Ad T1

বাঙ্গলাদেশের নববর্ষ

ড. আহমদ আনিসুর রহমান
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ৪৭
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৩: ৩২
ইতিহাসে বাঙ্গলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে এমন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ষগণনা পদ্ধতি চালু হয়, যা এখনো, মূল- বা কমবেশি পরিবর্তিত রূপে বাঙ্গলাদেশে প্রচলিত রয়েছে। তবে, তার কোনোটিই আজকে বাঙ্গলাদেশের যে ভূখণ্ড, তাতে সূচিত হয়নি, বাঙ্গালী জাতির মতোই।
দুনিয়ার সব জাতির মতোই বাঙ্গালীরাও মূলত যাযাবর হওয়ার কারণে আজ যেখানেই বসতি করে থাকুক না কেন, সেখানে মূলত অভিবাসী। সে কারণে, সত্যিকার অর্থে কোনো জায়গাতেই ‘আদিবাসী’ বলে কিছু নেই। সব জাতি ও জনগোষ্ঠীই অতীতে দেশ থেকে দেশান্তর হয়ে একসময় তাদের বর্তমান নিবাসে এসে পৌঁছেছিল। এই দীর্ঘ সফরে তাদের অদৃশ্য, মনোজাগতিক মূল্যবোধ ও ব্যঞ্জনাময় প্রকাশ্য আচার-ব্যবহারের সমষ্টি যে তার নিজস্ব স্বকীয় সংস্কৃতি, তার বিবর্তনে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটনা চক্রে কোনো এক বা অন্য জায়গায় ওই সংস্কৃতির কোনো একটির উদ্ভব বা তাতে সংযোজন ঘটেছে।
বাঙ্গলাদেশেরও প্রধান জনগোষ্ঠী নিয়ে যে, ‘বঙ্গাল’, ‘বঙ্গলা’, ‘বাঙ্গলা’, ‘বাঙ্গাল্যা’, ‘বাঙ্গালীয়া’, বা ‘বঙ্গালী’- জাতি, তার বেলাও তাই। খোদ বাঙ্গালীরা প্রাচীন আরব্য উপদ্বীপের দক্ষিণের ‘ইয়েমেন’ (আক্ষরিক অর্থেই, ‘দক্ষিণ’) প্রাচীন অনার্য ক্বাহত্বানী আরব জনগোষ্ঠী থেকে উৎসারিত হয়ে তারই এক অধস্তন শাখা, অনার্য দ্রাবিড় হিসেবে-সিন্ধু, দাক্ষিণাত্য হয়ে আজকে বাঙ্গলাদেশ পরিচিত ভূখণ্ডে এসে বাঙ্গাল, বাঙ্গালা বা বাঙ্গালী জাতি রূপে বিবর্তিত-রূপান্তরিত হয়ে, কালে এই দেশকে বাঙ্গাল বা বাঙ্গালার দেশ, তথা বাঙ্গালা বা বাঙ্গালা দেশ বলে পরিচিত করে তোলেন।
আর একইভাবে, তাদের বর্তমানের বর্ষগণনার তিন প্রচলিত রীতির তিনটিই মূলত বাঙ্গলাদেশের বাইরে সূচিত হয়ে, ঐতিহাসিক কালপরিক্রমায় বিভিন্ন পর্যায়ে সেসব বাঙ্গলাদেশে প্রচলিত করা হয়।
বাঙ্গলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত এই তিনটি আলাদা আলাদা বর্ষগণনা রীতির প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন বর্ষশুরু দিবস, তথা ‘নববর্ষ’ রয়েছে। প্রথমটির নববর্ষ হলো, মহররমের ১লা তারিখ, দ্বিতীয়টির হলো বৈশাখের ১লা, আর খ্রিষ্টাব্দের হলো ১লা জানুয়ারি। এর প্রথম দুটি ঐতিহাসিকভাবে, একপর্যায়ে বাঙ্গলার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে পড়লেও, তৃতীয়টি তা হতে পারে না, নানা কারণে। তাই প্রথম দুটির পালন বাঙ্গালীর জন্য ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক। তৃতীয়টির ঘটা করে পালন, বাঙ্গালীর জন্য ঐতিহ্যবিরোধী নব্য-উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী অপসংস্কৃতিমূলক বলে পরিহার্য।
অনুমেয়, বাঙ্গালীদের আদি উৎস আরব্য উপদ্বীপের প্রধান বংশপতি ‘শাম’ বা ‘সেম’-এর সন্তান অনার্য ‘সেমেটিক’ বা ‘শ্যামল’-জাতি তাদের সন গণনায় তাদের আদি সংস্কৃতির স্পৃহায় চান্দ্র সনকেই অনুসরণ করতেন।
উত্তর ভারতীয় ‘বিক্রমী’ সৌর-সন
তাদের প্রতিপক্ষে, শামের ভাই ইয়াফেসের সন্তান পরম্পরায় যে তুলনামূলক শ্বেতাঙ্গ, আর্য জাতির উদ্ভব হয়- কালক্রমে তারা উত্তরদিকে সরতে সরতে প্রচণ্ড শীতপ্রধান এলাকাগুলোয় বসত করতে গিয়ে একসময় শৈত্যনিবারক উত্তাপের উৎস আগুন আর তার উৎস বলে কল্পিত সূর্যের উপাসনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লে, তার প্রভাবে সৌর সনে সন গণনা করেন।
কোনো এক প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে, আর্যদের দখলে নেওয়া উত্তর ভারতে ‘দেবতা’ বলে গণ্য করা রাজা রামের বংশধর বলে কল্পিত উজ্জয়নীর ‘সম্রাট’ বিক্রমাদিত্যের ৫৭ খ্রিষ্টপূর্ব সনে সিংহাসনে আরোহণের সন থেকে গণ্য করে ‘বিক্রমী’ সৌর সন চালু করা হয় । যেসব ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক শাসকরা আজকের বাঙ্গলাদেশের কোনো এলাকা দখল বা শাসন করে, তারা ‘বিক্রমী’ সন ব্যবহার করত ।
বাঙ্গলাদেশের প্রান্তিক সীমান্ত অঞ্চলেই শুধু হলেও-আজকের বাঙ্গলাদেশের ভূখণ্ডের কোনো এক জায়গায় তার প্রথম প্রচলন করেছিলেন সপ্তম শতাব্দীতে, মূলত উত্তর ভারতের মগধ তথা বিহারের এক সামন্ত অর্থাৎ জমিদার। তিনি কোনোক্রমে বৃহত্তর বাঙ্গলার বর্তমানের মুর্শিদাবাদের কিঞ্চিৎ দখল করে পদ্মা ও ভাগীরথীর মধ্যবর্তী এক চিলতে জমি যা গৌড় বঙ্গ বলে পরিচিত ছিল-তার রাজা বনে বসে উত্তর ভারতের আর্যাবর্তের রাজা বলে কল্পিত বিক্রমাদিত্যের সিংহাসন আরোহণের সন থেকে বর্ষগণনামূলক ‘বিক্রমী’ সন চালু করেন। নিজেকে অনার্য বঙ্গালদের বাঙ্গলাদেশের ‘মহারাজ’ সাজানোর স্বার্থেই হয়তো মগধের এই বিহারী সামন্ত বাঙ্গলাদেশের সীমান্তে মাত্র এক চিলতে জমি দখল করে তার কালে গড়ে তোলা মূলত ও প্রধানত বাঙ্গলাদেশের বাইরে–উত্তর ভারতের বিশালতর সাম্রাজ্যের এই মূলত সূর্যপূজাভিত্তিক আর্য-ভারতীয় বর্ষ গণনা রীতিকে ‘বঙ্গাব্দ’ বলে চালাতে চেষ্টা করেন। যদিও অনার্য বঙ্গালরা তা মনেপ্রাণে গ্রহণ না করার কারণেই বিজাতীয় আর্যভারতীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তার কিছুটা মেনে নিলে নিজেদের উৎসবাদির অনেক কিছুতেই ধরে রাখে চান্দ্র হিসাব ।
উত্তর ভারতে আর্য দখলদার শাসকরা কর্তৃক প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এই সনের মাস গণনা হয় পূজিত সূর্যের কক্ষ প্রদক্ষিণের হিসেবে। এই আর্য ভারতীয় সৌর সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয় পূজিত সূর্য প্রদক্ষিণরত বিভিন্ন গ্রহের অবস্থানের ভিত্তিতে, আর মাসের, সপ্তাহের দিনগুলোর নাম করা হয় ওইসব গ্রহের নামে। এভাবে প্রাচীন বাঙ্গলাদেশের ভারত সীমান্তবর্তী এক চিলতে জমিতে সামীয় দ্রাবিড় আদি বাঙালিদের চাঁদের হিসাবে মাস ও সন গোনার রীতির পরিবর্তে আর্য-ভারতীয় এক ঔপনিবেশিক দখলদার সাম্রাজ্যবাদী শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সৌর সন ও সূর্য ও গ্রহ পূজারি ধর্মাবলম্বনে সূর্যকেন্দ্রিক কক্ষপথে গ্রহাবস্থানভিত্তিক মাস ও দিনের হিসাব চাপিয়ে দিয়ে তাকে ‘বিক্রমী’ সন বা তথাকথিত বিক্রমাদিত্যের নিজেকে বঙ্গরাজ দাবি করে ‘বঙ্গাব্দ’ বলে প্রচলিত করা হয়।
স্বাধীন বাঙ্গলাদেশের মূল নববর্ষ
১৩৪৩ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গালদের নিজস্ব স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে, অনার্য এই মেকি ‘বঙ্গাব্দ’ বাদ দিয়ে তাদের আদি সংস্কৃতির স্পৃহায় চান্দ্র সনকেই প্রচলিত করেন, যা পরে একসময় নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে একটি আসল ‘বঙ্গাব্দ’ রীতির জন্ম দেয় আরো কয়েক শ বছর পর। সে কথায় আবার পরে আসা যাবে।
এই সৌর-গ্রহ পূজামূলক বিহারী-মগধী তথাকথিত ‘বঙ্গাব্দ’ আসল বাঙ্গালীরা আসলে মেনে নিতে পারেনি। মাস আর দিনের নামে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও, তাদের প্রধান পূজা-পার্বণ চাঁদের হিসেবেই করতে থাকে। বাঙালিরা প্রধানত ছিলেন জৈন-বৌদ্ধ– তারা তাদের প্রধান উৎসব, যথা বুদ্ধপূর্ণিমা, চাঁদের হিসাবেই করা হয়। আজও।
আজকের যে এলাকা নিয়ে বাঙ্গলাদেশ, তার সবটুকু নিয়ে আর বাঙ্গলা নামে, প্রথম যে দেশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ছিল বাঙ্গলার ও বাঙ্গালীদের প্রথম স্বাধীন শাসক, ‘বাঙ্গালীদের সুলতান’ বলে ঘোষিত, সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ কর্তৃক ঐক্যবদ্ধ করা ও ঐক্যবদ্ধভাবে স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতি হিসেবে ১৩৪২ খ্রিষ্টাবব্দে প্রতিষ্ঠিত ও সোনারগাঁ থেকে শাসিত বাঙ্গলা। মুসলিমশাসিত সুলতানাত বলে সরকারিভাবেই তার বর্ষপঞ্জি ছিল দুনিয়ার তাবৎ মুসলিমশাসিত এলাকা ও দেশের মতোই, খলিফা হজরত ওমর কর্তৃক নবীজির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুনিয়াতে ন্যায়বিচারমূলক শাসনের নজির প্রতিষ্ঠার জন্য মক্কা শরিফ ছেড়ে মদিনা শরিফ এসে তার সূচনামূলক ‘হিজরত’-এর সনকে প্রথম সন ধরে প্রচলিত করা হিজরি সনের বর্ষপঞ্জি। তাতে মূলত নববর্ষ হিসেবে ভাবগম্ভীরভাবে পালিত হতো, ১লা মহররম। সম্ভবত তারই প্রভাবে ঐতিহাসিকভাবে বাঙ্গলাদেশেরই সাংস্কৃতিক বিস্তৃতিরূপ মালয়জগৎ- আজকের মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার ‘চাম’ এলাকা ও দক্ষিণ ফিলিপাইন– সেসব জায়গায় আজও ১লা মহররম, এক ধরনের নববর্ষ হিসেবে পালিত হয় । এখনো প্রতিবছরই সে এলাকা থেকে আমার কোনো কোনো ছাত্র ১লা মহররমে আমাকে নববর্ষের ‘সালাম’সংবলিত খুদেবার্তা ইত্যাদি পাঠায়।
কিন্তু সালতানাত রূপে স্বাধীন বাঙ্গলা প্রতিষ্ঠার প্রায় পৌনে তিন শ বছর পর সেই আদি বাঙ্গলার পরিস্থিতি কিছু বদলালে বাঙ্গলার নববর্ষ পালনেও কিছু পরিবর্তন আসে। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে। তখনকার ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বাঙ্গলার স্বাধীন সালতানাতের স্বাধীনতার ক্ষয় শুরু হয়। বিশেষ করে, সেই সাম্রাজ্যের সম্রাট আকবরের অধীনে। তার সেনাপতি মানসিংহের চরম বাঙ্গলাবিরোধী আগ্রাসনের মুখে। আর বাঙ্গলার সেই স্বাধীনতা ক্ষয়ের মুখে বাঙ্গলাদেশের অনেক জায়গাই ক্রমে ভারতীয় সাম্রাজ্যের দখলে নিপতিত হয়। ফলে বাঙ্গলাদেশে সেসব জায়গা থেকে লুট করে যে খাজনা ভারতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হতো ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী সরকারের।
সেকালে সুলতানি শাসনের আমল থেকে বাঙ্গলাদেশে আর ভারত, দুখানেই যেভাবে চান্দ্র হিজরি সন অনুযায়ী সরকারি কাজকর্ম চলত, তাতে হাজার মাইল দূরে বসে আর সেখান থেকে এসে বাঙ্গলায় খাজনা লুটতে ভারতীয়দের অসুবিধা হতো। এই খাজনা লুটা সর্বোচ্চ পরিমাণ দক্ষতাসহ করা যেত না । কেন না চাঁদের হিসাবে মাস-তারিখের হিসাব রাখলে ধান কাটা, ফসল তোলা কখনো প্রথম মাস, মহররমে হতো। কখনো তা হতো দ্বিতীয় মাস, সফরে। কখনো, তার পরের মাস, রবিউল-আউয়ালে। এর ফলে বাঙালি কৃষক কখন ধান কেট ফসল তুলে বিক্রি বা দান করে দেওয়ায় খাজনা আদায়ের জন্য কিছুই থাকবে কি না, তার হিসাব রাখা মুশকিল হয়ে যায়। আর সে হিসাব না রাখতে পারলে দিল্লি আগ্রা থেকে এসে সর্বোচ্চসম্ভব খাজনা লুট করা হয় আরো কঠিন।
এ জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাঙ্গলাদেশে প্রচলিত চান্দ্র সনের পরিবর্তে সৌর সন চালুতে আগ্রহী হয়। এর জন্য ১৩৪২-এ সালতানাত হিসেবে স্বাধীন বাঙ্গলার প্রতিষ্ঠার আগে যে ভারতীয় ‘বিক্রমী’ সৌর সনকে ভারত-বাঙ্গলা সীমান্ত অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে এক সীমিত চিলতেতে ‘বঙ্গাব্দ’ বলে চালু করেছিল, তাকেই পুনরুজ্জীবিত করে বাঙ্গলাদেশে ভেতর তাদের দখলীকৃত সব জায়গাতেই চালু করাটা হতো সবচেয়ে সহজ। জনবিরোধিতার মুখোমুখি না হলে।
কিন্তু তিন শতাব্দীর অধিক ধরে মুসলিম সালতানাত হিসেবে বিকাশমান থাকা বাঙ্গলাদেশে কিন্তু এত দিনে মুসলিম চেতনা ও ইসলাম ধর্মের শেকড় এতই গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল যে নবীজির (দ.) স্মৃতিবাহী হিজরি সনকে হটিয়ে তার জায়গায় সূর্য ও গ্রহরাজি-পূজারি শশাঙ্ক ‘বিক্রামাদিত্য’-এর ‘বিক্রমী’ বা তথাকথিত ‘বঙ্গাব্দ’ সৌর সন জনগণকে গেলানো সম্ভব ছিল না।
হিজরি সৌর সন, নতুন বাঙ্গলা সন
তাই, তখন ভারতীয় মুঘল সাম্রাজ্য বাঙ্গলাদেশে খাজনা আদায়ের জন্য সৌর সন চালুর জন্য আরেকটি বুদ্ধি করে। তারা আর্য-ভারতীয় বিশ্বাসে ভবগবান বলে পূজিত রাজা শ্রী রামের অধস্তন পুরুষ বলে কল্পিত আর্যদের দখল করা উত্তর ভারতের উজ্জয়নীর রাজা বলে বিক্রমাদিত্যের ৫৭ খ্রিষ্টপূর্বে সিংহাসন দখলের সনকে ভিত্তি না করে– তত দিনে প্রধানত মুসলিম সালতানাত বলে বিকশিত বাঙ্গলাদেশে নবীজির (দ.) হিজরতের যেই সনকে ভিত্তি করে হজরত ওমর (রা.) কর্তৃক প্রচলিত যে চান্দ্র হিজরি সন সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ও জনমন নন্দিত, তাকেই ভিত্তি করে একটি সৌর হিজরি সন চালু করে।
শিয়া ইরানি মাতৃজাত ভারতীয় মুঘল ‘সম্রাট’ আকবর তার নিজের সূচিত নতুন সাম্রাজ্যবাদের বাঙ্গলায় প্রসার ও লুণ্ঠনের স্বার্থে, ভারতে এসে তার উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যোগ দিয়ে ‘আমীর’ হয়ে বসা শিয়া ইরানি জ্যোতিষ-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতহুল্লাহ শিরাজীকে দায়িত্ব প্রদান করেন-বাঙ্গলাদেশের দখলীকৃত এলাকা থেকে স্থানীয় ধর্মপ্রাণদের ধর্মানুভূতিতে নেতিবাচক উসকানির উদ্রেক না করেই যতখানি যেভাবে পারা যায় খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার । ফতহুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশ অনুযায়ী, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে, পারস্যে প্রচলিত ফারসি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরি সনে হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করা হয়। তবে আত্মপ্রেমিক আকবর তার গণনা যখন থেকে তা শুরু করা হয়, তখন থেকে না করে ২৯ বছর আগে তার নিজের সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এই সন গণনা প্রচলনের ‘হুকুম’ দেন। এ জন্য আকবর প্রবর্তিত ওই সন গণনা ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে গণনা শুরু হয়।
পহেলা বৈশাখে নববর্ষ
মুঘল আকবরের অধীন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বাঙ্গলাদেশে খাজনা লুটের স্বার্থে সৃষ্ট সেই নতুন বর্ষ গণনারীতিতে মাসগুলোর প্রথমে যেসব নাম দেওয়া হয়েছিল, তা আর্য পারস্যিক অগ্নি-উপাসক দ্বৈতেশ্বরবাদী ধর্মের কল্পিত তথাকথিত ‘মঙ্গল-খোদা’-এর কাজকর্মের সহায়করূপ নানা কল্পিত পাতি-‘খোদা’ সবের নামে করা হয়েছিল বলে, বাঙ্গলাদেশের একশ্বরবাদী অনার্য দ্রাবিড় জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, বলে পরে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তা বদলানো হয়।
আকবর প্রবর্তিত ওই সন গণনা ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে গণনা শুরু হয়। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম হওয়ায়, এই সৌর হিজরি সনকে মহররম মাস থেকেই গণনা শুরু করা হয়। কিন্তু সৌর হিসেবে গণনা করা সনের মাসগুলোকেও চান্দ্র হিসেবে গণনা করা সনে মাসগুলোর নামেই নাম দিলে, রমজান ও হজের মতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক সব কাজে যে চান্দ্র হিজরি সনের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ ধর্মত বাধ্যতামূলক– সাধারণ মানুষের মনে একই নামের ভিন্ন ভিন্ন দিনে শুরু হওয়া একই নামের চান্দ্র আর সৌর হিজরি মাসগুলোর সূচনার দিনগুলো নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে ধর্মপালনে গণ্ডগোল লেগে যাওয়ার ভয়েই হয়তো তখন সৌর হিজরি সনের মাসগুলোর নাম আর মূলত চান্দ্র হিজরি মাসের নামে ডাকা হয়নি। বরং বা বাঙ্গলাদেশসহ উপমহাদেশে আগে থেকেই সৌরবর্ষের মাসগুলোর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যেসব নাম মুসলিম শাসনের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, তাই ব্যবহার করা হয়।
৯৬৩ চান্দ্র হিজরি সনের যেই মহররমের ১লা দিন থেকে আকবরের শাসনামলে সূচিত সৌর হিজরি সন গণনা শুরু করা হয়েছিল, সে বছরের সেই মহররম মাস ছিল ভারতে পূর্বপ্রচলিত সৌর সনের বৈশাখ মাস। এ জন্য বৈশাখ মাসকেই বাঙালাদেশে খাজনা আদায়ে ভারতীয় সাম্রাজ্যের স্বার্থে চালু করা সৌর হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখ আর এবং নববর্ষ বলে পহেলা বৈশাখকে ধরা হয়।
উপসংহার : বাঙ্গলার নিজস্ব ‘নব বর্ষ’
আগে বিহারী-মগধী আর্য-ভারতীয় শশাঙ্ক কর্তৃক বাঙ্লাদেশের ভারতীয় সীমান্তের এক চিলতেতে ‘বঙ্গাব্দ’ বলে চালানোর চেষ্টা করা আর্য-ভারতীয় ‘বিক্রমী’ সৌর-সন আর খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে প্রস্তাবিত ও সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে সংস্কার-পূর্বক বাঙ্গলাদেশের জনগণের তার গ্রহণ করে নেওয়ার ভিত্তিতে বাঙ্গলাদেশে প্রচলিত অনার্য-আরবীয় ‘হিজরি’ সৌর সনের ভেতর সামান্য বাহ্যিক মিল ছিল। উভয়েই সৌর সণ, আর উভয়ের মাসগুলোর নাম জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণভিত্তিক রূপে, একই। এই সামান্য বাহ্যিক মিলের কারণে অনেকেই মৌলিকভাবে সম্পূ্র্ণই ভিন্নভিত্তিক, ভিন্ন সন ও তার নববর্ষকে গুলিয়ে ফেলে, অনার্য হিজরি সৌর সনভিত্তিক বাঙ্গলা নববর্ষকে আর্য-ভারতীয় ‘বিক্রমী’ সনভিত্তিক এক আর্য-ভারতীয় উৎসব মনে করে বসেন।
এই ভ্রমের কারণে একদিকে কিছু লোক বাঙ্গালীর এই নববর্ষকে তার হিজরি সন, ও তৎভিত্তিক নতুন বার্ষিক ‘হাল-খাতা’ খুলে বিগত বছরের সব দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে হাতে মজুত সম্পদের জন্য রেজেকদাতা খোদার শোকরানা আদায় এবং তারই আপনজন, দরিদ্র-অভাবীদের হক জাকাত ও সমাজের চাহিদা পূরণমূলক খাজনা আদায়সহ সারা বছরের হক-হালাল আয়-ব্যয়ের কর্মকাণ্ডের সানন্দ সূচনাগত যে মূল মর্ম ও চেতনা, তা থেকে স্খলিত করে তাতে বাঙ্গলাদেশের আপামর জনসাধারণের বিশালতর অংশের অবচেতনায় অগ্রহণযোগ্য নানা বিজাতীয় উৎসবতুল্য উপাদানের সংযোগ করতে প্রয়াসী হয়। আর তার ফলে, অন্যদিকে বাঙ্গলাদেশের অপামর জনসাধারণের এই বিশালতর অংশ এর সঙ্গে, অবচেতনায় একাত্মবোধ না করে, তাতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থেকে যায়।
আর্য-ভারতীয় রথযাত্রার মতঘোড়া গাধা, ইঁদুর-প্যাঁচা, এমনকি মহাসম্মানিত জাতীয় নায়ক বা শহীদদের মূর্তিমান চিত্র, প্রতিমা, ভাস্কর্য বা পাশ্চাত্য কোনো কোনো সমাজের অশ্লীল ‘কানিভ্যাল’র মতো ওইসবের মূর্তি, ব্যান্ড বাজান বা বেলেল্লাপনার মতো আচরণের মতো অপসংস্কৃতিমূলক এমনসব উপাদান বাঙ্গলাদেশের বিশালতর, ঐতিহ্যবাদী ও রধনশীল জনসমাজের অবচেতনায় পীড়াদায়ক বলেই তা বিরোধ ও সংঘাত বা নীরব প্রতিবাদ রূপে এমনসব উপাদানে কলুষিত মূলত নির্মল নববর্ষের উৎসব বর্জনের কারণ হয়। এসব থেকে মুক্ত করে, মুক্ত রেখে বাঙ্গলাদেশের চিরায়ত নববর্ষকে তার আদি মরমের নিষ্কলুষ আনন্দোৎসবে ফিরিয়ে নিতে হবে।
আরব ইরান ভারত হয়ে এলেও, ওখান থেকে আসা সবকিছুকেই গ্রহণ না করলেও, খোদ জাতি হিসেবেও ওইসব পথপরিক্রমা দিয়ে এসে আজকের বাঙ্লাদেশের এই ভূখণ্ডে স্থিত হওয়া এই বঙ্গাল জাতির বিশালতর ব্যাপকতর অংশ, যেই সৌর হিজরি সনের প্রথম দিনটিকে যে মর্মে ও চেতনায় যেভাবে উদযাপনকে প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে। তার ঐতিহ্যের অন্তর্গত করে, অবচেতনায় আত্মস্থ করে নিয়েছে-তাই বাঙ্গালীর চিরায়ত নববর্ষ। নিজস্ব, স্বকীয়। তাতে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় আর যা কিছু– যে মহল থেকেই হোক না–তা অপাঙক্তেয়। সুদৃঢ়ে প্রতিরোশ্য, পরিত্যাজ্য।
লেখক পরিচিতি : প্রফেসর ড. আহমদ আনিসুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে অন্যান্য বিষয়সহ মার্ক্সীয় ও ফ্রয়েডীয় সমাজ-মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে উচ্চতর শিক্ষাপর্যায়ের বিশেষজ্ঞতা অর্জন ও সংস্কৃতিবিশ্লেষণ বিষয়ে চূড়ান্ত সন্দর্ভ প্রণয়ন-পূর্বক পিএইচডি লাভ করেন। ধাকা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং গবেষণা করেন।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত