা থাকার কথা নয়। কাজেই মোহাম্মদ আজমের এই অভিমত অকাট্য যে, “ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অবিকশিত-অগঠিত মধ্যবিত্ত নিজের মুখের ভাষাকে ‘মানভাষা’ দাবির হিম্মত বা কাণ্ডজ্ঞান দেখাতে পারেনি... বশ্যতা মেনেছে শাসকের ভাষার। তাতে মানভাষার ক্রম গেছে উল্টে। ভাষা জিব থেকে কলমে না এসে কলম থেকে জিবে আসার চেষ্টা করেছে। ফল হয়েছে কথার ভাষায় ও লেখার ভাষায় দুরারোগ্য ফারাক।”
আশার কথা হচ্ছে, সেই ‘দুরারোগ্য ফারাক’ রোধের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের কবিতায় বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে। প্রমিত-অপ্রমিতের ভেদ রেখা মুছে দিয়ে কবিতাকে মুখের ভাষার আদলে কিংবা আঞ্চলিক রূপায়নে লেখার এই প্রয়াস তরুণ এবং বর্ষীয়ান সব কবির মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষায় ব্যবহৃত আরবি, ফারসি, তুর্কি ও ধর্মীয় শব্দ এবং স্ল্যাং পরিবেশনায় কোনো কবির মধ্যেই কোনো দ্বিধা বা আড়ষ্টতা লক্ষ্য করি না। কোলকাতাকেন্দ্রিক প্রমিত-প্রভাব কাটিয়ে ভাষার এই নিজস্ব গড়ন ঔপনিবেশিক ভাষা-রাজনীতির বিপক্ষে এক মোক্ষম জবাব।
বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে শিল্প-সাহিত্যে এরকম পরিবর্তনের ছোঁয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে ইংরেজি সাহিত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের হাত ধরে রোমান্টিকতার জন্ম হয়। ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’-এর ভূমিকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক কবিতার মেনিফেস্টো প্রদান করেন, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় কবিতা লেখার পক্ষে যুক্তি দেন। কেননা তার মতে, এই ‘রাস্টিক’ ভাষা স্ফূর্ত ও দার্শনিকতায় ঋদ্ধ। জুলাই গণআন্দোলনে ব্যবহৃত বিভিন্ন দেয়াল লিখন, স্লোগান, বিদ্রুপ-বাক্য, রাজনৈতিক বয়ান, ইঙ্গিতময় দিকনির্দেশনা, ফেসবুক স্ট্যাটাসসহ বিভিন্ন আলামত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আমাদের ভাষা আরো নিরাভরণ হতে চাইছে। তার গতিপথ স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ, সরাসরি অথচ শানিত ও তির্যক। আমাদের কবিতায় এই ভাষিক প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কিন্তু স্বেচ্ছাচার শিল্প-চৈতন্যের সব সীমানা তছনছ করে দিলে নতুন কাব্য-প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসূ হবে, সে বিষয়ে সংশয় আছে। সেক্ষেত্রে পশ্চিমা শিল্পতত্ত্ব ও কলকাতাকেন্দ্রিক নন্দন-নৈকট্য এড়িয়ে নিজস্ব কাব্য-ঐতিহ্যকে আবিষ্কার করা জরুরি। আরো জরুরি হলো স্বদেশের মাটি খুঁড়ে তত্ত্ব-তালাশ। একটি কবিতার সামান্য উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই। অপরাপর অনেক কবিতার মতোই ফয়েজ আলমের এই কবিতার ভাষা আঞ্চলিক নয়, তবে অ-প্রমিত। একটি মায়াবি বেদনা রহস্যের মতো ছড়িয়ে আছে এখানে। এই বেদনা দৃশ্যমান কিন্তু অধরা-
‘গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা
ফুলার রোডের নিরালা ফুটপাতে বসি
শহীদ মিনারের সিঁড়ি পার্কের বেঞ্চিতে বইসাই থাকি
যেন কিছু একটা ঘটবে
এইখানে আপাতত গুমঘর গুলিবৃষ্টি কাঁদানে গ্যাস নাই
চাপাতি হকিস্টিক বুটের আওয়াজ নাই
তাই আমাদের গানগুলি যত্নে পকেটে রাখতেছি
রাষ্ট্রমঞ্চে ভিনদেশি পুরাণের আখ্যান
আর শাস্ত্রীয় সংগীত শেষ হইলে পরে
মনদিল ঢাইলা দিয়া দুএকটা গাইতে চাই
জনতার আসরে
আমরা টুকটাক চিনা বাদাম খাই, মামার লাল চা খাই
ভাবি দুনিয়া বদলায়া গেছে
পুরানা দিন শেষ
যদিও চাইরদিকে চিনা দৃশ্যগুলা আবার আঁকা হইতেছে চুপে
গলির কুকুর ফিরত, চাঅলা বসছে আগের ভাঙ্গা বেঞ্চিতে
কোনোখানে শানানো
ক্ষুরের ফলায় রৈদ—
আমরা দেইখাও দেখি না।’
‘শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। দীর্ঘদিনের আবাসন সংকট নিরসনে অস্থায়ী হল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন প্রকল্পও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।’
১১ ঘণ্টা আগে‘সামান্য পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষার্থীকে ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদে নেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক ও সহপাঠীরা আন্দোলনের সময় বারবার হামলার শিকার হয়েছেন, সে বিষয়ে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’
১৩ ঘণ্টা আগেপ্রগতিশীল নেত্রীরা বলেন, এ কর্মসূচি কেবল নারীদের স্বার্থরক্ষা নয় বরং এটি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলনের অংশ।
১৪ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) ‘বোতলকাণ্ড’ ঘিরে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া সহপাঠী ইসতিয়াককে আটকের ঘটনায় যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে ডিবি অফিস ঘেরাও করা হবে।
১৪ ঘণ্টা আগে