দেশের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে থাকা বিপুল ঋণের চাপেই ধসের মুখে পড়েছে এবি ব্যাংক। এক সময় গ্রাহকসেবায় সুনাম কুড়ানো প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকটি এখন গভীর আর্থিক সংকটে। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট ঋণের ৮৪ শতাংশ। মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই আটকে আছে বড় গ্রহীতাদের কাছে। এসব অনাদায়ী অর্থই ব্যাংকের মূলধন, প্রভিশন ও তারল্য সংকটকে চরমে ঠেলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জরুরি তারল্য সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এবি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩৫ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ১১৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৯৪০ কোটি বা ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল চার হাজার ২৯৯ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, আগে যেসব ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য ছিল, তখন তা করা হয়নি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে গোপন ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করা হয়। এতেই খেলাপি ঋণের হার অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। মূলত ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলেও ভালো দেখানোর জন্য এমনটি করা হয়েছিল। খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় অন্যান্য সূচকে অবনতি হয়েছে।
এবি ব্যাংকের বিরুদ্ধে খেলাপি ঋণ গোপন করার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনেও উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবি ব্যাংক খেলাপিযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি না করে নিয়মিত দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আসছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এর আগের তিন বছর সেপ্টেম্বরভিত্তিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি
ছিল না। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারায় বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে এবি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ৯২ কোটি টাকা। জুন শেষে মূলধন ঘাটতি ছিল ছয় হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। মার্চে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বরে ছিল মাত্র ৫১৭ কোটি টাকা।
এদিকে, ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক সংকট সামনে আসার পর আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চেয়েছে এবি ব্যাংক, যেন তারা প্রতিদিনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর আগে সংকট মেটাতে ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। গত ৩০ নভেম্বর নতুন করে আরো এক হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চাওয়া হয়।
শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৯ শতাংশই আটকে আছে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে। এসব খেলাপির কাছে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এককভাবে এক হাজার ৩৯৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে বিল্ডট্রেড ফয়েলস লিমিটেড শীর্ষ রয়েছে। এটি বিল্ডট্রেড গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের আরো দুটি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাংকে ঋণখেলাপি। এর মধ্যে অ্যালয় কোট লিমিটেড এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা এবং বিল্ডট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৯১১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। ফলে এই গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা।
বিল্ডট্রেড গ্রুপের পর এক হাজার ২১৩ কোটি টাকার খেলাপি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মাহিন এন্টারপ্রাইজের খেলাপি এক হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। চতুর্থ অবস্থানে থাকা বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-১ লিমিটেডের খেলাপি এক হাজার দুই কোটি টাকা।
পর্যায়ক্রমে শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—ক্রিয়েটিভ ট্রেড ৭৮৫ কোটি টাকা। প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম ৭২৩ কোটি, যার মালিক এম মোরশেদ খান। বেল কনস্ট্রাকশন ৬৯৯ কোটি, যা সিকদার গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান, এর মালিক রিক হক সিকদার। আশিয়ান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আশিয়ান এডুকেশন ৬১৩ কোটি, আরডেন্ট সিস্টেম ৫৯১ কোটি, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ৫৭০ কোটি, অ্যাস্ট্রাম পাবলিকেশনস ৫৬৯ কোটি, এসএস স্টিল ৫৫১ কোটি, রাইজিং স্টিল ৫২৮ কোটি এবং গ্র্যান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ ৪৭৯ কোটি টাকা। এছাড়া আরঅ্যান্ডআর হোল্ডিং ৪৬৮ কোটি, যা সিকদার গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান, এর মালিক রন হক সিকদার। সালেহ স্টিল ইন্ড্রাস্টিজ ৪৬৫ কোটি, এজিস টেক্সটাইল মিলস ৪২৪ কোটি এবং জারিন ফার্মস লিমিটেড ৪২৩ কোটি টাকা।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের কাছে দীর্ঘদিন ঋণের অর্থ আটকে আছে। অর্থ আদায়ে ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলমান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, আমরা সব গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার ও নীতি সহায়তার অধীনে যেভাবে টাকা আদায় করা যায়, সে চেষ্টা চালাচ্ছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও লক্ষ্য খেলাপি ঋণ কমানো। সে অনুযায়ী কাজ করছি।


পিলখানা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন কমান্ডো এনএসজিসহ ২৪ ভারতীয়
ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি অনুমোদন দিলো রুশ পার্লামেন্ট
সরকারকে না জানিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা