Ad T1

অন্তর্বর্তী সরকার ও জনপ্রত্যাশা

ড. মো. শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ১৩
আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ২৩

দীর্ঘ প্রায় আট মাস হলো দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে আমাদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা পর্যালোচনা করার যথার্থ দাবি রাখে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তীব্র গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে যত সরকার পতন হয়েছে, তা থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিল ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের অবর্ণনীয় দমন-নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে জীবন দিতে হয়েছে হাজার হাজার কোমলমতি ও নিরপরাধ শিশু, কিশোর, যুবকসহ আপামর ছাত্র-জনতাকে। রক্তাক্ত জুলাইয়ের এই বিপ্লবী চেতনা এবং তরুণদের গণজাগরণ আমাদের সুখীসমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে দারুণভাবে আশান্বিত করেছে। তাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী চেতনা ও জন-আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিম্নোক্ত কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা উচিত।

১. বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত অনেক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে হতাহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসার যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু হলেও ধীরে ধীরে সেই কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসছে। আজ পর্যন্ত উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী জনতা সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে ধরনা দিচ্ছে, যা আমাদের জন্য ভীষণ পীড়াদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। তাই একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে জুলাই আন্দোলনে হতাহত শহীদ পরিবারের একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেস তৈরি করে সরকারের প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা অনতিবিলম্বে নিশ্চিত করা উচিত। উন্নত চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিয়ে রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলনে হতাহত সব সাহসী যোদ্ধাকে যথাযথ পুনর্বাসন ও সামাজিক মর্যাদা দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এসব কার্যক্রমে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য প্রদর্শন করা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

২. বিগত আওয়ামী কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলার উন্নতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল একটি সফল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করা। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে যৌথবাহিনীর কার্যক্রম আজ পর্যন্ত চলমান থাকলেও অবৈধ অস্ত্রের হরহামেশা ব্যবহার যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো সন্ত্রাস দমনে কীভাবে যৌথবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।

৩. আমাদের মনে রাখতে হবে, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নিছক একটি কোটা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান অন্যায়, অবিচার, অধিকার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সব শ্রেণিপেশার মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অধিকন্তু বিগত ১৬/১৭ বছর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ সরকারের সর্বস্তরে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেনি। ২০১৪ এবং তৎপরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষকে নির্বাচনবিমুখ করেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি অন্যতম নিয়ামক হলো ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দসই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন লোকদেখানো গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের নামে জনগণকে সেই সুযোগ থেকে বারবার বঞ্চিত করেছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এ ক্ষোভ প্রশমনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, পেশিশক্তি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করা। দলীয় ও দলনিরপেক্ষ, সৎ, মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেওয়া। দেশের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে উদ্বুদ্ধ করা। এভাবে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ধারা আগামী প্রজন্মের জন্য নিশ্চিত করা।

৪. দীর্ঘদিন আওয়ামী কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে গুম, খুন, জেল-জুলুম, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে অগণিত বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদী নেতাকর্মীকে। সর্বশেষ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই অর্জন করেছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। তাই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্নের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার আনয়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রদান করলেও ও শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন এবং তার পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের স্লথগতি শিক্ষকসমাজ তথা দেশবাসীকে হতাশ করেছে।

৫. আমরা ইতোমধ্যে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন না করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য প্রার্থীকে পদায়ন করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ মহলের সুপারিশ কিংবা তদবিরকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অভিজ্ঞ নির্বাচক প্যানেল কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে সার্চ কমিটি গঠন করে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য প্রার্থীদের পদায়ন করা যুক্তিযুক্ত হবে। নয়তো সরকার পরিচালনায় বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলিক কোনো পার্থক্য জনসম্মুখে দৃশ্যমান হবে না, যা প্রকারান্তরে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ম্লান করে দেবে।

৬. বিগত আওয়ামী সরকার সস্তা জনপ্রিয়তা ও দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে গণহারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়া জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অযৌক্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষাক্ষেত্রে তৈরি হয়েছিল চরম অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত উপেক্ষা করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ক্রমাগত কোর্স কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছিল। এমতাবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি কর্মমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করছি।

লেখক : প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এবং প্রাক্তন ডিন, মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত