দিলারা চৌধুরী
পরাধীন ও অত্যাচারিত জনগণ যুগ-যুগান্তর ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে। অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে একসময় বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বল্পসংখ্যক ক্ষমতাবানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান সময় পর্যন্ত শৃঙ্খলিত মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শেষ হয়নি। বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী স্বল্পসংখ্যক ক্ষমতাধর যথেচ্ছচারের বিরুদ্ধে মানুষ যুগে যুগে রুখে দাঁড়িয়েছে। এদের কেউ বিপ্লবী, কেউবা শান্তিপ্রিয়; কিন্তু স্বপ্ন থাকে একটিই, সেটি হলো দেশ গড়ার স্বপ্ন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা, যার তুলনা হতে পারে একমাত্র ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল, তেমনি করে এই জুলাই অভ্যুত্থানে, যা জুলাই ৩৬, জেনারেশন জেড বা মনসুন গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। যা এ দেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। আশার সঞ্চার করেছে। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তরুণদের সরকারি চাকরিতে ন্যায্য অধিকার আদায় করার সংগ্রাম, তা এক দুর্বার ও অভিনবভাবে অতি দ্রুতগতিতে পরিণত হয়েছিল এক মুক্তিসংগ্রামে।
জাতির বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা ফ্যাসিস্ট হাসিনার তিল তিল করে গড়ে তোলা ফ্যাসিজম থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্তম্ভিত জাতি বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করেছিল, কীভাবে মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও পলায়ন।
অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই আন্দোলনের পটভূমিকা ছিল দীর্ঘ। বহু মানুষের ত্যাগ, তিতিক্ষা, নিপীড়ন, অত্যাচার আর জীবনের বিনিময়ে এই পটভূমিকা তৈরি হয়েছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণবিসর্জন দিয়েছে দুই হাজারের বেশি তরুণ ও আহত, পঙ্গু হয়েছে ত্রিশ হাজারের বেশি।
ইতিহাসে নানা কারণে বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান ঘটে। যেমন নানা রাজনৈতিক মতাদর্শ, নৈতিক নীতি বা শাসনের মডেল; যেমন- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ, গণতন্ত্র, উদারনীতি, বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান অনুপ্রেরিত করে। বাংলাদেশে বারবার গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। প্রথমটি ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার যুদ্ধ, যে যুদ্ধ মানুষ করেছে বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আর দ্বিতীয়টি সংঘটিত হয়েছিল একযুগব্যাপী এক কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক শাসনের অভিপ্রায়ে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি ভিন্ন।
এক যুগের বেশি চলা ফ্যাসিস্ট শাসনামলের নিপীড়ন, অত্যাচার ভোটাধিকার হরণ, গুম, খুন, দুর্নীতি, মানবাধিকার হরণ ইত্যাদিতে সিংহভাগ জনসাধারণ মুক্তির আশায় আকুল ছিল। তাই ছাত্রদের নেতৃত্বে যে সংগ্রাম, তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জনতা। শ্রমজীবী, প্রান্তিক, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক দলের কর্মী, সাংস্কৃতিককর্মী- সবাই শরিক হয়েছিলেন এই মুক্তির সংগ্রামে। জীবন বাজি রেখে শুরু করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও নতুন নয়। ১৯৭২-৭৫ সালে জাতি ফ্যাসিবাদের কিছু নমুনা পেয়েছিল কিন্তু তা ছিল স্বল্পমেয়াদি। ২০০৯ সাল থেকে নতুন করে ক্রমান্বয়ে ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু হয়। ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পরিণত হয়েছিল এক ব্যক্তির কর্তৃত্বাধীন। তার নেতৃত্বে ভঙ্গুর হয়েছে রাষ্ট্রের কাঠামো, সমাজ হয়েছে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। যেকোনো বিরোধী মতাদর্শের প্রতি নির্মম, নিষ্ঠুর শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট আমলে সবচেয়ে নির্যাতিত হয়েছে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। ১৫ বছরের অধিক সময়ে ৫৮ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করে ১ লাখ ৫২ হাজার মামলা দেওয়া হয়। ২ হাজার নেতাকর্মীকে ফরমায়েশি রায়ে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ১ হাজার ৯২৬ জন মৃত্যুবরণ করেন ক্রসফায়ারে। দলের সভাপতিকে মিথ্যা মামলায় জেলবন্দি করা হয়। এছাড়া বেপরোয়া পুলিশ ও আইনের শাসনের অভাবে নিগৃহীত হয় হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে হলে ছাত্রলীগের দ্বারা নিগৃহীত হয় হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র। দরিদ্র, শ্রমজীবী, শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে তারা রাজনৈতিক ও সামজিক পরিধির বাইরে চলে গিয়েছিল। তাদেরই শ্রম আর ঘামে তৈরি এক বিশেষ শ্রেণির দ্বারা ক্রমাগত ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সহায়তা করে চলেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাসিনা সরকারের ইসলামফোবিয়া নীতি। পাশ্চাত্যদের ইসলামের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও মোদির হিন্দুত্ববাদীর বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামফোবিয়া চলতেই থাকে। এতে ক্ষুব্ধ হয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। সরকারের এমন রূপ আগে দেখেনি বাংলাদেশের জনসাধারণ। ছাত্রদের নেতৃত্বে প্রাথমিক আন্দোলনে যে সাধারণ জনগণ যোগ দেবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মোটা দাগে তাই বলা যায়, এই জুলাই আন্দোলন ছিল ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির সংগ্রাম। এর সঙ্গে জড়িত হয় ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ভোটারবিহীন জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার উৎস কোথায়? অনুধাবন করা হয়, হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল হাসিনার টিকে থাকার মূলে। জনগণের মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হাসিনার সরকার ছিল ভারতের জন্য লাভজনক। এই আধিপত্যবাদ ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী, ক্ষতিকর, অপমানজনক ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তের প্রতি বেইমানি। যে কারণে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ওপর জমে থাকা ক্ষোভ ভারতবিরোধী ক্ষোভে পরিণত হয়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে।
এখন দেখা যাক, কোন মতাদর্শের দ্বারা এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ নৈতিক নীতি বা শাসনের মডেলের জন্য। তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার এই সংগ্রাম কোনো মৌলবাদী ইজমে উদ্বুদ্ধ হয়নি। মোটা দাগে নিপীড়িত জনগণ সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা কোনো শ্রেণিসংগ্রাম ছিল না, যদিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের কিয়দাংশ অভিজাতশ্রেণি এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। তা না হলে সংগ্রাম সফল হতো না। মূল কথা হলো এই ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদ পতনের পর যে গণতন্ত্র দেখতে চায়, তা যেন ১৯৭১-এর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুগ যুগ ধরে চলা গণতন্ত্রের নামে আপামর শাসকশ্রেণির ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার রাজনীতি বা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন। তাই দাবি উঠেছে সংস্কারের, যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকারের জনগণের সরকার। নতুন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যাতে ভবিষ্যতে যেন আর কোনো ফ্যাসিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে জনগণের এমনকি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে শাসক দলকে প্রতিটা ক্ষেত্রে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির দ্বারা আমাদের নতুন প্রজন্ম, যাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তারা কী চায়? কী তাদের স্বপ্ন? বোধগম্য এই যে, তারা চায় একটি গণতান্ত্রিক মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে সব ধর্মের সহাবস্থান। যেখানে থাকবে না ইসলামফোবিয়া। আর থাকবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সুযোগ এসেছে প্রগতিশীল আর ইসলামপন্থি শক্তিগুলোর কথোপকথন, সমঝোতা আর সহবস্থান। আমেরিকাপ্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর রশিদউজ্জামান বহু বছর আগে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে লেখালেখি করেছিলেন। এবার সুযোগ এসেছে। এ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না।
পরিশেষে দুটি জিজ্ঞাসা, প্রথমত ছাত্র-জনতার সংগ্রাম, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অংশীদারদের সঙ্গে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পর্দার অন্তরালে লুকানো শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি ও প্রতিষ্টানগুলো পরিপূর্ণভাবে একমত? নাকি সময়ের প্রেক্ষিতে মৌন সম্মতি দান করেছিল? দ্বিতীয়ত, যেকোনো গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবকে উদ্বুদ্ধ করতে একটি বয়ানের প্রয়োজন। ফরাসি বিপ্লবের বয়ান-স্বাধীনতা, সাম্য ও সহমর্মিতা তৈরি হয়েছিল রুশো ভলটিয়ারের লেখনীর দ্বারা। পরবর্তী সময়ে যা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানটি তেমন গভীরভাবে তৈরি হয়নি, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ তাই হোঁচট খেয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা অতি বিরল, যে সমাজ পনেরো বছর ধরে ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ঠ ছিল- যে সমাজে ফ্যাসিজম কায়েম করার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যক্তি অবনমন করা হয়েছে, যে সমাজে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিকেন্দ্র নেতার নামে এক সর্বশক্তিমান ও অবাধ্য পিতৃসত্তার প্রচার করে (এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের নাম) জনগোষ্ঠীকে, ফ্যাসিবাদতত্ত্ব বিশ্লেষক সমাজবিজ্ঞানী থিওডর অ্যার্ডোনার মতে, ‘র্যাবেল’ জনগোষ্ঠীকে পরিণত করেছিল, সেখানে কোন চোরাপথে এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিকা তৈরি হলো? এ দুটিই এখন গবেষণার বিষয়। জানাটা জরুরি, কারণ এর উত্তরের মাঝে লুকিয়ে আছে জুলাই বিপ্লবের সাফল্য।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক
পরাধীন ও অত্যাচারিত জনগণ যুগ-যুগান্তর ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে। অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে একসময় বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বল্পসংখ্যক ক্ষমতাবানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান সময় পর্যন্ত শৃঙ্খলিত মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শেষ হয়নি। বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী স্বল্পসংখ্যক ক্ষমতাধর যথেচ্ছচারের বিরুদ্ধে মানুষ যুগে যুগে রুখে দাঁড়িয়েছে। এদের কেউ বিপ্লবী, কেউবা শান্তিপ্রিয়; কিন্তু স্বপ্ন থাকে একটিই, সেটি হলো দেশ গড়ার স্বপ্ন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা, যার তুলনা হতে পারে একমাত্র ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল, তেমনি করে এই জুলাই অভ্যুত্থানে, যা জুলাই ৩৬, জেনারেশন জেড বা মনসুন গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। যা এ দেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। আশার সঞ্চার করেছে। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তরুণদের সরকারি চাকরিতে ন্যায্য অধিকার আদায় করার সংগ্রাম, তা এক দুর্বার ও অভিনবভাবে অতি দ্রুতগতিতে পরিণত হয়েছিল এক মুক্তিসংগ্রামে।
জাতির বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা ফ্যাসিস্ট হাসিনার তিল তিল করে গড়ে তোলা ফ্যাসিজম থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্তম্ভিত জাতি বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করেছিল, কীভাবে মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও পলায়ন।
অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই আন্দোলনের পটভূমিকা ছিল দীর্ঘ। বহু মানুষের ত্যাগ, তিতিক্ষা, নিপীড়ন, অত্যাচার আর জীবনের বিনিময়ে এই পটভূমিকা তৈরি হয়েছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণবিসর্জন দিয়েছে দুই হাজারের বেশি তরুণ ও আহত, পঙ্গু হয়েছে ত্রিশ হাজারের বেশি।
ইতিহাসে নানা কারণে বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান ঘটে। যেমন নানা রাজনৈতিক মতাদর্শ, নৈতিক নীতি বা শাসনের মডেল; যেমন- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ, গণতন্ত্র, উদারনীতি, বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান অনুপ্রেরিত করে। বাংলাদেশে বারবার গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। প্রথমটি ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার যুদ্ধ, যে যুদ্ধ মানুষ করেছে বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আর দ্বিতীয়টি সংঘটিত হয়েছিল একযুগব্যাপী এক কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক শাসনের অভিপ্রায়ে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি ভিন্ন।
এক যুগের বেশি চলা ফ্যাসিস্ট শাসনামলের নিপীড়ন, অত্যাচার ভোটাধিকার হরণ, গুম, খুন, দুর্নীতি, মানবাধিকার হরণ ইত্যাদিতে সিংহভাগ জনসাধারণ মুক্তির আশায় আকুল ছিল। তাই ছাত্রদের নেতৃত্বে যে সংগ্রাম, তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জনতা। শ্রমজীবী, প্রান্তিক, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক দলের কর্মী, সাংস্কৃতিককর্মী- সবাই শরিক হয়েছিলেন এই মুক্তির সংগ্রামে। জীবন বাজি রেখে শুরু করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও নতুন নয়। ১৯৭২-৭৫ সালে জাতি ফ্যাসিবাদের কিছু নমুনা পেয়েছিল কিন্তু তা ছিল স্বল্পমেয়াদি। ২০০৯ সাল থেকে নতুন করে ক্রমান্বয়ে ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু হয়। ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পরিণত হয়েছিল এক ব্যক্তির কর্তৃত্বাধীন। তার নেতৃত্বে ভঙ্গুর হয়েছে রাষ্ট্রের কাঠামো, সমাজ হয়েছে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। যেকোনো বিরোধী মতাদর্শের প্রতি নির্মম, নিষ্ঠুর শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট আমলে সবচেয়ে নির্যাতিত হয়েছে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। ১৫ বছরের অধিক সময়ে ৫৮ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করে ১ লাখ ৫২ হাজার মামলা দেওয়া হয়। ২ হাজার নেতাকর্মীকে ফরমায়েশি রায়ে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ১ হাজার ৯২৬ জন মৃত্যুবরণ করেন ক্রসফায়ারে। দলের সভাপতিকে মিথ্যা মামলায় জেলবন্দি করা হয়। এছাড়া বেপরোয়া পুলিশ ও আইনের শাসনের অভাবে নিগৃহীত হয় হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে হলে ছাত্রলীগের দ্বারা নিগৃহীত হয় হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র। দরিদ্র, শ্রমজীবী, শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে তারা রাজনৈতিক ও সামজিক পরিধির বাইরে চলে গিয়েছিল। তাদেরই শ্রম আর ঘামে তৈরি এক বিশেষ শ্রেণির দ্বারা ক্রমাগত ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সহায়তা করে চলেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাসিনা সরকারের ইসলামফোবিয়া নীতি। পাশ্চাত্যদের ইসলামের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও মোদির হিন্দুত্ববাদীর বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামফোবিয়া চলতেই থাকে। এতে ক্ষুব্ধ হয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। সরকারের এমন রূপ আগে দেখেনি বাংলাদেশের জনসাধারণ। ছাত্রদের নেতৃত্বে প্রাথমিক আন্দোলনে যে সাধারণ জনগণ যোগ দেবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মোটা দাগে তাই বলা যায়, এই জুলাই আন্দোলন ছিল ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির সংগ্রাম। এর সঙ্গে জড়িত হয় ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ভোটারবিহীন জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার উৎস কোথায়? অনুধাবন করা হয়, হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল হাসিনার টিকে থাকার মূলে। জনগণের মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হাসিনার সরকার ছিল ভারতের জন্য লাভজনক। এই আধিপত্যবাদ ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী, ক্ষতিকর, অপমানজনক ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তের প্রতি বেইমানি। যে কারণে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ওপর জমে থাকা ক্ষোভ ভারতবিরোধী ক্ষোভে পরিণত হয়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে।
এখন দেখা যাক, কোন মতাদর্শের দ্বারা এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ নৈতিক নীতি বা শাসনের মডেলের জন্য। তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার এই সংগ্রাম কোনো মৌলবাদী ইজমে উদ্বুদ্ধ হয়নি। মোটা দাগে নিপীড়িত জনগণ সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা কোনো শ্রেণিসংগ্রাম ছিল না, যদিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের কিয়দাংশ অভিজাতশ্রেণি এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। তা না হলে সংগ্রাম সফল হতো না। মূল কথা হলো এই ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদ পতনের পর যে গণতন্ত্র দেখতে চায়, তা যেন ১৯৭১-এর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুগ যুগ ধরে চলা গণতন্ত্রের নামে আপামর শাসকশ্রেণির ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার রাজনীতি বা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন। তাই দাবি উঠেছে সংস্কারের, যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকারের জনগণের সরকার। নতুন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যাতে ভবিষ্যতে যেন আর কোনো ফ্যাসিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে জনগণের এমনকি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে শাসক দলকে প্রতিটা ক্ষেত্রে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির দ্বারা আমাদের নতুন প্রজন্ম, যাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তারা কী চায়? কী তাদের স্বপ্ন? বোধগম্য এই যে, তারা চায় একটি গণতান্ত্রিক মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে সব ধর্মের সহাবস্থান। যেখানে থাকবে না ইসলামফোবিয়া। আর থাকবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সুযোগ এসেছে প্রগতিশীল আর ইসলামপন্থি শক্তিগুলোর কথোপকথন, সমঝোতা আর সহবস্থান। আমেরিকাপ্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর রশিদউজ্জামান বহু বছর আগে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে লেখালেখি করেছিলেন। এবার সুযোগ এসেছে। এ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না।
পরিশেষে দুটি জিজ্ঞাসা, প্রথমত ছাত্র-জনতার সংগ্রাম, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অংশীদারদের সঙ্গে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পর্দার অন্তরালে লুকানো শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি ও প্রতিষ্টানগুলো পরিপূর্ণভাবে একমত? নাকি সময়ের প্রেক্ষিতে মৌন সম্মতি দান করেছিল? দ্বিতীয়ত, যেকোনো গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবকে উদ্বুদ্ধ করতে একটি বয়ানের প্রয়োজন। ফরাসি বিপ্লবের বয়ান-স্বাধীনতা, সাম্য ও সহমর্মিতা তৈরি হয়েছিল রুশো ভলটিয়ারের লেখনীর দ্বারা। পরবর্তী সময়ে যা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানটি তেমন গভীরভাবে তৈরি হয়নি, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ তাই হোঁচট খেয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা অতি বিরল, যে সমাজ পনেরো বছর ধরে ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ঠ ছিল- যে সমাজে ফ্যাসিজম কায়েম করার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যক্তি অবনমন করা হয়েছে, যে সমাজে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিকেন্দ্র নেতার নামে এক সর্বশক্তিমান ও অবাধ্য পিতৃসত্তার প্রচার করে (এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের নাম) জনগোষ্ঠীকে, ফ্যাসিবাদতত্ত্ব বিশ্লেষক সমাজবিজ্ঞানী থিওডর অ্যার্ডোনার মতে, ‘র্যাবেল’ জনগোষ্ঠীকে পরিণত করেছিল, সেখানে কোন চোরাপথে এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিকা তৈরি হলো? এ দুটিই এখন গবেষণার বিষয়। জানাটা জরুরি, কারণ এর উত্তরের মাঝে লুকিয়ে আছে জুলাই বিপ্লবের সাফল্য।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক
বেশ কিছুদিন হলো ভারতের সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি অযাচিত মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত সরকার এলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হবে। এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হলো-একটি রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান কি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলতে পারেন?
১৫ ঘণ্টা আগেপ্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের তালিকায় ২০২৪ সালে বর্ষসেরা দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিরিয়া। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনা, এই দুই কুখ্যাত শাসকের পতনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে।
১৭ ঘণ্টা আগেগত ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার দিবাগত রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী ও স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা ভেঙে দিয়েছে ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি।
১৮ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। পরে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠেছিল। কিন্তু সেই সংস্কার কীভাবে হবে, কারা করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
১৯ ঘণ্টা আগে