দেশে তিনবার গণভোট: কোন ভোটে কত শতাংশ কাস্ট হয়েছিল?

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৫৪

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।এতে বলা হয়েছে—সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।

তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে নাকি একই সঙ্গে হবে।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রশাসনিক গণভোট এবং আরেকটি সাংবিধানিক গণভোট। প্রথম গণভোট হয়েছিল— রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে। দ্বিতীয় গণভোট হয়— রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে। সবশেষ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।

গণভোটের প্রেক্ষাপট

প্রথম গণভোট: জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। উদ্দেশ্য ছিল সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়া জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা দেওয়া। রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা আছে কিনা, সে বিষয়ে দেশের জনগণের মতামত জানতে ওই গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল।

১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে গণভোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ওই বছরের সারা দেশে ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ৩০ মে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট নেওয়া হয়। ওই সময় দেশে মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সেই গণভোটে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছিল ১ দশমিক ১ শতাংশ।

দ্বিতীয় গণভোট: ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দেশে দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচি এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের ওপর জনগণের আস্থা আছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য ওই গণভোটের আয়োজন হয়েছিল। আগের মতোই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এই পদ্ধতিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জনগণের আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে ‘না’ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, সেই গণভোটে ভোট পড়েছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট ছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

তৃতীয় গণভোট: গণ আন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। এর ৩ মাসের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সংসদীয় পদ্ধতির (পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি) সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট মধ্যরাতে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে বিল পাস হয়।

জানা যায়, এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে গৃহীত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্মতি দেবেন কি না, সে প্রশ্নে দেশব্যাপী গণভোট আয়োজনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

দেশের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত সেই তৃতীয় গণভোটে ভোট পড়ে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮ হাজার ৩৭৭ জন ভোটার সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে, অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন। এই হার ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে ৩৩ লাখ ৯০ হাজার ৬২ জন ভোটার ‘না’ ভোট দেন। অর্থাৎ তারা রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। ‘না’ ভোটের হার ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। গণভোটে ৯৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বৈধ ভোটের বিপরীতে বাতিল হয়েছিল শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোটা।

এদিকে রাষ্ট্র সংস্কারবিষয়ক জাতীয় জুলাই সনদ চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। এনসিপি ছাড়া জুলাই আন্দোলনের পক্ষের প্রায় সব দলই এই সনদে স্বাক্ষর করে। এছাড়া ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরা এতে সই করেন। সনদ সইয়ের পর এর বাস্তবায়ন নিয়ে সুপারিশ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

গত মঙ্গলবার ‘জাতীয় জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নে আদেশ’ শিরোনামে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। এতে ৮৫টি সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ৯টি নির্বাহী আদেশে। ২৮টি আইন প্রণয়ন/সংশোধন (অধ্যাদেশ জারি) করে এবং সংবিধান সম্পর্কিত বাকি ৪৮টি বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। পাশাপাশি আদেশের প্রশ্নে গণভোট ও আগামী জাতীয় সংসদে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ কয়েকটি দলের ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে তা রাখা হয়নি।

জানা গেছে, সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবের ২৬টির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির একটি করে নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও বিএনপির বেশ কয়েকটি ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। বিএনপির নোট অব ডিসেন্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি না থাকা, চারটি সাংবিধানিক পদ অর্থাৎ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, ন্যায়পাল এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিয়োগ স্পিকারের মাধ্যমে নিয়োগ, সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন, আপিল বিভাগের জেষ্ঠতম ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ।

সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশে গণভোটের সুপারিশ করা হলেও এর দিনক্ষণ সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার চাইলে নির্বাচনের আগে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন করতে পারবে। বিএনপি চাচ্ছে—ভোটের দিন, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নির্বাচনের আগে। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী সুনির্দিষ্টভাবে নভেম্বর মাসে গণভোট চেয়েছে। নভেম্বরে গণভোট আদায়ে দলটি এরই মধ্যে রাজপথে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত