আবদুল লতিফ মাসুম
ঝগড়া-ফ্যাসাদ যে শুধু গ্রামেই হয় তা নয়। তবু গ্রামীণ ঝগড়া-বিবাদের একটা ভিন্ন রকম বিষয়-বৈশিষ্ট্য আছে। ‘Village Politics’ শব্দটি রাজনীতি-বিষয়ক নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের জটিলতা, কুটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমা নিদের্শক। অথচ একসময় গ্রামীণ জীবনের সরলতার সুনাম ছিল। কবির ভাষায়, ‘আমাদের ছোট গ্রাম শত শত ঘর, থাকি সবে মিলেমিশে নাহি কেহ পর।’ আরো কথা আছে, ‘আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন, মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি সবারই জানা—‘অবারিত মাঠ গগন ললাট, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।’ কবিগুরু বেঁচে থাকলে এখন হয়তো দুঃখ-দুর্দশায় কপাল চাপটাতেন। এক দিনে এই গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনে হতশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হয়নি।
এটি অবশ্যই একটি অপ্রিয় সত্য, সময় ও স্রোত নিয়তই পরিবর্তনশীল। আমাদের গ্রামীণ সমাজ জীবনের আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ৫০ বছর আগে বাড়িতে বেড়াতে এলে পান-তামাক পরিবেশিত হতো। এখন গরিবের বাড়িতে গেলেও চা-টা খেতে দেবে। বিশেষ করে নব্বইয়ে উত্থিত বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিবিপ্লব গ্রামীণ সমাজকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে। এখন খয়রাতির হাতেও মোবাইল ফোন দেখা যায়। এই প্রযুক্তিবিপ্লব আমাদের কাছে আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে কি না, সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। গ্রামীণ সমাজে গতিশীলতা এসেছে। কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যও এসেছে। কিন্তু বদলায়নি মানুষের স্বভাব-চরিত্র। আওয়ামী আমলে মামলা যেমন ছিল অত্যাচারের বাহন তেমনি কিছু মামলাবাজ মানুষের কাছে আজও মামলা প্রতিশোধের বড় অস্ত্র। এদেশের জনগণও কম মামলাবাজ নয়। মামলা তাদের নেশা, মামলা তাদের পেশা এবং মামলা তাদের সেবা। বংশ পরম্পরায় মামলা করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যায় তারা, তবুও মামলা ছাড়ে না তারা। এমনও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে অনেক, যেখানে দেখা যায়, প্রতিশোধ নেওয়ার হিংস্র আশায় নিজ সন্তানকে হত্যা করে শত্রুর নামে মামলা দিয়েছে। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান নিলে বরিশালের মানুষেরা বোধহয় এগিয়ে থাকবেন। মজা করে বলা হয়, ‘কাম-কাজ নাই তাই মামলা করে খাই, মামার নামে মামলা দিলাম একটা বাজাবো তার বারোটা।’ আরো আছে গফরগাঁওয়ের বদনাম, তারাও নাকি মামলাবাজ। অতি সামান্য কারণে মামলা করে তারা; মুরগির ঠ্যাং ভেঙেছে—দে মামলা, আমার গাছের খেজুর খেয়েছে—দে মামলা, আমার জমির আইল ঠেলেছে—দে মামলা প্রভৃতি।
মানুষ হিসেবে কিছু অলঙ্ঘনীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব-চরিত্র আমরা ধারণ করি। মনীষী হবস বলেন, ‘Man is by born selfish, solitary, poor, brutish, nasty and short.’ ভারতীয় শাস্ত্রকথায় মানুষের নেতিবাচক স্বভাব-চরিত্রকে ষড়ঋতু বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য। আল-কোরআনে মানুষকে বলা হয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। আবার কোরআনেই বলা হয়েছে, মানুষ কতই না অকৃতজ্ঞ, কতই না নিকৃষ্ট। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ হিসেবে আমরা এসবকে অতিক্রম করতে পারি না সহজে, এজন্য সাধনা প্রয়োজন। প্রতিটি ধর্মেই মানুষকে ভালো হওয়ার পথ ও পাথেয় রয়েছে। ইসলাম আরব জাহেলিয়াতকে পরিবর্তন করে বিশ্বের অন্যতম সভ্যতা নির্মাণ করেছে। অসভ্য বর্বর কাফেররা মোহাম্মদ (সা.)-এর পরশে এসে সোনায় পরিণত হয়েছে। কবি নজরুল বলেন, ‘ইসলাম সে তো পরশমণি, তাকে কে পেয়েছে খুঁজে, পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি।’
বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৯০ ভাগ এই ইসলামে দীক্ষিত। গ্রামীণ সমাজের বিশ্বাসেও এ আদর্শ বা ধর্ম ধারণ করে আছে জনগণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এদের যাপিত জীবনে, স্বভাব-চরিত্রে কাঙ্ক্ষিত ইসলামের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। রমজানে রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। খুশিতে বাগ-বাগ হলো দেশ। রোজা শেষ তো নামাজ-রোজার আধিক্যও শেষ। মৌলিক প্রশ্ন ধর্ম কেন মর্মে পৌঁছে না। সে এক বিশাল বিতর্ক। গ্রামীণ জীবনের দিকে ফিরে যাই আবার।
আগেই বলা হয়েছে, গ্রাম আর গ্রাম নেই। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করবেন। উন্নয়নের দিক থেকে সেটি অনেকটা হয়েছে বটে, তবে সেই উন্নয়নের বদলে তিনি দিয়েছেন অনুন্নয়নের স্বভাব-চরিত্র। যাযাবরের ভাষায় বলা যায়, তিনি আমাদের দিয়েছেন বেগ, কেড়ে নিয়েছেন আমাদের আবেগ। বিগত ১৫ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মোকদ্দমা ও অত্যাচার-অনাচারকে শাসনের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা রজু করেন। এভাবে লাখ লাখ মানুষ মামলা-মোকদ্দমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, মানবেতর জীবনযাপন করে। যে গ্রামীণ নীড়গুলো ছিল শান্তির আবাস, সেগুলো অশান্তির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা হয়। বিশেষ করে ২০১১ সালে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি Village Politics-কে বিষাক্ত করে তোলেন। মামলা-মোকদ্দমাই শুধু নয়, গ্রামের বিরোধীদের গ্রাম ছাড়া করা, এমনকি ঘরে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। অতিমাত্রিক রাজনীতিকরণের ফলে আত্মীয় অনাত্মীয় হয়ে যায়, ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, পারা-পড়শির সেই সাবলীল সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। রাজনীতি এবং রাজনীতিই শুধু সব সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশ সমাজের গ্রামীণ অংশ ক্রমেই অস্থির হয়ে পড়ছিল। তাতে আওয়ামী রাজনীতিকরা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ আরো বেড়েছে বৈ কমেনি। স্বাভাবিকভাবেই ১৭ বছরের নির্যাতিত মানুষেরা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। জনরোষে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব পালিয়ে যায়। গ্রামীণ শাসনের তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ শতভাগ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল। নির্বাচিত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রায় শতভাগ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এসব লোক পালিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ধস নামে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অরাজকতা দেখা দেয়। একরকম দ্বৈত শাসনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। যেহেতু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় নেতৃত্ব ছিল, সেই একই ধারায় জনগণ বিএনপিকে বিকল্প শক্তি হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু আইনগতভাবে তাদের কোনো বৈধতা না থাকায় বৈধতার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করে। এভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় উলুখাগড়ায় পরিণত হয় জনগণ। মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা, সালিশ ব্যবস্থায় স্থবিরতা এবং সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা-বিপত্তি বেড়ে যায়। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ করে। প্রধান রাজনৈতিক দল সংগতভাবেই এর বিরোধিতা করে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি শক্ত করতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চাইলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় গ্রামীণ সমাজে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় নেতৃত্বের এই কোন্দল প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ অসম্ভব অস্থিরতা, অরাজকতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ভবিষ্যৎ স্থানীয় নির্বাচনের আশায় সব দল তাদের প্রভাবজাল তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছে। তাতে সংঘাত আরো তীব্রতর হয়েছে। বাড়তি উৎপাত করছে পতিত আওয়ামী লীগ। তারা যেহেতু নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারছে না, তাই তারা হাসিনা স্বৈরাচারের নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র আঁটছে। গত শনিবার ফরিদপুরের জাজিরায় তারা বোমাবাজি ও সন্ত্রাস করেছে। তারা ভাবছে এভাবে সারাদেশে ভায়োলেন্স ছড়িয়ে দিয়ে তারা সফল হবে। অন্যদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দল ও শত্রুতা বেড়েই চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে যেসব ব্যবস্থায় শান্তি ও স্থিতি বজায় থাকে, তার মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ সালিশ ব্যবস্থা। এই গ্রামীণ সালিশ ব্যবস্থা আসলেই গ্রামীণ শান্তির একটি বড় নিয়ন্ত্রক। সালিশ ব্যবস্থারও আওয়ামী আমলে ক্রমেই দলীয়করণ ঘটে। মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু অস্থায়ী, সেহেতু গ্রামীণ দুষ্কৃতকারীরা মনে করে এটি দুর্বল সরকার। এখন তারা উৎপাত করার উৎকৃষ্ট সময় হিসেবে মধ্যবর্তী সময়কে বেছে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাম। গ্রামীণ সমাজের সুবিধা-অসুবিধা, বিরোধ-বিপত্তি ও আপত্তি সাধারণভাবেই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভাব ফেলে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শত চেষ্টা সত্ত্বেও পুরোপুরি আইন-শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। সালিশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই অচল অবস্থার অবসান হওয়া কঠিন। তাই জাতীয় তথা সংসদীয় নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক পর্যায়ে দলভিত্তিক প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পরিবর্তে নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের এসব ক্ষেত্রে পদায়ন প্রয়োজন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে আদালত পরিচালনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২০২৪ সালের বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনায় এসব আদালত হিমশিম খাচ্ছে। গ্রামীণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও সালিশ ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। গ্রামীণ পর্যায়ে যদি সেই শান্তির নীড় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়, তা হলে সরকারের উচিত শক্তভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়াস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা।
ঝগড়া-ফ্যাসাদ যে শুধু গ্রামেই হয় তা নয়। তবু গ্রামীণ ঝগড়া-বিবাদের একটা ভিন্ন রকম বিষয়-বৈশিষ্ট্য আছে। ‘Village Politics’ শব্দটি রাজনীতি-বিষয়ক নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের জটিলতা, কুটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমা নিদের্শক। অথচ একসময় গ্রামীণ জীবনের সরলতার সুনাম ছিল। কবির ভাষায়, ‘আমাদের ছোট গ্রাম শত শত ঘর, থাকি সবে মিলেমিশে নাহি কেহ পর।’ আরো কথা আছে, ‘আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন, মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি সবারই জানা—‘অবারিত মাঠ গগন ললাট, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।’ কবিগুরু বেঁচে থাকলে এখন হয়তো দুঃখ-দুর্দশায় কপাল চাপটাতেন। এক দিনে এই গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনে হতশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হয়নি।
এটি অবশ্যই একটি অপ্রিয় সত্য, সময় ও স্রোত নিয়তই পরিবর্তনশীল। আমাদের গ্রামীণ সমাজ জীবনের আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ৫০ বছর আগে বাড়িতে বেড়াতে এলে পান-তামাক পরিবেশিত হতো। এখন গরিবের বাড়িতে গেলেও চা-টা খেতে দেবে। বিশেষ করে নব্বইয়ে উত্থিত বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিবিপ্লব গ্রামীণ সমাজকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে। এখন খয়রাতির হাতেও মোবাইল ফোন দেখা যায়। এই প্রযুক্তিবিপ্লব আমাদের কাছে আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে কি না, সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। গ্রামীণ সমাজে গতিশীলতা এসেছে। কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যও এসেছে। কিন্তু বদলায়নি মানুষের স্বভাব-চরিত্র। আওয়ামী আমলে মামলা যেমন ছিল অত্যাচারের বাহন তেমনি কিছু মামলাবাজ মানুষের কাছে আজও মামলা প্রতিশোধের বড় অস্ত্র। এদেশের জনগণও কম মামলাবাজ নয়। মামলা তাদের নেশা, মামলা তাদের পেশা এবং মামলা তাদের সেবা। বংশ পরম্পরায় মামলা করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যায় তারা, তবুও মামলা ছাড়ে না তারা। এমনও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে অনেক, যেখানে দেখা যায়, প্রতিশোধ নেওয়ার হিংস্র আশায় নিজ সন্তানকে হত্যা করে শত্রুর নামে মামলা দিয়েছে। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান নিলে বরিশালের মানুষেরা বোধহয় এগিয়ে থাকবেন। মজা করে বলা হয়, ‘কাম-কাজ নাই তাই মামলা করে খাই, মামার নামে মামলা দিলাম একটা বাজাবো তার বারোটা।’ আরো আছে গফরগাঁওয়ের বদনাম, তারাও নাকি মামলাবাজ। অতি সামান্য কারণে মামলা করে তারা; মুরগির ঠ্যাং ভেঙেছে—দে মামলা, আমার গাছের খেজুর খেয়েছে—দে মামলা, আমার জমির আইল ঠেলেছে—দে মামলা প্রভৃতি।
মানুষ হিসেবে কিছু অলঙ্ঘনীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব-চরিত্র আমরা ধারণ করি। মনীষী হবস বলেন, ‘Man is by born selfish, solitary, poor, brutish, nasty and short.’ ভারতীয় শাস্ত্রকথায় মানুষের নেতিবাচক স্বভাব-চরিত্রকে ষড়ঋতু বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য। আল-কোরআনে মানুষকে বলা হয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। আবার কোরআনেই বলা হয়েছে, মানুষ কতই না অকৃতজ্ঞ, কতই না নিকৃষ্ট। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ হিসেবে আমরা এসবকে অতিক্রম করতে পারি না সহজে, এজন্য সাধনা প্রয়োজন। প্রতিটি ধর্মেই মানুষকে ভালো হওয়ার পথ ও পাথেয় রয়েছে। ইসলাম আরব জাহেলিয়াতকে পরিবর্তন করে বিশ্বের অন্যতম সভ্যতা নির্মাণ করেছে। অসভ্য বর্বর কাফেররা মোহাম্মদ (সা.)-এর পরশে এসে সোনায় পরিণত হয়েছে। কবি নজরুল বলেন, ‘ইসলাম সে তো পরশমণি, তাকে কে পেয়েছে খুঁজে, পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি।’
বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৯০ ভাগ এই ইসলামে দীক্ষিত। গ্রামীণ সমাজের বিশ্বাসেও এ আদর্শ বা ধর্ম ধারণ করে আছে জনগণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এদের যাপিত জীবনে, স্বভাব-চরিত্রে কাঙ্ক্ষিত ইসলামের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। রমজানে রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। খুশিতে বাগ-বাগ হলো দেশ। রোজা শেষ তো নামাজ-রোজার আধিক্যও শেষ। মৌলিক প্রশ্ন ধর্ম কেন মর্মে পৌঁছে না। সে এক বিশাল বিতর্ক। গ্রামীণ জীবনের দিকে ফিরে যাই আবার।
আগেই বলা হয়েছে, গ্রাম আর গ্রাম নেই। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করবেন। উন্নয়নের দিক থেকে সেটি অনেকটা হয়েছে বটে, তবে সেই উন্নয়নের বদলে তিনি দিয়েছেন অনুন্নয়নের স্বভাব-চরিত্র। যাযাবরের ভাষায় বলা যায়, তিনি আমাদের দিয়েছেন বেগ, কেড়ে নিয়েছেন আমাদের আবেগ। বিগত ১৫ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মোকদ্দমা ও অত্যাচার-অনাচারকে শাসনের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা রজু করেন। এভাবে লাখ লাখ মানুষ মামলা-মোকদ্দমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, মানবেতর জীবনযাপন করে। যে গ্রামীণ নীড়গুলো ছিল শান্তির আবাস, সেগুলো অশান্তির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা হয়। বিশেষ করে ২০১১ সালে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি Village Politics-কে বিষাক্ত করে তোলেন। মামলা-মোকদ্দমাই শুধু নয়, গ্রামের বিরোধীদের গ্রাম ছাড়া করা, এমনকি ঘরে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। অতিমাত্রিক রাজনীতিকরণের ফলে আত্মীয় অনাত্মীয় হয়ে যায়, ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, পারা-পড়শির সেই সাবলীল সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। রাজনীতি এবং রাজনীতিই শুধু সব সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশ সমাজের গ্রামীণ অংশ ক্রমেই অস্থির হয়ে পড়ছিল। তাতে আওয়ামী রাজনীতিকরা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর গ্রামীণ সমাজে রাজনৈতিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ আরো বেড়েছে বৈ কমেনি। স্বাভাবিকভাবেই ১৭ বছরের নির্যাতিত মানুষেরা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। জনরোষে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব পালিয়ে যায়। গ্রামীণ শাসনের তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ শতভাগ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল। নির্বাচিত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রায় শতভাগ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এসব লোক পালিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ধস নামে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অরাজকতা দেখা দেয়। একরকম দ্বৈত শাসনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। যেহেতু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় নেতৃত্ব ছিল, সেই একই ধারায় জনগণ বিএনপিকে বিকল্প শক্তি হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু আইনগতভাবে তাদের কোনো বৈধতা না থাকায় বৈধতার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করে। এভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় উলুখাগড়ায় পরিণত হয় জনগণ। মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা, সালিশ ব্যবস্থায় স্থবিরতা এবং সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা-বিপত্তি বেড়ে যায়। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ করে। প্রধান রাজনৈতিক দল সংগতভাবেই এর বিরোধিতা করে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি শক্ত করতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চাইলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় গ্রামীণ সমাজে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় নেতৃত্বের এই কোন্দল প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ অসম্ভব অস্থিরতা, অরাজকতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ভবিষ্যৎ স্থানীয় নির্বাচনের আশায় সব দল তাদের প্রভাবজাল তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছে। তাতে সংঘাত আরো তীব্রতর হয়েছে। বাড়তি উৎপাত করছে পতিত আওয়ামী লীগ। তারা যেহেতু নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারছে না, তাই তারা হাসিনা স্বৈরাচারের নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র আঁটছে। গত শনিবার ফরিদপুরের জাজিরায় তারা বোমাবাজি ও সন্ত্রাস করেছে। তারা ভাবছে এভাবে সারাদেশে ভায়োলেন্স ছড়িয়ে দিয়ে তারা সফল হবে। অন্যদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দল ও শত্রুতা বেড়েই চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে যেসব ব্যবস্থায় শান্তি ও স্থিতি বজায় থাকে, তার মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ সালিশ ব্যবস্থা। এই গ্রামীণ সালিশ ব্যবস্থা আসলেই গ্রামীণ শান্তির একটি বড় নিয়ন্ত্রক। সালিশ ব্যবস্থারও আওয়ামী আমলে ক্রমেই দলীয়করণ ঘটে। মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু অস্থায়ী, সেহেতু গ্রামীণ দুষ্কৃতকারীরা মনে করে এটি দুর্বল সরকার। এখন তারা উৎপাত করার উৎকৃষ্ট সময় হিসেবে মধ্যবর্তী সময়কে বেছে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাম। গ্রামীণ সমাজের সুবিধা-অসুবিধা, বিরোধ-বিপত্তি ও আপত্তি সাধারণভাবেই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভাব ফেলে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শত চেষ্টা সত্ত্বেও পুরোপুরি আইন-শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। সালিশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই অচল অবস্থার অবসান হওয়া কঠিন। তাই জাতীয় তথা সংসদীয় নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক পর্যায়ে দলভিত্তিক প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পরিবর্তে নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের এসব ক্ষেত্রে পদায়ন প্রয়োজন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে আদালত পরিচালনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২০২৪ সালের বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনায় এসব আদালত হিমশিম খাচ্ছে। গ্রামীণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও সালিশ ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। গ্রামীণ পর্যায়ে যদি সেই শান্তির নীড় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়, তা হলে সরকারের উচিত শক্তভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়াস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা।
দেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। আওয়ামী লীগমুক্ত মাঠ রাজনীতির প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন করে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলের আভাস মিলছে। মধ্যম ও পেছনের সারির রাজনৈতিক দলগুলো নতুন করে অবহেলা-অনাদরের শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অবশেষে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে – এমন একটা স্বস্তির আবহ যখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে, তখন রোহিঙ্গারা এ নিয়ে কী ভাবছে? তারা কি আশ্বস্ত হয়েছে যে তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে? বিশেষ করে যারা মিয়ানমার সরকারের যোগ্যতার সূচকে দেশে ফেরার জন্য ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হয়েছে
১১ ঘণ্টা আগেএকাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছরে আমরা একটি জনগোষ্ঠীকে জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে দিইনি। বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেছে।
১৩ ঘণ্টা আগেএযাবৎ দেশে যত এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের ৯৫ ভাগ নিজেদের স্ত্রী-সন্তানকে পরবর্তী এমপি বানাতে চেয়েছেন, অনেকেই এই প্রচেষ্টায় কামিয়াব হয়েছেন। দেশের ৯৮ ভাগ মন্ত্রী নিজেদের পোষ্যকে মন্ত্রী করার খায়েশ প্রকাশ করে গেছেন।
১ দিন আগে