Ad T1

‘কালো ঘাম’ ছুটলো মোদি-দোভালের

আলফাজ আনাম
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ৫০

শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের প্রধান হিসেবে যাতে ড. ইউনূস দায়িত্ব না নিতে পারেন, সে জন্য ভারত শুরু থেকে সব শক্তি নিয়োগ করেছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার অনড় অবস্থানের কারণে ড. ইউনূস শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ভারত নানাভাবে বুঝিয়ে দেয় এ সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করতে আগ্রহী নয়।

ভারতের সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে সাউথ ব্লকের কর্মকর্তা, এমনকি গণমাধ্যম পর্যন্ত ড. ইউনূসকে ম্যান্ডেটবিহীন সরকারপ্রধান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত এ সরকারের সঙ্গে দুদেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে কোনো আলোচনাই হবে না। এমনকি বাংলাদেশের দিক থেকে যোগাযোগ করা হলেও ড. ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে বসতে পর্যন্ত রাজি ছিলেন না।

ভারতের কৌশল ছিল ড. ইউনূস সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে হাসিনা ও তার দলকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করা। হাসিনা ভারতের স্বার্থপূরণে যেসব অসম চুক্তি করেছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। একই সঙ্গে হাসিনা আমলের ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির ধারা যেন অব্যাহত রাখা যায়, সে জন্য নানামুখী তৎপরতা চালানো হয়। ড. ইউনূসের সরকার ভারতের এই চাপ এড়ানোর জন্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সেই পুরোনো কৌশল গ্রহণ করে। ক্ষুদ্র দেশগুলো হলো সমুদ্রে থাকা ছোট মাছের মতো। যেগুলো হাঙরের মুখে না পড়ার জন্য তার আশপাশে ঘোরাফেরা করে। অর্থাৎ সব বড় শক্তির সঙ্গে সে সম্পর্ক বজায় রাখে, যাতে কেউ গ্রাস করতে না পারে।

ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর এশিয়ার আরেক পরাশক্তি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। চীনে হাইনান প্রদেশে এক বাণিজ্য সম্মেলনে ড. ইউনূস বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাণিজ্য ও ব্যবসা সম্প্রসারণে সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নেপাল ও ভুটান স্থলবেষ্টিত দেশ, যাদের কোনো সমুদ্র নেই। ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যও স্থলবেষ্টিত। বাংলাদেশ এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক। তিনি এসব দেশের মধ্যে যোগাযোগ সংযোগ স্থাপনের ওপর জোর দেন, যা বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

তিনি বলেন, চীন এটাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারের কথা ভাবতে পারে। ড. ইউনূসের এই বক্তব্য ঘিরে ভারতে তোলপাড় শুরু হয়। ড. ইউনূসের এই বাণিজ্যনির্ভর আহ্বানকে ভারত দেখে নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকে। দিল্লির চীনাভীতি যেন প্রবল রূপ ধারণ করে। ৬২-এর যুদ্ধে অরুণাচল হারানোর দগদগে ক্ষত ভারতের নীতি নির্ধারকদের সব সময় তাড়া করে। এর আগে ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতীয় গণমাধ্যমকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে যেকোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে তার প্রভাব উত্তর-পূর্ব ভারতসহ পুরো অঞ্চলে পড়বে।

ড. ইউনূসের এই কূটনৈতিক কৌশল ভারতকে বাধ্য করে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। এই বক্তব্য রাখার এক সপ্তাহ পার না হতেই থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন মোদি-ইউনূস। এর আগে ভারতের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যম জানিয়েছিল, উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারত নাকি এতটাই ক্ষুব্ধ তার সঙ্গে বৈঠকে বসবেন না মোদি। তাহলে বৈঠকটি হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার কূটনৈতিক প্রতিবেদক অগ্নিরায়।

এই বৈঠকের কারণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ কথাটা স্পষ্ট করেই বলতে হচ্ছে, অনেক কাটাছেঁড়া বিচার-বিশ্লেষণের পর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্তটা কার্যত বাধ্য হয়ে শেষ মুহূর্তে নিতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি অনন্যোপায় হয়ে পড়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনীতি-নকশার সামনে। বিশ্লেষকরা বলেন, এটা আর অজানা নয় যে, এই অঞ্চলে যখন কোনো দেশের সরকার চীনের দিকে ঝুঁকতে উদ্যত হয় বা ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, এমনকি বাড়ানোর ভানও করে, ভারতের কালো ঘাম ছুটতে থাকে।

ড. ইউনূসের কূটনৈতিক কৌশল যে ভারতের কালো ঘাম ছুটছিল, তা বোঝা খুব কঠিন বিষয় নয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম মোদির সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক নিয়ে ফেসবুকে জানান, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এ ছাড়া শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যুতে কথা বলার সময় মোদি নেতিবাচক ছিলেন না।

সেই সঙ্গে প্রেসসচিব মোদিকে উদ্ধৃত করে লেখেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকাকালে আমরা আপনার প্রতি তার (হাসিনার) অসম্মানজনক আচরণ দেখেছি। কিন্তু আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছি।’

আনন্দবাজার পত্রিকার কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, ভারত ড. ইউনূসের সরকার গ্রহণযোগ্যতা পাক তা চায়নি। সে কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একসময় বৈঠকের আগ্রহ দেখানো হলেও তাতে সাড়া দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কখনো চাননি বৈঠকটি হোক। ভারতের গোয়েন্দা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবির সাবেক কর্মকর্তা অজিত দোভালকে অনেক ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর মনে করা হয়।

স্পাই মাস্টার হিসেবে তার অতি সফল একটি চরিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করে ভারতের গণমাধ্যম। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, “আসলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং তার বাহিনী গোড়া থেকেই চাইছিলেন না, মুহাম্মদ ইউনূসের মুখোমুখি হন নরেন্দ্র মোদি। তাদের মত ছিল, বৈঠকে বসলে সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার, যা করে চলেছে, তা এক ধরনের কূটনৈতিক মান্যতা পেয়ে যাবে। বৈঠকের পর নিজেরা কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করার সুযোগ পাবে।”

এই বৈঠক নিয়ে দিল্লির মধ্যে উদ্বেগ ও দ্বিধা থাকলেও ইউনূস ছিলেন একেবারেই সাবলীল। আগের অবস্থানেও ছিলেন অনড়। বৈঠকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হাসিনার বিচারের জন্য তাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি তিনি উত্থাপন করেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, ইউনূস মোদির কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘ইউনূস মোদির কাছে জানতে চেয়েছেন, আমরা হাসিনাকে যে ফেরত চাইছি, তার কত দূর!

আমরা জানি, তার ঘরোয়া রাজনীতির জন্য এই ভাষ্য তৈরি হয়েছে, কিন্তু এর প্রভাব ভারতের মতো বিশাল রাষ্ট্রের বাজার, রাজনীতি, ধর্মীয় বিভাজনে নানাভাবে পড়বে। অন্যদিকে, মোদি কাটা রেকর্ডের মতো পুনরাবৃত্তি করেছেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ। জানিয়েছেন, ভারত সে দেশে দ্রুত নির্বাচন চায়। কিন্তু এর কোনো পাথুরে প্রতিশ্রুতি ইউনূসের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে এমন খবর নেই।’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির এই বৈঠকে দুদেশের সম্পর্কে কতটা বরফ গলবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে ইউনূসের সফল চীনা কার্ডে ভারতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. ইউনূসের সঙ্গে মোদির বৈঠকের যে ভাষ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা দিল্লিতে পলাতক হাসিনার জন্য সুখকর নয়। হাসিনা ও তার পলাতক সহযোগীরা আশা করেছিলেন, এই বৈঠকটি হয়তো হবে না। ভারতের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশে তারা অস্থিরতা সৃষ্টির পুরোনো খেলা আবার নতুন করে শুরু করবেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হবে না।

ভারত অন্তত এই বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে আবার বাংলাদেশে পুনর্বাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর হাসিনা যে নিপীড়ন চালিয়েছেন, তা মোদিও স্বীকার করেছেন। এর মধ্য দিয়ে হাসিনার স্বেচ্ছাচার ও নিপীড়নমূলক শাসনের বিষয়টি স্বীকার করলেন মোদি। যদিও হাসিনার দেড় দশকের গুম, খুন ও নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যার দায় দিল্লি এড়াতে পারে না। প্রণব-মোদির সমর্থন নিয়ে হাসিনা দানব হয়ে উঠেছিলেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যদি সত্যিই সুসম্পর্ক চায়, তাহলে প্রথমে হাসিনার মুখ বন্ধ করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরুতেই তা দিল্লিকে জানিয়েছিলেন। মোদির সঙ্গে বৈঠকে হাসিনাকে ফেরত চেয়ে তিনি আবার জানিয়ে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে তিনি কতটা অনড়। তবে এই বৈঠকের পর পলাতক হাসিনা ও তার সহযোগীদের মধ্যে হতাশা আরো তীব্র রূপ নেবে। তিনি এখনো দম্ভভরে দেশে ফেরার ঘোষণা দিচ্ছেন। কখনো কবিতা আবৃত্তি করে সময় কাটাচ্ছেন। আবার পরিত্যক্ত আওয়ামী লীগ অফিস উদ্ধার করতে না পারার জন্য নেতাকর্মীদের দোষারোপ করছেন। এমনকি খুনের উসকানি দিচ্ছেন।

নেতাকর্মীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এই বাস্তবতা বোঝার সময় এসেছে। গণধিকৃত পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসকরা দেশে ফিরে আর রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে পারে না। বিদেশ হয় তাদের শেষ ঠিকানা। ৭০-এর দশকের ইদি আমিন থেকে ৯০ দশকের বেন আলি পর্যন্ত ইতিহাসে বহু শাসকের পরিণতি একই রকম। শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত একজন গণহত্যাকারী। এরপরও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকে আশা করে আছেন শেখ হাসিনা আবার দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসবেন। এই আশার অন্যতম কারণ হলো, শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন এবং দিল্লিতে তার অবস্থান। কিন্তু এই আশা যে পূরণ হওয়ার নয়, তার আলামত এখন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভারত বাস্তব কারণে হাসিনাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ

alfaz@dailyamardesh.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত