Ad T1

চার দিনের সংঘাত

হঠকারী যুদ্ধে জড়িয়ে বিপর্যয় ভারতের

বশীর আহমেদ
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৫, ১০: ৫০

অপারেশন সিঁদুরের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাফায়েলসহ পাঁচ যুদ্ধবিমান হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে ভারত। এ ধরনের লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা হয়তো ভারতের কল্পনায়ও ছিল না।

এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তানের আসল প্রতিক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় গোটা ভারতে। অবশেষে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েই শুরু করে ‘অপারেশন বুনিয়ানুম মারসুস’। শত শত ড্রোন আর মিসাইল দিয়ে ভারতের বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বৃষ্টির মতো হামলা চালায় পাকিস্তান। এ হামলায় ভারত রীতিমতো বিপর্যস্ত। ৫০ জনের বেশি সেনা হারানোর পাশাপাশি অনেকগুলো সামরিক পোস্ট ধ্বংস হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে তারা ঠিক কী করবে, সে সিদ্ধান্তই নিতে পারছিলেন না ভারতের নীতিনির্ধারকরা। অবশেষে কারগিল যুদ্ধের মতো এবারও ভারতের ত্রাণকর্তা হিসেবে আভির্ভূত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধেও রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়েছিল ভারত।

সে সময় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দারস্থ হয়েছিল ভারত। এবারও হয়তো একই ঘটনা ঘটেছে। কারণ এবারকার যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ২৪ ঘণ্টারও কময় সময় আগে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না তারা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়ই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো। যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো, তা মোদির ভারতের জন্য মোটেও সুখকর স্মৃতি নয়।

ভারতের নিরপত্তা নীতি আর যুদ্ধ কৌশল এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে। খোদ ভারতীয় সমরবিদরা এখন প্রশ্ন তুলছেন। ভারত কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো, সে প্রশ্ন জোরলো হচ্ছে।

অপারেশন সিঁদুর নিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি বিশ্লেষণধর্মী ভিডিও প্রকাশ করেন ভারতের বিশিষ্ট সমরবিদ এবং ফোর্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রভিন সনি। ওই ভিডিও আলোচনায় তিনি শুধু সামরিক অভিযানের বিশ্লেষণ নয়; বরং ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই বিশ্লেষণ পছন্দ হয়নি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের, যে কারণে ভারতে ওই ভিডিও ব্লক করে দেওয়া হয়।

ভিডিওটির শুরুতেই অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রভিন সনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে অফিসিয়াল প্রেস ব্রিফিং এসেছে, তাতে বলা হয়েছেÑ ভারতীয় বিমানবাহিনী সীমান্তরেখা অতিক্রম না করেই আক্রমণ করেছে। এ আক্রমণে পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি সন্ত্রাসী শিবিরে হামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল ভাওয়ালপুরে। সুতরাং আমরা এখানে সীমান্তরেখা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি লক্ষ্যবস্তুর কথা বলছি। ওই লক্ষ্যবস্তুগুলো সামরিক ছিল না।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি যে প্রেস ব্রিফিং করেন, তাতে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। পুরো অভিযান ভারতীয় বিমান বাহিনী করলেও তিনি কোথাও বিমান বাহিনীর নাম উল্লেখ করেননি। মিশ্রির বক্তব্যের ব্যাখ্যার দরকার আছে, কেন তিনি ‘ভারতীয় বিমান বাহিনী’ না বলে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ বললেন।

প্রভিন বলেন, আমি যখন বিভিন্ন ঘটনা মিলিয়ে দেখি, তখন দেখি শ্রীনগরের বেসামরিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং একটি ভারতীয় জেট ভেঙে পড়েছে, যার টুকরাগুলো দক্ষিণ কাশ্মীরের পামপোর অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদস্য এবং কমান্ডোরা সেখানে এসে এলাকাটি ঘিরে ফেলেছেন। তিনি আরো বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরে এরকম তিনটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেছে। এর মানে ৭ মে রাতে জম্মু ও কাশ্মীরে অন্তত তিনটি জেট ‘দুর্ঘটনায়’ পড়ে এবং প্রতিটি স্থানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন।

একই ভাবে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং দ্য হিন্দুতে সংবাদ আসে বাঠিন্ডা বিমানঘাঁটির কাছে একটি জেট বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে একজন নিহত এবং ৯ জন আহত হয়েছে। যদিও হিন্দু ওই সংবাদ প্রকাশের ৪৫ মিনিটের মধ্যে প্রত্যাহার করে। সুতরাং এখানে আমরা চারটি জেট দুর্ঘটনার কথা বলছি, যেখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি এগুলো কী ধরনের প্লেন ছিল বা যুদ্ধবিমান কি-না। ভারতীয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা সেখানে কেন ছিলেন, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রির ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন ছিল। অথচ তিনি তা পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। তার ব্যাখ্যা এজন্যই প্রয়োজন ছিল, কারণ পাকিস্তান বিমান বাহিনী দাবি করেছে তারা ভারতীয় বিমান বাহিনীর চার বা পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।

কী করে এমন ‘কাকতালীয়ভাবে’ ৬ ও ৭ মে রাতে জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে এ ‘দুর্ঘটনাগুলো’ ঘটল বিক্রম মিশ্রি তার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বলেন, অভিযান এখনো চলছে।

প্রভিন বলেন, আমি মনে করি এ অভিযান আসলে এখানেই শেষ হয়ে গেছে। কারণ আপনি যদি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দাবি দেখেন, তারা ইতোমধ্যেই তাদের পরিকল্পিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। তাদের আর কিছু করার নেই। তবে ভারতের তরফে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার আছে।

প্রভিন বিক্রম মিশ্রির বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, অবশ্যই এবারকার পদক্ষেপ সতর্কতার সঙ্ড়ে নেওয়া হয়েছিল, যা আমি আমার আগের ভিডিওগুলোয়ও বলেছি। কারণ যদি এবার ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করত, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া হতো কঠোর ও দ্রুত।

আপনি যদি ২০১৯ সালের অপারেশন ‘বান্দার’ দেখেন, সেখানে তারা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল এবং পরদিন পাকিস্তান বিমান বাহিনী ‘অপারেশন সুইফট রিটর্ট’ চালায় এবং আমরা জানি ওই অভিযানে কী ঘটেছিল।

কোনো যুদ্ধেই ভারতীয় সেনাবাহিনী কখনো পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। প্রচুর প্রযুক্তি এসেছে পাকিস্তান এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীতে। ফলে বিমান বাহিনী এখন যুদ্ধজয়ের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। বিমানশক্তির ভূমিকা যুদ্ধজয়ে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কৌশলগত ভুলে ভারতের বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনী দুটিরই প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষয় হচ্ছে। অপারেশন সিঁদুরে আমরা দেখেছি ভারতীয় বিমান বাহিনীর সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকাশ পেয়ে গেছে। শত্রু বুঝে যাচ্ছে আপনার সামরিক শক্তি দুর্বল হচ্ছে, শক্তিশালী নয়।

মিশ্রি বলেছেন আমরা অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাস্তি দিয়েছি এবং প্রতিরোধ করেছি। বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। ডিটারেন্স বা প্রতিরোধ করা মানে হচ্ছে আপনাকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যেতে হবে না। ডিটারেন্স হলো শত্রু আপনার সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর শক্তি দেখে সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। এটিই হলো ডিটারেন্স।

কিন্তু আপনি যদি বারবার আপনার বিমান বাহিনীকে সীমিতভাবে ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি আপনার ডিটারেন্স বাড়াচ্ছেন না বরং কমাচ্ছেন। তাই সবাইকে সততার সঙ্গে ভাবতে হবেÑ ‘অপারেশন সিঁদুর’ কী অর্জন করেছে, কী অর্জন করা উচিত ছিল এবং এটি আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কি-না।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত