Ad T1

বিমসটেক : এক সম্ভাবনার দুয়ার

হৃদয় পাণ্ডে
প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ৫৩
বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী সাতটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক জোটের নাম ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক)’। ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে সময়ের পরিক্রমায় এটি হয়ে উঠেছে পারস্পরিক আস্থা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। জোটটি যেমন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রসারে কাজ করছে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন, যেখানে সদস্য দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা একত্র হয়ে এই জোটের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন। এই সম্মেলনে গ্রহণ করা হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত দলিল ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’, যা আগামী দশকে বিমসটেকের কার্যক্রম পরিচালনায় একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতারা আঞ্চলিক সংহতি, অবকাঠামোগত সংযোগ ও যৌথ উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে আরো জোরদার করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশ আগামী দুই বছরের জন্য বিমসটেকের চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, যা দেশের জন্য একটি গৌরবজনক অর্জন এবং নেতৃত্ব প্রদানের বিরল সুযোগ।
বিমসটেকের মূল শক্তি হলো এর সদস্য দেশগুলোর ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য, যা একদিকে যেমন জোটকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। তবে এর মাঝেও বিমসটেক তার পথ খুঁজে নিচ্ছে, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকারকে সামনে রেখে একত্রে কাজ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতি এবং শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের মতো ছোট অথচ সম্ভাবনাময় দেশগুলোর অংশগ্রহণে এই জোটে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এই অঞ্চলটিকে আরো একতাবদ্ধ হতে হবে এবং বিমসটেক সেই প্রয়োজন মেটানোর অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে।
এই জোটের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ককেও আরো মজবুত করে তুলছে। যেমন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে বিদ্যুৎ রপ্তানিচুক্তি কিংবা ভারত ও ভুটানের মধ্যে অবকাঠামোগত সহযোগিতা—সবই বিমসটেকের প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়েই সম্ভব হয়েছে। একইভাবে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সমুদ্র নিরাপত্তা রক্ষা, জলদস্যু দমন এবং মানবপাচার রোধে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে।
তবে চ্যালেঞ্জও আছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, কিংবা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জটিলতা কখনো কখনো এই আঞ্চলিক উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করে। এ ছাড়া বিমসটেকের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি, পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্বলতাও একটি বড় সমস্যা। সেই কারণে ব্যাংকক ভিশনের আলোকে এখন প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত সচিবালয়, সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ এবং নিয়মিত মূল্যায়নের ব্যবস্থা।
তবে আশার কথা হলো, বিমসটেকের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’-এর মাধ্যমে এই জোট যেমন একটি কৌশলগত দিশা পেয়েছে, তেমনি সদস্য দেশগুলোর সদিচ্ছাও আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্য এটি এক অপূর্ব সুযোগ, যেখানে আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রদানের পাশাপাশি নিজেদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নকেও বহির্বিশ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, বিমসটেক এখন আর কেবল এক আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নয়, এটি হয়ে উঠেছে বাস্তবতায় রূপ নেওয়া একটি প্রত্যয়। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ছোট-বড় সব দেশই সমান গুরুত্ব পায়, আর পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে একে অপরের সঙ্গে কাজ করতে পারে। যদি সব সদস্য দেশ ঐক্য ও সহনশীলতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যায়, তবে বিমসটেক কেবল এশিয়ার নয়, বিশ্বের জন্যও একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে, যেখানে আঞ্চলিক সংহতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক মিলন এক সুতোয় গাঁথা থাকবে।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত