পরিকল্পনার অভাবে বাড়ছে লোকসান

কবিতা
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২: ১৮

সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের লোকসান বাড়ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আধুনিক উড়োজাহাজ। কমে যাচ্ছে এসবের স্থায়িত্ব, বাড়ছে ব্যয়। এ সুযোগে বাড়ছে আকাশপথে চোরাচালান।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ৫ মে বিমানসহ অন্যান্য বেসরকারি এয়ারলাইনসকে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, একই ফ্লাইটে আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের সঙ্গে কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। কিন্তু এটি এখনো কার্যকর করা হচ্ছে না। বিমানের লোকসান কমাতে, স্বর্ণ চোরাচালান, মুদ্রাপাচার রোধ ও উড়োজাহাজের সুরক্ষা, ইঞ্জিনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রোধকল্পে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে এই চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। ৫ থেকে ৬ মাস আদেশটি কার্যকর করা হলেও পরবর্তীতে তা আর মানছে না বিমান।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, বিমান বহরে আধুনিক উড়োজাহাজের সংযোজন করা হলেও বড় উড়োজাহাজগুলো দিয়ে স্বল্পদূরত্বের রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করায় একদিকে বিমানের ব্যয় বাড়ছে; অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উড়োজাহাজের অক্সিলিয়ারি পাওয়ার ইউনিট, ল্যান্ডিং গিয়ার, ইঞ্জিন। বেশি হচ্ছে জ্বালানি খরচ।

বড় উড়োজাহাজ যেমন বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ও ড্রিমলাইনার-৭৮৭ দিয়ে স্বল্পদূরত্বে উড়োজাহাজ পরিচালনা করা হলে উড়োজাহাজের ব্যয় অনেক বেশি পড়ে। ল্যান্ডিং সাইকেল ইনভল্প হয়ে যায়। ফলে প্রয়োজন হয় ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ার সি-চেকের। ফলে বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এ ধরনের বড় উড়োজাহাজগুলো তৈরি করা হয় লংরুটের ফ্লাইটের জন্য। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য ড্যাশ-৮ বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ তৈরি করা হয়।

এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীদের একই ফ্লাইটে পরিবহন করায় স্বর্ণ এবং মুদ্রা চোরাচালানের ঝুঁকি বাড়ছে। সূত্র জানায়, একজন যাত্রী লন্ডন থেকে সিলেটে যাবেন, তিনি হয়তো ফ্লাইটে স্বর্ণ বা ডলার নিয়ে এলেন। তিনি ডমিস্টিকের যাত্রীকে স্বর্ণ বা ডলার দিয়ে দিলেন। ওই যাত্রী তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে বের হয়ে গেলেন। কারণ ডমিস্টিকে সিকিউরিটি চেক হয় না।

একইভাবে দুবাই রুটেও বিমান ত্রিমুখী ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। এভাবে ত্রিমুখী রুটে চোরাচালানের ঝুঁকি থাকে বেশি। বর্তমানে ত্রিমুখী ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে ঢাকা-সিলেট-ম্যানচেস্টার, ম্যানচেস্টার-সিলেট-ঢাকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা, জেদ্দা-চট্টগ্রাম-ঢাকা, ঢাকা-সিলেট-মাসকাট, মাসকাট-সিলেট-ঢাকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম-দুবাই ও দুবাই-চট্টগ্রাম-ঢাকা। কিন্তু পরিচালিত হতে হবে চট্টগ্রাম-জেদ্দা, জেদ্দা-চট্টগ্রাম, জেদ্দা-ঢাকা, চট্টগ্রাম-মাসকাট, মাসকাট-চট্টগ্রাম ও মাসকাট-ঢাকা।

এদিকে স্বল্পদূরত্বের রুটে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ও বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করার ফলে উড়োজাহাজগুলো সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। যার ফলে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআরগুলোয় বর্তমানে ঘন ঘন টেকনিক্যাল ত্রুটি হচ্ছে। ফলে বাড়ছে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ।

বিমান সূত্র জানায়, বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর অনেক বড় উড়োজাহাজ। এই উড়োজাহাজের কার্গো পরিবহনের ক্ষমতাও অন্যান্য উড়োজাহাজের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু বিমান এগুলোকে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। পৃথিবীর সব দেশেই এই উড়োজাহাজগুলো দিয়ে এয়ারলাইনসকে লাভজনক করা হয়। কিন্তু বোয়িং-৭৭৭-এর সঙ্গে বিমান সব সময় বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে।

করোনার সময় এই উড়োজাহাজগুলোকে কার্গো ফ্লাইট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে ভেতরেই অনেক কিছুই ভেঙে যায়। অথচ এমিরেটস, কাতার এয়ারলাইন্স ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টার লম্বা রুটের ফ্লাইটগুলো বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর দিয়ে করে থাকে। এগুলো যে কোনো এয়ারলাইনসের মেরুদণ্ড।

সূত্র জানায়, দুই সেক্টর ল্যান্ডিং এবং ফ্লাইটের সময় দীর্ঘ হলে তিনজন ককপিট ক্রু প্রয়োজন হয়। এতে ব্যয় বাড়ে। ক্রুদের খাবার, হোটেল খরচ সবই এখানে যোগ হয়ে যায়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একজন পাইলট জানান, কৃত্রিম পাইলট সংকট সৃষ্টি করার জন্য এ ধরনের শিডিউল করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী বিমানের উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ার ৩ বছরে সাড়ে ৩ হাজার সাইকেল ঘুরলে তার জন্য সি-চেক বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

একটি সি-চেক করাতে ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়। চাকার সার্কেল আগেই শেষ হয়ে গেলে তখন নির্ধারিত সময়ের আগেই সি-চেক করাতে হয়। অথচ এই স্বল্পদূরত্বে নির্ধারিত ছোট উড়োজাহাজ ড্যাশ-৮ ও বোয়িং-৭৩৭ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা হলে ব্যয় অনেক কমে যাবে। এটি অনেক লাভজনক। ফলে ককপিট ক্রুদের কর্মঘণ্টাও কমে যাবে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ বোসরা ইসলাম এ বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, ২০২৩-২৪ সালে বিমানের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন শফিউল আজিম। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে কথা বলেই আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীদের পরিবহন করা হয়েছে। বিমান সব সময় চাইবে কীভাবে লাভজনক করা যায়Ñ সেভাবে কাজ করতে।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, একই ফ্লাইটে আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের সঙ্গে কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। জারি করা ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি বা নতুন করে কোনো চিঠিও ইস্যু করা হয়নি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

বিমান
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত