Ad T1

পুলিশের গুলিতে নষ্ট সামিরুলের ডান চোখ, অন্যটি নিয়েও শঙ্কা

মো. জসীম উদ্দিন, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৩

২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদ পতনের গণআন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন দেশের ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভ মিছিলে রাজপথ যখন উত্তাল তখন স্লোগানে বারুদ হয়ে ফুটেছিলেন মো. সামিরুল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়। কিন্তু এখনো সারা শরীরে ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশের গুলির ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন এই তরুণ। গুলিতে তার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখও ক্ষীণ।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার উত্তরবীর গ্রামের বেনু মিয়ার ছেলে সামিরুল । তিনি গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। গত ৫ আগস্ট গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হন। সেদিনের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে এখনো আঁতকে ওঠেন সামিরুল।

আন্দোলনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সামিরুল আমার দেশকে বলেন, কোটা আন্দোলনের ন্যায্যতাকে পাশ কাটিয়ে উল্টো ছাত্রদের নিয়ে কটূক্তি করেন ফ্যাসিস্ট সরকারের তৎকালীন প্রধান শেখ হাসিনা। এতে সারা বাংলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ তুমুল আন্দোলনে ফেটে পড়েন। আমিও রাজপথে স্লোগান ধরি। ৫ আগস্ট সকালে কারফিউ ভেঙে ঢাকার রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিই। মিছিল করতে করতে গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে পৌঁছালে, পুলিশ মিছিলে পাখির মতো গুলি করে। তাদের গুলিবৃষ্টির মুখেও আমরা পিছু হটিনি। সামনে এগোতে থাকি। কিন্তু বেশিক্ষণ আর সামনে এগোতে পারিনি। সারা শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় গুলিতে।

শরীরে ৬০টি গুলির ক্ষত বয়ে বেড়ানো সামিরুল বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে একপর্যায়ে সড়কে লুটিয়ে পড়ি। এক অজ্ঞাতনামা পথচারী এসে গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে ভর্তি করান। রাতে জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি স্বৈরাচারী হাসিনা পালিয়ে গেছে। বিজয়ী ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনতা রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করে। তখন আমি হাত তুলে আল্লার কাছে প্রার্থনা করি। দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হওয়ায় শোকরিয়া আদায় করি।

এদিকে জ্ঞান ফেরার পর পরিবারকে জানানো হয় সামিরুলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা। সামিরুল বলেন, আমাদের পরিবারের সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যয় হয়ে যায় চিকিৎসার পেছনে। পরে সরকারি সহায়তায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে ভর্তি হই। এখনো এখানে চিকিৎসাধীন আছি। আমার শরীর জুড়ে এখনো ব্যথা। ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাম চোখেও কম দেখতে পাই। এই চোখটি নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে সামিরুল বলেন, সিঙ্গাপুর থকে একটি টিম এসে দেখে গেছে। তারা জানিয়েছে সার্জারি করাতে হবে।

বাবা বৃদ্ধ বেনু মিয়া বলেন, আমাদের দরিদ্র পরিবার। ভিটা ছাড়া আর কিছু নেই। ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করত সামিরুল। তার উপার্জনেই আমাদের সংসার চলত। সে আহত হওয়ার পর আমাদের যৎসামান্য সঞ্চয় ছিল, তা-ও শেষ হয়ে গেছে। এখন ধার-দেনা করে চলছি। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা দিয়েছিল। জেলা প্রশাসনও কিছু টাকা দিয়েছে। এই অল্প টাকা তার চিকিৎসাতেই নানাভাবে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার অবস্থা এখন পথে বসার পর্যায়ে।

মা শাহিনা বেগম বলেন, ছেলের ডান চোখ হারানোর পর ঘুমাতে পারি না। তার শরীরের গুলির ক্ষতচিহ্ন যখন দেখি, তখন চোখ দিয়ে পানি পড়ে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। বড় ছেলে চোখ হারানোর পর ১৬ বছরের কিশোর ছেলে শাহিন পরিবারের হাল ধরেছে। সে ছোট একটি বেভারেজ কোম্পানিতে সামান্য বেতনে চাকরি করে। সংসারের জন্য তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে জুলাই বিপ্লবের এই আহত যোদ্ধা মো. সামিরুল বলেন, এখন আমাদের চাওয়া শুধু সুচিকিৎসা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলে আমাদের দাবি অর্ধেক পূরণ হয়ে যাবে।

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইসরাইল মিয়া বলেন, এখন তার চিকিৎসা চলছে সরকারি ব্যয়ে। সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহত ব্যক্তি ও তার পরিবারের প্রতি আন্তরিক। আমরা তাদের নানাভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।

Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত