ব্যাংকগুলোর বহিঃনিরীক্ষার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ফি নির্ধারণ করার তিন মাসের মাথায় তা শিথিল করতে যাচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)। প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে নিরীক্ষা ফি নির্ধারণে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে অডিটরদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আগামী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কাউন্সিলের পরবর্তী বৈঠকে নিরীক্ষা ফি শিথিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এফআরসি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া আমার দেশকে বলেন, নিরীক্ষা ফি শিথিলের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে এবং কাউন্সিলের পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। তিন মাসের মাথায় কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে এবং কারো চাপের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ও আমানতের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নিরীক্ষা ফি ৭০ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩ টাকা এবং সর্বনিম্ন ফি হচ্ছে ১৪ লাখ ৩৮ হাজার ৭২৪ টাকা। গত ৩১ আগস্ট ব্যাংকগুলোর বহিঃনিরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নিরীক্ষক কোম্পানিগুলোর তদারকি প্রতিষ্ঠানটি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বহিঃনিরীক্ষা ফি ধার্য করা সীমার বেশি হতে পারবে না। ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি কার্যকর হওয়ার আগেই নিরীক্ষা ফির সীমা শিথিল করতে যাচ্ছে এফআরসি।
জানা গেছে, সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এফআরসির নির্ধারিত সীমার কম বা বেশি ফি নিতে পারবে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে তা এফআরসিকে অবহিত করতে হবে। তবে এ জন্য এফআরসির কাছ থেকে আলাদাভাবে অনুমোদনের বিষয়টি থাকছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষা ফি নির্ধারণে এফআরসির ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন আমার দেশকে বলেন, ব্যাংকের ক্ষেত্রে এফআরসির বহিঃনিরীক্ষা ফির যে সীমা নির্ধারণ করেছে, সেটার পরিমাণ কম বলেই মনে হচ্ছে। একটি মানসম্মত নিরীক্ষার জন্য অবশ্যই ফির পরিমাণ বাড়ানো উচিত। ফির পরিমাণ কম হলে কখনো ভালো মানের নিরীক্ষা আশা করা ঠিক হবে না। এফআরসি প্রয়োজনবোধে নিরীক্ষা ফির বিষয়ে পর্যালোচনা করতে পারে। কিন্তু যে ফি নির্ধারণ করবে, সেটা অবশ্যই সবাইকে অনুসরণ করতে হবে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিংবা প্রভাবশালী মহলের চাপ উপেক্ষা করেই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাজ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৫ সালে গঠিত হওয়ার পর চলতি বছরের আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোর বহিঃনিরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে এফআরসি। ফি নির্ধারণের বিষয়ে ওই সময় এফআরসি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া আমার দেশকে বলেছিলেন, ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষা ফি নির্দিষ্ট না থাকার কারণে এ নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ছিল। এখন এফআরসি ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। নির্ধারিত সীমার মধ্যেই অডিটরদের ফি নিতে হবে। এই সীমার কমও নেওয়া যাবে না, আবার বেশিও নেওয়া যাবে না। ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তিনি।
জানা গেছে, গত বছরের ৯ জুলাই ব্যাংকগুলোর আর্থিক হিসাব বিবরণী নিরীক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক কোম্পানি বহিঃনিরীক্ষণ বিধিমালা, ২০২৪’ জারি করে। ওই বিধিমালায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে যে ধরনের অডিট প্রয়োজন সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর বহিঃনিরীক্ষক হিসেবে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব ফার্মের ফি নির্ধারণের কথাও বলা হয়েছে। সে হিসাবে অডিটরদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এফআরসি ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষকদের ফি নির্ধারণে গত ১৮ জুন একটি কমিটি গঠন করে।
এফআরসি চেয়ারম্যানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, আইসিএবি ও এফআরসির প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে নিরীক্ষা ফি চূড়ান্ত করা হয়।
বহিঃনিরীক্ষা ফি নির্ধারণে ব্যাংকের জনবলের শ্রেণি ও মোট সম্পদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের রেঞ্জ অনুসারে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা হয়। জনবলের শ্রেণির মধ্যে রয়েছে এনগেজমেন্ট পার্টনার (সিএ), রিভিউ পার্টনার (সিএ), অডিট ডিরেক্টর/ম্যানেজার (সিএ), অডিট সুপারভাইজার, অডিট ইনচার্জ, অডিট স্টাফ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্র) ও টেকনিক্যাল স্টাফ। এসব জনবলের ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন হার, কর্মঘণ্টা, মাসিক ভাতা এবং ব্যাংকের মোট সম্পদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বিবেচনায় নিয়ে নিরীক্ষার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। যে ব্যাংকের সম্পদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেশি সে ব্যাংকের নিরীক্ষা ফি বেশি নির্ধারণ করা হয়।

