Ad T1

সিরিয়া পেরেছে আমাদেরও পারতে হবে

মেহেদী হাসান
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ১৩

প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের তালিকায় ২০২৪ সালে বর্ষসেরা দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিরিয়া। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনা, এই দুই কুখ্যাত শাসকের পতনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। সিরিয়ায় আসাদের পতন হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে। অন্যদিকে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে ১৫ বছরের টানা দুঃশাসনের ফলে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে তৈরি আকস্মিক এক গণঅভ্যুত্থানে।

ইকোনমিস্ট সিরিয়ার পরিবর্তে যে কারণে বাংলাদেশকে বর্ষসেরা হিসেবে মনোনীত করে তা হলো অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে বিদ্যমান স্থিতিশীল পরিবেশ এবং সমৃদ্ধির পথে যাত্রা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাসের মাথায় বাংলাদেশে রব ওঠে বিপ্লব হাতছাড়া হওয়ার। নতুন করে বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের মনে আবার জমা হতে থাকে তীব্র ক্ষোভের আগুন। তরুণ ছাত্র-জনতার এত আত্মত্যাগ বিফলে যাওয়ার উপক্রম হয় সরকারের ব্যর্থতা আর রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লোভের কারণে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের যে গণআকাঙ্ক্ষা, তা ক্রমেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে থাকে বাংলাদেশে।

অন্যদিকে সিরিয়ায় আসাদের পতন হলেও চারদিকে ছিল তীব্র বিষাদের ছায়া। আসাদ পতনের পরও ইসরাইল টানা এক সপ্তাহ পর্যন্ত ধ্বংসাত্মক হামলা চালাতে থাকে সিরিয়ায়। দখল করে নেয় দেশটির একটি অংশ। সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে নতুন করে গৃহগযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আসাদের পতন হলেও সিরিয়ার উত্তরে দুটি বড় এলাকা দখলে রাখে দুটি বিদ্রোহী বাহিনী। তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আসাদ পতনের পর। এর পাশাপাশি সিরিয়ায় উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি।

সিরিয়ার অর্থনীতি বলতে কিছু ছিল না আসাদের সময় থেকেই। বিদ্রোহীরা আসাদকে যুদ্ধ করে ক্ষমতা থেকে হটালেও তারা কেউ সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার চেয়ারে বসেনি। কারণ, প্রধান বিদ্রোহী দল হায়াত তাহরির আল শামের রয়েছে অতীতে আল-কায়েদাসংশ্লিষ্টতা। হায়াত তাহরির আল শামের প্রধান আহমেদ আল শারার বিরুদ্ধে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যুপরোয়ানা। তার নেতৃত্বেই পতন ঘটে আসাদের। যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্বের অসংখ্য অবরোধ রয়েছে সিরিয়ার বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে আসাদ পতনের পর সিরিয়ায় কী হতে যাচ্ছে, তা কেউ সহজে অনুমান করতে পারছিল না। ফলে আসাদ পতনের মতো এত বড় ঘটনার পরও খুব বেশি মানুষকে রাজপথে নেমে আনন্দ-উল্লাস করতে দেখা যায়নি । ছিল ভীতি আর আতঙ্ক।

চারদিকে যখন এই অনিশ্চয়তা আর হতাশা, তখন ২৯ জানুয়ারি সিরিয়ায় ঘটল আরেক বৈপ্লবিক ঘটনা। এদিন সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সব সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপের নেতারা একত্র হয়ে আহমেদ আল শারাকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। শারাকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণার পর তারা বিলুপ্ত ঘোষণা করল সিরিয়ার সংবিধান, আর্মি, পুলিশসহ সমস্ত গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা। একই সঙ্গে তারা বিলুপ্ত ঘোষণা করল নিজেদের বাহিনীগুলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন এখন থেকে সিরিয়ান আর্মি, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, গোয়েন্দাসহ যাবতীয় নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হবে আসাদবিরোধী বিদ্রোহী যোদ্ধাদের নিয়ে।

সিরিয়ায় সূচনা হলো এক নতুন যুগের, নতুন অধ্যায়ের। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সম্ভাবনার এক নতুন সিংহদুয়ার খুলে গেল সিরিয়ায়। হাফিজ আল-আসাদ ও বাশার আল-আসাদ বাব-ছেলের টানা ৫৩ বছরের দুঃশাসনের সমস্ত ধ্বংসস্তূপকে পেছনে রেখে সম্পূর্ণ নতুন এক সিরিয়ার যাত্রা ঘোষণা করলেন বিদ্রোহী নেতারা।

সিরিয়ায় ৮ ডিসেম্বর বাশার আল-আসাদের পতন ঘটলেও একটি বিপ্লবী সরকার গঠিত না হওয়ায় পূরণ হচ্ছিল না সেখানে বিপ্লবের শর্ত। অবশেষে ২৯ জানুয়ারি সিরিয়ায় পূর্ণতা পেল সশস্ত্র বিপ্লব। বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে যারা, তাদের নেতৃত্বে এবং তাদের সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমেই গঠিত হলো একটি বিপ্লবী সরকার।

অন্যদিকে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের মনে খুশির আনন্দধারা বইতে থাকলেও দ্রুত তা ভিন্নদিকে রূপ নিতে থাকে। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতার আরেকটি কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে সেনাপ্রধানের অফিস। দেশবাসীর সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়, শেখ হাসিনার পতন হলেও সর্বত্র রয়ে গেছে ফ্যাসিবাদের দোসররা। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু।

অন্যদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের পক্ষ থেকে পতিত ফ্যাসিস্ট দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেওয়া হলো গণঅভ্যুত্থানের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই। একই সময় প্রধান দলটি অবস্থান নিল ফ্যাসিবাদী সংবিধান বাতিলের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেসিডেন্টকে অপসারণের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিল তারা। আরেকটি দলের প্রধানের পক্ষ থেকে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা এলো একদম শুরুতে। ভারত ও আওয়ামী লীগ প্রশ্নে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের এ অবস্থান নড়বড়ে করে দেয় জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে।

বিপ্লবকে সফল করার শর্ত হলো পুরোনো গণবিরোধী আর অভিশপ্ত সমস্ত ব্যবস্থা ও কাঠামো বাতিল করে গণআকাঙ্ক্ষার অভিপ্রায় অনুযায়ী সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা, নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ করা। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানকে সফল বিপ্লবে পরিণত করার জন্য অপরিহার্য ছিল শেকড়সহ ফ্যাসিবাদ নির্মূলের অভিযান পরিচালনা। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনোটাই হয়নি। এ অবস্থায় গর্ত থেকে আবার মাথা তুলতে শুরু করে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী।

ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফরের পরপরই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার থেকে একপর্যায়ে সরকারের সরে আসার মাধ্যমে সর্বশেষ প্রমাণিত হয়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লব আসলে ছিনতাই হয়ে গেছে।

সিরিয়া মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সফল বিপ্লবের শর্ত পূরণ করে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারলেও বাংলাদেশে সেটি সম্ভব হয়নি। ছয় মাসের মাথায় এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার সম্ভাবনাও হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সিরিয়ার মতো যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন না হলেও স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানকে একটি সফল বিপ্লবে রূপ দেওয়া অসম্ভব ছিল না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম সারির রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে যে দেশপ্রেম, সততা, আন্তরিকতা আর বিচক্ষণতার প্রয়োজন ছিল, তার নিদারুণ অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তীব্র গণরোষের আকস্মিক বিস্ফোরণে শেখ হাসিনার পলায়নের পর ছাত্র-জনতা ছিল অনেকটা দিশাহীন। তারা সহায়তা চেয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কিন্তু তারা সেভাবে সহায়তার হাত বাড়াননি ।

উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকার। ...জাতীয় সরকার অনেক দিন স্থায়ী হবে এই বিবেচনায় বিএনপি জাতীয় সরকারে রাজি হয়নি।’

শুরুতেই ছাত্রনেতাদের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক নেতাদের অসহযোগিতার কারণে নতুন সরকার গঠনের আগেই ছিনতাই হয়ে যায় বিপ্লব। সক্রিয় ওয়ে ওঠে হাসিনার দোসররা। বিপ্লবোত্তর সরকার গঠন নিয়ে শুরু হয় নানামুখী ষড়যন্ত্র এবং এতে সফল হয় তারা। ব্যর্থ হয়ে যায় গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায় অনুযায়ী একটি প্রকৃত বিপ্লবী সরকার গঠন।

জাতীয় সরকার গঠনে অনীহা, এরপর ফ্যাসিবাদীদের সংবিধান রক্ষা, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না চাওয়া ও তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো। এ ছাড়া ভারত এবং রাষ্ট্রপতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতারা যে অবস্থান নিয়েছেন, তাতে এটি প্রমাণিত, তাদের কাছে দেশের চেয়ে দল বড়।

ছাত্রনেতারা তরুণ, অনভিজ্ঞ- ফলে তারা ভুল করতেই পারেন। কিন্তু তারপরও যে সরকার গঠিত হয়েছিল, তাদের সঠিক পথে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যে ভূমিকা পালনের প্রয়োজন ছিল, তা তারা করেননি। এ অবস্থায় গত অক্টোবর মাসে সংবিধান বাতিল এবং রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে নতুন করে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের সুযোগ সামনে এলেও তা সম্ভব হয়নি বিএনপির পক্ষ থেকে বিরোধিতার কারণে।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবী চেতনা আর গণআকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে ন্যূনতম একটি সংস্কার শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা এখন রাজনীতিবিদদের মূল চাওয়া। এ অবস্থায় আবার পুরোনো বৃত্তে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে চারদিকে।

গণঅভ্যুত্থানের ঠিক ছয় মাসের মাথায় ৫ আগস্টের মতো আরেকটি স্বতঃস্ফূর্ত আর আকস্মিক ঘটনার জন্ম নিল ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে। ফ্যাসিবাদীদের আস্ফালনের প্রতিক্রিয়ায় ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গুঁড়িয়ে দিয়েছে ফ্যাসিবাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর বাড়ি। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সুযোগ এভাবে আবার জাতির সামনে হাজির হবে, তা কেউ যেন কল্পনাও করতে পারেননি। ৫ ফেব্রুয়ারি অপূর্ব এক মিলন ঘটিয়ে দিল ৫ আগস্টের সঙ্গে। আবার জেগে উঠল বিপ্লবীরা।

এখন সময় এসেছে শুধু ফ্যাসিবাদের প্রতীক নয়, বরং ফ্যাসিবাদের দোসরদের সব জায়গা থেকে উৎখাত করে একটি প্রকৃত বিপ্লবী সরকার গঠনেরও অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। বিপ্লবকে আর ঘুমাতে দেওয়া যাবে না। সুযোগ বারবার আসে না। এবারও যদি আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহারে ব্যর্থ হই, তবে জাতির জীবনে আবার নেমে আসতে পারে বড় কোনো দুর্ভাগ্য। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। এ দুই অপশক্তি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে না পারলে ব্যর্থ হয়ে যাবে সব ত্যাগ।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত