খানের আখ্যান
মারুফ কামাল খান
বাংলাদেশ এখনো নানান অস্থিরতায় ভুগছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী আমাদের জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে আছে। আরেক অতিকায় প্রতিবেশী ভারতের অধিকৃত কাশ্মীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকরা জিন্দানবাসী হয়ে আছেন দীর্ঘকাল ধরে। এখন সারা ভারতেই হিন্দুত্ববাদী উগ্র সাম্প্রদায়িকদের হাতে মুসলিমদের জান-মাল-সম্ভ্রম-নিরাপত্তা পুরোপুরি বিপন্ন। দোরের পাশের এসব জুলুমবাজি ও সংকট সত্ত্বেও আজ এ দেশের প্রতিটি মানবতাবাদী মানুষের হৃদয় ফিলিস্তিন, বিশেষ করে মৃত্যু-উপত্যকা গাজার নিঃশেষ হতে বসা আদম সন্তানদের শোকে বিদীর্ণ, বেদনায় মুহ্যমান। সেখানে ইসরাইলি হানাদার বাহিনী যখন-তখন গুলি করে, বোমা মেরে শিশুদের, নারীদের হত্যা করছে। তাদের মারণযজ্ঞ থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সারা দুনিয়ার শক্তিমানরা চেয়ে চেয়ে দেখছে এই হত্যালীলা ও তাণ্ডব। তারা খুনি রাষ্ট্র ইসরাইল ও সে দেশের ঘাতক নেতা নেতানিয়াহুর সব বর্বরতা এবং অপরাধে মদত জুগিয়ে চলেছে। আরব বিশ্বের নীরবতা ও অকার্যকর বয়ান আমাদের অন্তরের রক্তক্ষরণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরব দেশগুলোর রাজা-বাদশাহ, শাসক-যুবরাজরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা ও উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের জিগরি দোস্ত। আমেরিকায় ইসরাইলি জায়োনিস্ট লবি টাকা, মিডিয়া, কূটনীতি ও তাত্ত্বিকতার দিক দিয়ে প্রবলভাবে প্রভাবশালী। কাজেই ওদেশে কোনো পার্টির বা প্রভাবশালী রাজনীতিকের সাধ্য নেই ইসরাইলকে চটিয়ে বা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতি করার। বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকতে নানান কারণে জায়োনিস্ট লবি তার ওপর চটেছিল। প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তাকে নানাভাবে কী পরিমাণ হেনস্তা হতে হয়েছিল, সেটা সবারই জানা। ক্লিনটন একবার আভাসে শুধু বলেছিলেন, আলট্রা রাইটিস্ট লবি তার পেছনে লেগেছে। পরে তিনি গোপনে ওদের সঙ্গে আপস-রফা করেই রক্ষা পেয়েছিলেন।
এখন তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও আরবদেরও যথেষ্ট টাকা আছে। সে টাকায় তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতা রক্ষায় অনেক আমেরিকান রাজনীতিবিদের ফান্ডে ডোনেশন দেন, চাঁদা দেন, উপঢৌকন দেন এবং কখনো কখনো গোপনে ঘুসও দেন। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বা উম্মাহর স্বার্থের কথা চিন্তা করে তাদের কখনো যুক্তরাষ্ট্রে লবি করতে দেখা যায় না। ফলে সে দেশে ইসরাইলি ও জায়োনিস্ট লবির কাছে আরব, মিডল ইস্ট ও মুসলিম লবি নস্যি। তা ছাড়া নিজেদের মধ্যে কোন্দল, খেয়োখেয়ি ও ক্ষুদ্র স্বার্থের সব দ্বন্দ্ব তো আছেই।
বাই-পার্টিজান আমেরিকায় তাই ইসরাইলি স্বার্থরক্ষায় প্রধান দু-দলই সোচ্চার। তাদের মধ্যে ইসরাইলের স্বার্থ কারা বেশি দক্ষতার সঙ্গে সার্ভ করতে পারে, সেটার প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা চলে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবেই ইসরাইলের অন্যতম কো-ফাউন্ডার। তাই তাদের জন্ম দেওয়া এই অবৈধ সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখা ও সুরক্ষা দেওয়ার একটা অঙ্গীকার তো তাদের আছেই। তবে এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প বরাবরই সবচেয়ে নির্লজ্জ এবং একেবারে হাড়ে হারামির ভূমিকায়।
ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের লোক এবং হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট ইভাঞ্জেলিক খ্রিষ্টানরা তার ভোটব্যাংক। রিপাবলিকান পার্টি ট্রাডিশন্যালি বেশি প্রো-ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রে জায়োনিস্ট লবির বড় বড় ডোনার ও চাঁইদের বেশিরভাগই রিপাবলিকান ক্যাম্প বিলং করে। ইভাঞ্জেলিকরাও খুবই ইসরাইলঘেঁষা। ফলে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট থাকাকালেই ট্রাম্প ইসরাইলের স্বার্থরক্ষায় উদোম হয়েই নেমেছিলেন।
এখন চলুন একটু পেছনের ইতিহাস ঘুরে আসি। মনে রাখতে হবে, আরব ও ফিলিস্তিনিদের সারল্য এবং ভুল মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামের উগ্র সাম্প্রদায়িক ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের অন্যতম কারণ। এ অঞ্চল ছিল তুর্কি খেলাফতের আওতাধীন। ইংরেজদের উসকানিতে আরবরা তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ‘প্যান এরাব’ বা আরব জাতীয়তাবাদীদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। ব্রিটিশরা তাদের বেলফোর ডিক্লারেশনে জানায়, তারা এ অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ। আসলে এটা ছিল যুদ্ধে ইহুদিদের সমর্থনের বিনিময়ে ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করে দেওয়ার গোপন অঙ্গীকারের কৌশলী প্রকাশ্য রূপ। কিন্তু প্রতারণা করে ফিলিস্তিনিদেরও বোঝানো হয়, তুর্কির কবল থেকে মুক্ত করে ইংরেজরা তাদেরই স্বাধীনতা দেবে। তাই তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে আরব জাতীয়তাবাদী ও ফিলিস্তিনিরা অংশ নেয়।
তুর্কি খেলাফতের পতন ও পরবর্তী অভিঘাতগুলোয় মিত্রশক্তির জয়ের পটভূমিতে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র কেটেকুটে আরব জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর হাতে বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা বর্তমান আরব রাষ্ট্রগুলো পয়দা করে। তবে তারা চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে। ব্রিটিশ অধিকারে আসার পর তারা সারা ইউরোপ থেকে শেতাঙ্গ আশকেনাজি ইহুদি উদ্বাস্তুদের এনে ফিলিস্তিনে আশ্রয় দিতে থাকে। এরা কিন্তু কেউই বনি ইসরাইলি নয়, ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্রও নয়। এই কনভার্টেড ইউরোপীয় ইহুদিদের দ্বারা ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটিয়ে তাদের হাতে ফিলিস্তিন ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ব্রিটিশরা। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এবং সোভিয়েত রাশিয়া দ্রুত সেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।
এই ইহুদিরা সংখ্যায় অনেক কম হলেও জাতিসংঘ তাদের জন্য ফিলিস্তিনি ভূমির ৫৭ শতাংশ ও ফিলিস্তিনিদের জন্য ৪৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করে। যদিও ফিলিস্তিনিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ইহুদিদের তিন গুণেরও বেশি।
ব্রিটিশরা থাকতেই ইহুদি শরণার্থীরা এসে ইংরেজ শাসকদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা, তাদের উচ্ছেদ ও বিতাড়ন শুরু করে। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর ফিলিস্তিনিদের ওপর জায়োনিস্ট ইসরাইলি হামলা সর্বব্যাপী রূপ নেয়। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোসহ নানা দেশে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
ব্রিটিশের বিশ্বাসঘাতকতায় স্তম্ভিত হয় আরববিশ্ব ও ফিলিস্তিনিরা। অক্ষম ক্রোধ ও ক্ষোভে তারা ইসরাইলকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। কৌশলী হয়ে বরাদ্দ ৪৩ শতাংশ ভূমিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ও সরকার গঠন না করে তারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইসরাইলকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ইসরাইলের সঙ্গে মিলিত আরব রাষ্ট্রগুলোর সংঘাত। আরব লীগ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের আরব হিসেবে অভিহিত করে তাদের মুক্তির সংগ্রামকে সংগঠিত রূপ দিতে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংস্থা বা পিএলও গঠনে সহায়তা করে।
এই সংঘাত আসলে শুধু ইসরাইলের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল পুরো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিযূথের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি ও আরবদের সংগ্রাম। ইউরোপ-আমেরিকা রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ না করলেও ইসরাইলের পক্ষে অর্থ, অস্ত্র, প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে এবং কূটনৈতিক ও প্রচারণা যুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। পক্ষান্তরে দুনিয়ার অন্যান্য মুসলিম দেশ দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের শুধু নৈতিক সমর্থন। যদিও বেসরকারিভাবে সেসব দেশের অনেক তরুণ ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধও করেছে কিন্তু তাদের ছিল না উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধাস্ত্র। দুপক্ষের সমরশক্তি ছিল অসম। তিনটি বড় যুদ্ধসহ ক্রমাগত যুদ্ধ হয়েছে। নিট ফল হচ্ছে, জিত হয়েছে ইসরাইলের। তারা ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দ রাখা ভূখণ্ড প্রায় পুরোই দখল করে নিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে বসিয়েছে ইহুদি বস্তি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধে প্রতিবেশী সিরিয়া, মিসর, জর্দান ও লেবাননের এলাকাও অধিকার করেছে ইসরাইল। এ যুদ্ধে আরব দুনিয়া পরাজিত, বিধ্বস্ত ও রণক্লান্ত হয়েছে। ভূমি হারানো এই আরব রাষ্ট্রগুলো পরে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে সন্ধি করে তাদের নিজ নিজ অধিকৃত এলাকা ছাড়িয়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে ইসরাইলবিরোধী সংঘাত থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে তারা।
এই পটভূমিতে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সঙ্গে অসলো চুক্তিতে সই করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা প্রথমবারের মতো কিছু শর্তসাপেক্ষে পরোক্ষভাবে ইসরাইলের বৈধতা স্বীকার করে। আরব লীগও শর্তসাপেক্ষে এই অসলো চুক্তি মেনে নেয়। এটাই মূলত ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের অসম্পূর্ণ ফর্মুলা। এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন পেয়েছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। অসলোতে মার্কিন মধ্যস্থতায় পিএলও এবং ইসরাইলিদের মধ্যে দীর্ঘ গোপন আলোচনায় একটি সমঝোতা স্থাপিত হয়। পরে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউসের লনে বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে অসলো চুক্তিতে আরাফাত ও রবিন সই করেন।
অসলো চুক্তির মূল কথাগুলো ছিল : ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে পিএলওকে ইসরাইলের স্বীকার করে নেওয়া। ইসরাইলের বিরুদ্ধে পিএলওর সশস্ত্র যুদ্ধ ত্যাগ করা। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে উৎখাতের নীতি থেকে পিএলওর সরে আসা। গাজা ও পশ্চিমতীরের জেরিকা অঞ্চলে ফিলিস্তিনি স্বশাসন কায়েম করা। পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমতীরসহ দখল করা অন্যান্য অঞ্চল থেকে ইসরাইলি দখলদারি প্রত্যাহার। তবে এই দখল করা অঞ্চলের সীমানা ও প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের চৌহদ্দি নির্ধারণ এবং জেরুজালেম শহর নিয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। উচ্ছেদ হয়ে বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলি ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও কোনো সমঝোতা হয়নি। শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পথে ধারাবাহিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এগুলো নিষ্পত্তির কথা ছিল। তবে পরে ইসরাইলের অনমনীয়তা এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইহুদি বস্তি বসানো অব্যাহত রাখায় অসলো শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়ে।
এই শান্তি চুক্তির আওতায় পিএলও তার নাম বদল করে প্যালেস্টাইন জাতীয় কর্তৃপক্ষ (পিএনএ) বা সংক্ষেপে প্যালেস্টাইন অথরিটি (পিএ) নাম ধারণ করে এবং ফিলিস্তিনি স্বশাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। ইসরাইলও গাজা ও পশ্চিমতীর এলাকা থেকে দখলদারি ধীরে ধীরে প্রত্যাহার শুরু করে। কিন্তু উগ্রবাদী জায়োনিস্টরা এই শান্তি চুক্তিকে ইসরাইলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে প্রত্যাখ্যান করে। ক্রুদ্ধ উগ্রপন্থি জায়োনিস্টরা ১৯৯৫ সালে আইজ্যাক রবিনকে হত্যা করে। এ ঘটনায় শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন থমকে যায়। শুরু হয় ইসরাইলের তরফ থেকে চুক্তি ভঙ্গ করা। এতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ইয়াসির আরাফাতের জনপ্রিয়তাও কমতে থাকে। তারা এমন একটা চুক্তি করে ইসরাইলকে মেনে নেওয়াটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দেয়। ফিলিস্তিনি ঐক্যে ফাটল ধরে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রিত ফিলিস্তিনি তরুণদের একাংশ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সে সময় ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহরা ইসরাইল আক্রমণ করে। আবার ফিরে আসে সশস্ত্র সংঘাত। এই সংঘাতের ফলে ইসরাইলেও উগ্রপন্থি জায়নবাদীদের সমর্থন বেড়ে যায়। অসলো চুক্তিবিরোধী উগ্রপন্থি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসেই তিনি বেপরোয়াভাবে অসলো শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন করতে থাকেন।
এদিকে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুতে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব আরো দুর্বল হয় এবং তাদের ঐক্যে আরো ফাটল ধরে। সশস্ত্র যুদ্ধে বিশ্বাসী গ্রুপগুলো শক্তিশালী হয়। শান্তি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারিয়ে কিছু আরব রাষ্ট্রও গোপনে তাদের সাহায্য দিতে থাকে। বিশেষ করে ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস ফিলিস্তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জেতে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ফিলিস্তিনি অথরিটিকে মানবিক সাহায্য দেওয়া স্থগিত করে এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। তাদের যুক্তি, হামাস শান্তি চুক্তিবিরোধী, সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী সশস্ত্র মিলিট্যান্ট গ্রুপ। কাজেই অসলো চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের দিয়ে গঠিত হতে পারে না।
অনেক দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা হামাস ও ফাতাহ উভয় গ্রুপকে মিলিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করলেও তা টেকেনি। এই ঐক্য সরকারকেও মানতে রাজি হয়নি ইউরোপ-আমেরিকা ও ইসরাইল। এরপর ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনী কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নিয়ে হামাস ও ফাতাহ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রূপ নেয়। তাদের সহাবস্থান অসম্ভব হয়ে ওঠে। তারপর থেকেই গাজা এলাকা হামাস এবং পশ্চিমতীর ফাতাহ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। কিন্তু চারদিকেই ইসরাইলি অবরোধের ভেতরে এই দুই ফিলিস্তিনি অঞ্চল হয়ে আছে বিচ্ছিন্ন দুটি উন্মুক্ত কারাগার। ফিলিস্তিনে আর কোনো নির্বাচন করাও সম্ভব হয়নি। ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনে বিপত্তি সৃষ্টি করে। হামাস জেতার ভয়ে ফাতাহও করে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা। আর নির্বাচন হলেও তাতে লাভ নেই কোনো। হামাস নির্বাচিত হলেও তারা যেহেতু অসলো চুক্তিবিরোধী, সেহেতু তাদের সেই চুক্তি মোতাবেক গঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নিতে দেবে না সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। কাজেই অচলাবস্থা।
এ অবস্থায় ইসরাইলকে আরো আস্কারা দিতে প্রকাশ্যে অবতীর্ণ হন ট্রাম্প। তিনি মার্কিন দূতাবাস স্থাপন করেন জেরুজালেমে। ফিলিস্তিনিদের বিল ক্লিনটনের আমল থেকে নিয়মিত দেওয়া মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষাকারী মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেন। বিভিন্ন আরব দেশ ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন ইসরাইলের সঙ্গে তথাকথিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ সই করতে। ইউএইসহ দু-তিনটি আরব দেশ এতে সই করলেও সৌদি আরব, কাতারসহ অন্যান্য আরব দেশ নানান কৌশলে এড়িয়ে যায়। এই অ্যাকর্ডের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অসলো শান্তি চুক্তিকে পুরো নাকচ করা। এরপর ট্রাম্প স্বদেশে ভোটে পরাজিত হলে সেই ধারা হোঁচট খায়। জো বাইডেন ইসরাইলি স্বার্থের অন্যতম প্রধান রক্ষক হলেও ট্রাম্পের মতো উলঙ্গ হয়ে নামা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি অসলো চুক্তির মধ্যেই সমাধান খোঁজেন। ফিলিস্তিনে ট্রাম্পের বন্ধ করা কন্স্যুলেট ফের খোলার এবং মানবিক সহায়তা আবার চালু করার নির্দেশ দেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধর্মে ইহুদি হলেও ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতি জোরালো অঙ্গীকার ব্যক্ত করার পাশাপাশি তাকে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তার অধিকারের কথাও বলতে হয়। এ সময় হামাস ইসরাইলে এক গেরিলা হামলা চালিয়ে ইসরাইলি ও আমেরিকান অনেককে বন্দি করে। তাদের জিম্মি করা হয়। এ ঘটনা পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। হামাসনিয়ন্ত্রিত গাজায় শুরু হয় ইসরাইলি হামলার তাণ্ডব। এর মধ্যে ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হয়ে আমেরিকার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সে আগুনে ঘৃতাহুতি দেন তিনি।
সাম্প্রতিককালে হামাস আরব দেশগুলোর প্রতি হতাশ হয়ে অনেকটাই ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এতে তাদের কার্যকলাপ অনেকটাই ইরানের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। একটি জটিল সময়-সন্ধিক্ষণে ইসরাইলে হামলা চালিয়ে জিম্মি করার অভিযান কতটা বাস্তবসম্মত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। উগ্র জায়নবাদী নেতানিয়াহু তখন অভ্যন্তরীণভাবে ঘোর সংকটে। ইসরাইল তখন তার নিরাপত্তা, ঐক্য ও অখণ্ডতা নিয়ে শঙ্কিত। তার রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ ফিলিস্তিনির বাস। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বাস করা এই ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকারের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের উদার ইসরাইলিদের সমর্থন পাচ্ছিল। ইসরাইলিরাও আর অনন্তকাল একটা নিরাপত্তাভীতি নিয়ে বাস করতে চায় না। একটা ফয়সালা ও শান্তি স্থাপনের দাবি জোরালো হচ্ছিল। সামরিক সমাধানকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পন্থায় একটি ফয়সালার পথে এগোনোর ব্যাপারে ইসরাইলের ভেতরেও একটা চাপ বাড়ছিল।
দুনিয়ার প্রধান মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো ইসরাইলের হাতে থাকলেও ইনডিপেনডেন্ট জার্নালিজম, সিটিজেন জার্নালিজম, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন ক্যাম্পেইন ও ভার্চুয়াল অ্যাকটিভিজমও হয়ে উঠেছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার প্রবল ও সমান্তরাল প্রতিদ্বন্দ্বী। তথ্য ও মতামত অবদমন এবং নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে উঠেছে। মানুষ সত্য জেনে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে ইসরাইলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে আর শুধু এন্টি-সেমেটিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দেশে দেশে জনমত ইসরাইলি বর্বরতার নিন্দায় সোচ্চার হচ্ছে। উন্নত দেশেও রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা নাগরিকদের চাপের মুখে পড়ছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের আইনপ্রণেতাদের মধ্য থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে আওয়াজ উচ্চকিত হচ্ছে এ সময়ে হামাসের হামলা খুব ভুল এবং এতে জায়নবাদীদের সংকট উত্তরণে সহায়তা হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।
ট্রাম্পের সরাসরি মদতে ফিলিস্তিন ও ইরানের বিরুদ্ধে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইসরাইল। তারা ইতোমধ্যে হামাস ও ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর সামরিক ও সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল যে বর্বরতা চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সোচ্চার। শুধু মুসলিম দেশগুলোতেই নয়, সারা দুনিয়ার প্রভাবশালী দেশগুলোর নগর-বন্দর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে। গাজাকে জনশূন্য করে ভূমধ্য সাগরের পূর্ব উপকূলে রিসোর্ট বা বিনোদননগর বানানোর ব্যাপারে ট্রাম্পের উৎকট বাসনা মানবতার তীব্র ঘৃণা কুড়াচ্ছে। ট্রাম্প ন্যাটো ও ইউরোপীয় মিত্রদের থেকে আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া, তুরস্ক ও আরব দেশগুলোকে তিনি কতটা পক্ষে রাখতে পারবেন, তা নিশ্চিত নয়। ট্রাম্পের নানা হঠকারিতা, পাগলামি ও ব্যক্তিস্বার্থতাড়িত এবং খামখেয়ালিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে আমেরিকা বিশ্বজোড়া প্রতিপত্তি হারাচ্ছে। চরম বিপর্যয় ও হতাশার মধ্যেও এই পরিস্থিতি ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও ফিলিস্তিনের জন্য আশার আলো জ্বালতে পারে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফিলিস্তিনিরা যদি একত্র হতে পারে আরব দেশগুলো যদি পারস্পরিক অনাক্রমণমূলক সমঝোতায় আসতে পারে এবং নিজেদের আকাঙ্ক্ষাকে আরো প্রসারিত করে আরব, পারস্য ও তুরস্কের মধ্যে যদি ন্যূনতম ইস্যুতে একটা সন্ধি স্থাপন করতে পারে, তাহলে কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
জনৈকা এনজিও নেত্রী ও বর্তমান সরকারের এক শক্তিশালী উপদেষ্টা সব রাজনীতিবিদের প্রতি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘গত ৫৩ বছরে আপনারা কী করেছেন?’ তার এই স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হলাম! ভাবতে লাগলাম, এই প্রশ্ন করার সাহস ও সুযোগটি তারা কেন পেলেন, কীভাবে পেলেন?
৪ ঘণ্টা আগেভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত ও অনেকে আহত হওয়ার পর চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটির সঙ্গে সাড়ে ছয় দশক ধরে কার্যকর সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করাসহ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি নদী হচ্ছে ফেনী নদী। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত। নদীতীরের সংকীর্ণ অঞ্চল বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে এক গুরুতর কৌশলগত বিষয় হয়ে উঠেছে।
৫ ঘণ্টা আগেপেছনের কথা বাদ, আমরা ২০০৮ সাল থেকে ধরি। আওয়ামী লীগের ‘দিনবদলের সনদ’, ‘রূপকল্প-২০৪১’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’- এ রকম গালভরা হরেক রকম নামের অঙ্গীকারনামার কথা মনে আছে? কী ছিল না তাতে? ওইসব অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ অনেক আগেই এক মহাউন্নত আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হতো।
১ দিন আগে