Ad T1

ফ্যাসিবাদ পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য সমস্যা

ড. মো. আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৬: ৫৯
স্বৈরাচারী শাসন বলতে এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে একজন ব্যক্তি দেশের সকল ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে। স্বৈরাচারী শাসনের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য হল- একজন ব্যক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতায় থাকা, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা, আইনের শাসন না থাকা, বিরোধী মত পোষণকারীদের দমন করা, সরকার নিজের স্বার্থে মিথ্যাচার ও প্রচারণা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা, শাসকগোষ্ঠী ও তাদের ঘনিষ্ঠদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া, দুর্নীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চললে একটি দেশের সকল খাতেই গভীর প্রভাব পড়ে। জনস্বাস্থ্য সেক্টরও এর বাইরে থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া, অর্থনৈতিক সঙ্কট, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অবক্ষয় এবং সামাজিক অস্থিরতা স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পরেও দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে।
সাধারণত কোনো স্বৈরাচারী সরকারই সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। প্রতিবাদকারী সাধারণ মানুষের উপর অমানুষিক দমন নিপীড়ন করে যে কোনোভাবে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় এবং এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। সমাজে দাঙ্গা, হতাহত এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। ফলে হাসপাতাল গুলোতে হতাহত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হয়। নির্বিচারে মানুষ হত্যা, হতাহতের ঘটনায় জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। যেমন জুলাই আগস্ট গণহত্যায় যারা নিহত বা আহত হয়েছেন তাদের পরিবার স্বাভাবিকভাবেই মানুষিক ট্রমায় আক্রান্ত। এছাড়া যারা স্বচক্ষে বীভৎস হত্যাকাণ্ড দেখেছে তারাও মানুষিক ট্রমায় আক্রান্ত।
স্বাস্থ্য খাত একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। বলা হয়ে থাকে, যে দেশের জনগণ স্বাস্থ্যের দিক থেকে এগিয়ে, সে দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে গতিশীল।
যেকোনো দেশ বা জাতির সমৃদ্ধির জন্য তার জনগোষ্ঠীকে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করা অর্থাৎ সৃজনশীল, নৈতিকতাসম্পন্ন, আলোকিত মানুষ এবং অবশ্যই শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। তা না হলে দেশটি কখনোই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে না।
কিন্তু বিগত ১৫ বছর অবৈধ সৈরাচার সরকার মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে বড় অন্তরায় রেখেছিলো। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের নামে শুধু অর্থ লুটপাটই করে গিয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে জনসংখ্যা অনেক বেশি। সাথে রয়েছে সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও স্বাস্থ্যহীনতার প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম নাগরিকদের মধ্যে প্রভাব ফেলে যেমনঃ অর্থের অভাব, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে নাগরিকদের অচেতনতা এবং আয় ও ব্যায়ের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা।
এই অবস্থায় কি কি সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছেঃ
১. আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দ্বায়িত্ববোধের জায়গায় অনেক সমস্যা যা নিয়ে সরকারকে আন্তরিকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। আমাদের রাষ্ট্রের যে স্বাস্থ্য নীতি রয়েছে তাতে করে সব নাগরিক স্বাস্থ্য সেবা ঠিকভাবে পান না। এর অন্যতম কারণ রাষ্ট্রের পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে।
২. স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত এমন সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের এবং আন্তরিকতার অভাব একটি বড় সমস্যা। এটি নিয়েও সঠিক স্বাস্থ্য নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকারকে কাজ করা প্রয়োজন।
৩. পরিকল্পিত নগর বাস্তবায়ন করে সাথে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ যদি স্বাস্থ্যসম্মত না হয় তাহলে খুব সহজেই মানুষ রোগাক্রান্ত হবে যাতে করে জনস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়বে। উদাহরণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে সামনে নিয়ে আসা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পানির গুণমান, বায়ুর গুণমান, কৃষি, স্যানিটেশন এবং বাসযোগ্য স্থানের ক্ষেত্রে স্পষ্ট। এটি নাগরিকের স্বাস্থ্য, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী এবং মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও স্পষ্ট।
এটি পরিহার করার অন্যতম উপায় হলো জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার বা প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সমাজে তথা রাষ্ট্রে পরিষ্কার এবং পুনর্বীকরণযোগ্য শক্তির উদ্যোগের মাধ্যমে জনসাধারণকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং প্যারিস চুক্তির মতো স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু ও স্বাস্থ্য সভাগুলির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা।
এছাড়াও খুব সহজে নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলির মাধ্যমে পরিবেশগত জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু উপায় ব্যবহার করা যেতে পারে:
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে সমাজে নাগরিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতির ধারণা দেওয়া।
২. বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্য সমতা এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগে প্রচার করা।
৩. পরিবেশগত স্বাস্থ্য অনুশীলনকারীদের জন্য একটি স্লোগান সমাজে তথা রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা।
রাষ্ট্রের জন্য জনস্বাস্থ্য সেক্টরটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সহজ কথায়, এটি জনগণের স্বাস্থ্যের প্রতিরোধ এবং উন্নতি উভয়ই জড়িত। যদিও জনস্বাস্থ্য একটি ক্লিনিকাল চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বিষয় কিন্তু জনস্বাস্থ্যে কাজ করার জন্য আপনাকে ডাক্তার বা নার্স হতে হবে না। জনস্বাস্থ্য এটি ক্রমাগত মানুষের মধ্যে বৈষম্যের ব্যবধান বন্ধ করতে এবং শিশুদের তথা সমস্ত জাতীর এবং লিঙ্গের জন্য সমান সুযোগগুলিকে উৎসাহিত করার জন্য সচেষ্ট। এটি স্বতন্ত্র স্তরে স্বাস্থ্যের উপর ফোকাস করার পরিবর্তে সমগ্র জনসংখ্যার স্বাস্থ্যকেও বিবেচনা করে। এছাড়া জনস্বাস্থ্য এটি শিক্ষামূলক কর্মসূচি, প্রচারণা এবং সরকারি নীতিমালা প্রভাবিত করার মাধ্যমে সকলের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা নিশ্চিত করে। জনস্বাস্থ্যের আরেকটি মৌলিক গুণ হলো এর প্রতিরোধমূলক প্রকৃতি। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অনেক বেশি কার্যকর এবং অনেক কম ব্যয়বহুল। জনস্বাস্থ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থ্য সমস্যা শনাক্ত করতে এবং রোগের বিকাশ এড়াতে যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সহায়তা করে। আমাদের যদি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকে তাহলে বিভ্রান্তিমূলক এবং ভুল তথ্য জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে যেমনঃ
ক. রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে বিভ্রান্তিমূলক এবং ভুল তথ্য পরিস্থিতিকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে রোগের চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
খ. গুজবের কারণে সৃষ্ট সন্দেহ বা অবিশ্বাসের কারণে অনেক মানুষ হাসপাতালে বা চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা করান না। কোভিড-১৯ অতিমারির সময় এই কারণেই আফ্রিকার ১৫টা দেশ, আমেরিকা ও ইউরোপে মানুষ টিকা নিতে দ্বিধা করেছিল এবং উত্তর আফ্রিকায় ইবোলা রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়েও এমনটা হয়েছিল।
গ. ভাষাগত বাধা বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের একটা প্রধান কারণ হতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে নাগরিকে তার মাতৃভাষায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য না দেওয়া হলে তার বোধগম্যতা প্রায় ৭৮% কমে যায়।
দেশের মূল সমস্যা অধিক জনসংখ্যা, সে দিক দিয়ে বাংলাদেশের কিছু অর্জন রয়েছে। যেমন
পাঁচ বছরের নিচে কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুহার অনেকখানি কমলেও জন্মের একমাসের মধ্যে শিশু মৃত্যুহার এখনো উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব হয়নি। চিকিৎসক কিংবা প্রশিক্ষত মিডওয়াইফ দ্বারা সন্তান জন্মদানের হার বাড়লেও হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে অব্যবস্থাপনার জন্য রোগীরা সেবা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন যা সেবা গ্রহণে নিরুৎসাহিত হবার অন্যতম কারণ।
তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। শিশু অপুষ্টির মাপকাঠিতে বাংলাদেশ এখনো পৃথিবীর প্রথম সারিতে। তবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব খুব দ্রুত। জনসংখ্যা বাড়ছে সাথে বাড়ছে স্বাস্থ্যগতসহ নানা নাগরিক সমস্যা। তবে সমস্যা যত সমাধানও তত। সকলের সচেতনতা এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভব সুন্দর সমাজ গঠন। বাস্তবিক অর্থে বিগত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘অব্যবস্থাপনা’ সেটিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গভীর ও তীক্ষ্ণ নজর দিতে পারে। সত্যিকার অর্থেই দেশে পেশাদার একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তৃণমূল থেকে যত উপরে যাওয়া যায় সর্বত্রই একই দৃশ্য প্রতীয়মান হয়। আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, জিডিপির পাঁচ শতাংশের মতো অর্থ স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। বাংলাদেশে এক যুগের অধিককাল ধরে বাজেটে জিডিপির এক শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও কম-বেশি ৭০ শতাংশ বেতন-ভাতা ইত্যাদির মতো খাতে খরচ হয়। বাকি অর্থ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ব্যবহৃত হওয়ার কথা, যা নিতান্তই অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবে এ খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে এই অর্থের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন নিয়মিত গবেষণা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য অভিযোগটি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বিপুল অগ্রগতি হতে পারে। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্জনগুলো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশের জনসাধারণের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো নিরসন করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে তা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট, ভাইস চেয়ারম্যান- নূর ই সামাদ নার্সিং কলেজ।

বিষয়:

মতামত
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত