দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস নিষেধাজ্ঞার পর চলতি ডিসেম্বরের শুরু থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের রাতযাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এতে ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ বহুগুণ বেড়েছে। তবে আগ্রহের বিপরীতে বেড়েছে ভ্রমণ ব্যয় ও ভোগান্তি। বিশেষ করে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের টিকিট সংকট ও দীর্ঘ যাত্রাপথ পর্যটকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্যটকদের অভিযোগ, কমপক্ষে ২০ দিন আগে টিকিট না কাটলে সেন্টমার্টিনে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেক আশা ও উৎসাহ নিয়ে দ্বীপে গেলেও আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে, পাশাপাশি পোহাতে হচ্ছে বিভিন্ন দুর্ভোগ।
বর্তমানে কক্সবাজারের নুনিয়াছড়া ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়া-আসার সর্বনিম্ন ভাড়া জনপ্রতি তিন হাজার ৫০০ টাকা। একটু ভালো ক্লাসে ভ্রমণ করতে চাইলে খরচ বাড়বে কমপক্ষে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা। অথচ আগে টেকনাফ জেটিঘাট থেকে মাত্র এক হাজার টাকায় ভালো ক্লাসে যাওয়া-আসা করা যেত। এমনকি কম খরচে ভ্রমণ করতে চাইলে এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যেই শিপের আপ-ডাউন টিকিট পাওয়া যেত।

খরচের পাশাপাশি বেড়েছে যাত্রার সময়ও। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে আগে যেখানে সময় লাগত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা, বর্তমানে কক্সবাজার থেকে যেতেই সময় লাগছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। এতে আনন্দের ভ্রমণ অনেকের জন্যই শুরুতেই বিরক্তিকর হয়ে উঠছে, যা ফেরার পথে আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
সরেজমিন সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে দেখা যায় চরম অব্যবস্থাপনা। পুরোনো জেটিঘাটে বর্তমানে মেরামতের কাজ চলমান থাকলেও যাত্রীদের বসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ফলে আগেভাগে আসা যাত্রীদের বালুর ওপর দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে। জেটিঘাটে নামা ও দ্বীপে প্রবেশের পুরো প্রক্রিয়া অনেকের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে।
গত ১০ ডিসেম্বর বিকাল ৫টায় সেন্টমার্টিন জেটিঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ার কথা থাকলেও দুটি জাহাজ সেখানে পৌঁছায় নির্ধারিত সময়ের পর। এতে যাত্রী ওঠা-নামার সময় তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। জেটিঘাটের মূল অংশে যাওয়ার আগের সরু রাস্তার কাজ চলমান থাকায় ঝুঁকি আরো বেড়েছে। সরু রাস্তাটির কোথাও নামমাত্র বাঁশের রেলিং থাকলেও অনেক জায়গা পুরোপুরি ফাঁকা, যা শিশু ও বয়স্ক পর্যটকদের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।
স্থানীয়দের মতে, দুই বছর আগে টেকনাফ থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার সাগরপথ পাড়ি দিতে সময় লাগত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। আসা-যাওয়া ও আবাসনসহ মোট খরচ এক থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে সারা যেত, যা বর্তমানে কল্পনাও করা যায় না।
এদিকে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে পর্যটকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আগে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাতায়াত করলেও এখন তা অনেক কমে গেছে।
একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কর্মরত পর্যটক আরিফুর রহমান বলেন, আমি আগেও তিনবার সেন্টমার্টিনে এসেছি। কিন্তু এবারের ভ্রমণে আনন্দ অনেকটাই কমে গেছে। একদিকে খরচ অনেক বেড়েছে, অন্যদিকে শুধু আসা-যাওয়াতেই ১২ ঘণ্টার বেশি সময় চলে যাচ্ছে। যারা প্রথমবার আসছেন, তাদের কাছে হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থাকায় আমার কাছে দীর্ঘ এ যাত্রা ভীষণ বিরক্তিকর মনে হচ্ছে।
সেন্টমার্টিনের রিসোর্ট ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, পরিবেশদূষণের অজুহাতে যেভাবে পর্যটন বন্ধ রাখা হয়েছে, সেভাবে যদি টেকনাফ থেকে আসা প্লাস্টিক ও দূষণকারী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হতো, তাহলে দ্বীপের মানুষের জীবনমান উন্নত হতো। দুই মাসের আয়ে মানুষ কীভাবে ১০ মাস চলবেÑএ প্রশ্ন তো থেকেই যায়। পর্যটক বন্ধ না করে পরিবেশ দূষণকারী পণ্য বন্ধ করা জরুরি।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মাহফুজুল আলম বলেন, আমি নিজেও বয়স্ক, সঙ্গে ছোট নাতিদের নিয়ে এসেছি। জেটিঘাটের সামান্য রাস্তাটুকু পার হতে আমার ভীষণ ভয় লেগেছে। এখানে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সরকারের উচিত ছিল ডিসেম্বরের ১ তারিখের আগেই সব কাজ শেষ করা। মানুষ অনেক টাকা খরচ করে পরিবার নিয়ে একটু আনন্দ পাওয়ার জন্যই এখানে আসেন। কিন্তু সরকারের অবহেলার কারণে সে আনন্দ যেকোনো সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ আমার দেশকে বলেন, পর্যটকরা যাতে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পর্যটকদের ভোগান্তি কমাতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমামুল হাফিজ নাদিম আমার দেশকে বলেন, সেন্টমার্টিনে চলমান উন্নয়ন ও মেরামতকাজ দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

