Ad T1

অন্যরকম এক রমজানে তারা উল্লসিত

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৬: ৪১
গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান-উত্তর বাংলাদেশে অন্যরকম এক রমজান পালিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের স্বতঃস্ফূর্ত ইফতার সামগ্রী বিতরণের যে দৃশ্য আমরা দেখছি, তা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কল্পনাও করা যায়নি। তখন যা কিছু পালিত হয়েছে, তা ছিল ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিগত ১৫ বছরে এত প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর ক্যাম্পাস কখনোই ছিল না। চির যৌবনপ্রাপ্ত ক্যাম্পাসগুলো তারা প্রাণহীন অবরুদ্ধ এলাকায় পরিণত করেছিল।
কয়েক দিন ধরে দেখছি, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ছাড়াও অন্যান্য ছত্রসংগঠন ইফতারি বিতরণ করছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের ব্যাপক ইফতারি বিতরণ সর্বমহলের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। এটা এ কারণেই যে, শিবির অতীতে এই ক্যাম্পাসে এ রকম মুক্ত পরিবেশ আর কখনো পায়নি। ফুটেজগুলো দেখে মনে হলো, সত্যিকারের এক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে। এ দৃশ্য আমাদের উৎসাহিত করে এই ভেবে, ছাত্ররা ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে মেধাতন্ত্রকে প্রাধান্য দেবে। চীনের বর্তমান অভাবিত উন্নয়নের পেছনে রয়েছে মেধাতন্ত্রের সর্বোচ্চ প্রাধান্য প্রদান। অতীতের ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির তিক্ত ইতিহাস কখনোই সুখকর ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবে আজ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জাতির মোড় ঘোরানো সব আন্দোলনের সূতিকাগার হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য; তেমনি অনেক বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষীও এই বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে আসছে। দশকওয়ারী ভাগ করে বিশ্লেষণ করলে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে, তাতে সুখ ও বঞ্চনা দুটোই আছে। তাই আমরা দেখতে পাই, ত্রিশের দশকে ক্যাম্পাস ভালোভাবে চললেও চল্লিশে দশকের শুরুতে ১৯৪৩ সালে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে একটি দাঙ্গা সংঘটিত হওয়ার ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করেছিল। কারণ ওই বছরেই বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যাতে ৩০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল না খেয়ে।
তবে ওই ৪০-এর দশকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ, ৯০-এর এরশাদ পতন এবং সর্বশেষ ২৪-এর ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবজনক অধ্যায়ের সংযোজন ঘটিয়েছে। আবার ঠিক উল্টোদিকে ষাটের দশকে মুসলিম লীগের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গুন্ডাতন্ত্রের সূচনা করেছিল, তা স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে ভয়ংকর রূপ লাভ করেছিল। তাই ৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে হারার ভয়ে ছাত্রলীগ ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে। ফলে নির্বাচনের ফলাফল আর প্রকাশিত হয়নি। অথচ আইয়ুব খানের আমলেও ডাকসু নির্বাচন কখনো এভাবে স্থগিত হয়নি। ৭৩ সালে যদি ডাকসু নির্বাচন ঠিকমতো হতো, তাহলে পরে ক্যাম্পাসগুলোয় অন্যরকম এক পরিবেশ বিরাজ করতে। এদিকে শুধু ৭৩-এর ডাকসু নির্বাচন বানচাল নয়, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল এক গ্রুপ গভীর রাতে অন্য এক গ্রুপের সাতজনকে মহসীন হলে গুলি করে হত্যা করে সৃষ্টি করেছিল এক কলঙ্কিত ইতিহাস। তখন সে ঘটনায় দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যানার হেডিং ছিল এ রকম : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড’।
রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে তখন মেলা মেলা চলছিল। আমি তখন ওই মেলায় একটি রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রাত সাড়ে ১২টা কিংবা ১টার দিকে গুলির শব্দ শুনে আমরা আঁতকে উঠলাম। মেলার সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমরা কী করবে ভাবছিলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ দেখি গুলজার নামে ছাত্রলীগের এক নেতা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমাদের হোটেলে এসে ধপাস করে চিয়ারে বসল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। গুলজারের সঙ্গে আগে থেকেই আমার পরিচয় ছিল। ঠোঁটকাটা গুলজার বললে সবাই তাকে চিনত। তার কাছে শুনলাম পুরো কাহিনি। অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা কোহিনুরের নিহত হওয়ার কথা শুনে মনে হলো আমরা সবাই নিয়তির হাতে বন্দি। কারণ দুপুরে তাকে দেখেছিলাম গুলিস্তানে হকারদের ওপর মাস্তানি করত। আর দিন শেষে রাতে রক্তাক্ত শরীরে মহসীন হলের ফ্লোরে নিশ্চুপ, নিথর।
আবার ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশাল ভূমিকা করে। কিন্তু ৮০-এর দশকজুড়ে ক্যাম্পাস ছিল অগ্নিগর্ভ। সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই থাকত। অহরহ গোলাগুলি চলত। বোমা বিস্ফোরণে উদীয়মান ছাত্রদল নেতা বাবলুর নিহত হওয়ার ঘটনা সবাইকে ব্যথিত করেছিল। তার ভাই নীরু এখন বিএনপি নেতা। তারা দুভাই পরিচিত হয়ে উঠেছিল নীর-বাবলু যুক্ত নামে। ৮৭ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শহীদের হত্যাকাণ্ড। পাগলা শহীদ হিসেবে সে পরিচিত ছিল। ক্যাডার রাজনীতির নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হয়েছিল সেই তরুণ ছাত্র। অন্যদিকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালে ক্যাম্পাসে ছিল না কোনো রাজনৈতিক তৎপরতার সুযোগ। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ করে না এমন ছাত্রের জন্য ক্যাম্পাস নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্রদল’ তো গত ১৫ বছর ক্যাম্পাসে দাঁড়াতেই পারেনি।
ঠিক এ রকম একটি পটভূমিতে জুলাই বিপ্লব-উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে নবীন প্রাণের উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে হয়তো আশার আলো আছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতির চর্চা না করে পরস্পরকে অভিযুক্ত করার পুরোনো পথ অনুসরণ করলে আবার তিমিরে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই গেছে।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত