খুশি বিএনপি, ক্ষুব্ধ অন্যরা

স্বাক্ষর সত্ত্বেও জুলাই সনদ বিতর্ক চলছেই

মাহফুজ সাদি
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ০১
ফাইল ছবি

জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেও সবার স্বাক্ষর এখনো পাওয়া যায়নি। বহুল প্রত্যাশিত রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে স্বাক্ষরপর্বে যাওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। সনদে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নতুন দল এনসিপিসহ কয়েকটি দল সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

বাস্তবায়নের বিষয়টি আগে ঠিক করে সনদ স্বাক্ষরের দিকে গেলেও ভিন্ন সংকট তৈরির আভাস ছিল। তবুও পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সনদ স্বাক্ষরিত হলেও বিতর্ক থামছে না। এমতাবস্থায় সনদ নিয়ে বিএনপি খুশি থাকলেও অন্য দলগুলোর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও আইনি ভিত্তি নির্ধারণে চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে, যা চলতি মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। ফলে মতভিন্নতা থাকলেও এখন সব দলের দৃষ্টি সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকেই নিবদ্ধ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেলেও বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও আইনি কাঠামো নিয়ে মূল জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে বসে এ ব্যাপারে সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে শেষ মুহূর্তে টানা কয়েকদিনের আলোচনার পরও দলগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার পড়ে কমিশনের ওপর। একই ভাবে ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়েও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতা হয়নি। তাছাড়া অঙ্গীকারনামার ধারাগুলো নিয়েও দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত লক্ষ করা যায় শেষ পর্যন্ত। ফলে ভিন্নমত থাকা বিষয়গুলোসহ ৮৪টি প্রস্তাব সনদে রেখে স্বাক্ষরের আয়োজন করা হয়।

সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি দল ও জোটকে দুজন করে প্রতিনিধির নাম দিতে বলা হয়েছিল। এতে বেশ কয়েকটি দল নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর সাড়া না দিলেও সনদ স্বাক্ষরে সব দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল সরকার।

বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল সনদে স্বাক্ষরে সম্মতির কথা আগেভাগে জানালেও বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবিতে অনড় থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শেষ মুহূর্তে সই করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদ বাস্তবায়নের আদেশ ও কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ খসড়া না দেখে সই না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তাদের রাজি করাতে সরকার ও ঐকমত্য কমিশন জোর তৎপরতা চালালেও ফল মেলেনি। এছাড়া সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদÑএ চারটি বাম দলও তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে সনদে সই না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ফলে অনুষ্ঠানে ২৪টি দল সই করে, পরে গণফোরামও যুক্ত হয়।

এমন পরিস্থিতিতে সনদের অঙ্গীকারনামার একটি ধারায় সংশোধন আনা হয় স্বাক্ষরের আগ মুহূর্তে। চারটি বাম দল তাদের সাত দফা আপত্তি জানিয়ে তা নিষ্পত্তি করলে সনদে সই করার কথা জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়। এনসিপি সনদে সই করার জন্য বাস্তবায়নের বিশেষ আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে। জামায়াতসহ আটটি দল আগে থেকে আইনি ভিত্তিসহ কয়েক দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। তবে সরকার ঐকমত্য কমিশনের সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করার প্রক্রিয়ায় চলমান থাকায় শক্ত কর্মসূচিতে যায়নি আন্দোলনকারী দলগুলো। অন্যদিকে কর্মসূচি দেয়নি এনসিপিও। এছাড়া বিএনপিসহ অন্য দলগুলো সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে কী সুপারিশ করা হয়, সেদিকে নজর রাখছে।

জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিন সকালে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছে। জাতীয় ঐক্যের নামে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সনদ স্বাক্ষরের দিনটিকে ঐতিহাসিক অভিহিত করে বলেন, ঐক্যের মধ্য দিয়েই আগামী নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাবে দেশ।

ওই দিন সনদ স্বাক্ষরকে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আস্থা রেখেই জুলাই সনদে সই করার কথা জানিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কোনো ধরনের বিলম্ব হলে তা জাতির সঙ্গে গাদ্দারি হবে। পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে নাহিদ আবারও বলেন, জুলাই সনদের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। ঐকমত্য কমিশন আলোচনার জন্য ডাকলে এনসিপি সাড়া দেবে। তবে দলটির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, সনদ স্বাক্ষরের পর বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করছে ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের মেয়াদ আরো ১৫ দিন বড়িয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে সরকারকে পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ করার কথা জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ তৈরি, ওই আদেশে গণভোটের অধ্যাদেশ যুক্ত করা এবং পরবর্তী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত করেছে কমিশন।

এছাড়া আদেশের পূর্ণাঙ্গ খসড়াও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে বিশেষ আদেশ জারি ও সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করার কথা রয়েছে। তবে গণভোটের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সনদে থাকা আপত্তি ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’-সংক্রান্ত সমাধান নিয়েও কমিশনের আলোচনাগুলো শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

কমিশন সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা চূড়ান্ত করে আগামী সপ্তাহে সরকারের কাছে পাঠানো হবে। একই সঙ্গে কমিশন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবেÑতাদের মেয়াদের মধ্যেই অর্থাৎ ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আদেশটি জারি করতে। এতে এনসিপিসহ অন্যান্য দলের স্বাক্ষর নিশ্চিত হওয়ার পথ খুলবে।

তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে গত কয়েকদিনের আলোচনায় ঐকমত্য না হওয়ায় কমিশনের প্রস্তাব সব দল গ্রহণ নাও করতে পারে, আসতে পারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ফলে চূড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ঘোষণার পর রাজনৈতিক জটিলতা দেখা দিলে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হতে পারে। অন্যথায় দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে নির্বাচনি সময়সূচি বিলম্বিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

এদিকে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। পরদিন আলাদা বৈঠক করে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির ব্রিফিংয়ে দেখা যায়, বৈঠকের মূল আলোচ্য ছিল নির্বাচনি ইস্যু, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নয়। তবে বৈঠক শেষে জামায়াত ও এনসিপির বক্তব্যে সনদ বাস্তবায়নের আদেশ রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে জারি করার কথা বলা হয়। ঐকমত্য কমিশনের সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির খসড়ায় গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে আদেশটি জারির সুপারিশ করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।

গণভোট নিয়ে বিএনপি শুরুতে অনিচ্ছুক থাকলেও চাপের মুখে সম্মত হয় বলে জানান জামায়াত নেতা তাহের। তিনি বলেন, তাদের অবস্থান হলোÑগণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা। গণভোটে সংস্কার অনুমোদিত হবে আর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। তাই নভেম্বরেই গণভোট চায় জামায়াত। অন্যদিকে নোট অব ডিসেন্টের কার্যকারিতা থাকবে না উল্লেখ করে এনসিপি নেতা নাহিদ বলেন, জুলাই সনদ পুরোটা গণভোটে যাবে এবং গণভোটের মাধ্যমেই অনুমোদিত হবে। এরপর সংসদীয় কাঠামোর মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনা করা হবে। তিনি আরো জানান, কমিশনের সুপারিশ ও সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেখে সনদে স্বাক্ষর করবে এনসিপি।

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে বিএনপির নেতৃত্ব দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল বৃহস্পতিবার এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব দেওয়া আবেগতাড়িত। সরকার এখানে শুধু প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। সরকারের পক্ষে কেবিনেটের অনুমোদনে সেটা ইন অ্যাবসেন্স অব পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট সে আইনগুলো পাস করে থাকেন।

গণভোটের প্রস্তাব বিএনপিই দিয়েছে উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন বলেন, নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবে দুয়েকটি দল বাদে সবাই একমত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নেবÑজুলাই জাতীয় সনদের প্রজ্ঞাপন বা গেজেট নোটিফিকেশন কীভাবে করা যায়। কারণ যেভাবেই হোক, সেটি শেষ পর্যন্ত জনগণের গণভোটের মাধ্যমেই আইনি রূপ পাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি যেসব দাবি জানিয়েছে, তার মূলে রয়েছে বাস্তবায়নের আইনি পদ্ধতির মাধ্যমে জুলাই সনদ টেকসই করা এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করা। এজন্য বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়কে রূপ দেওয়া এবং জামায়াত ও এনসিপি সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোটের কথা বলেছে। এছাড়া প্রশাসন দলীয়করণ এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিয়ে দল তিনটি একে অন্যকে দুষছে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও করা হয়েছে।

গত বছর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর পাহাড়সমান প্রত্যাশার ওপর দাঁড়িয়ে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের সংস্কার এবং গণহত্যার বিচারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেয় বর্তমান সরকার। সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের প্রত্যাশা পূরণে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের কথা জানান। পরে আরো ৯টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

এর ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সহসভাপতি করা হয় অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। সদস্য রাখা হয় অন্য কমিশনের প্রধানদের। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের রূপরেখা হিসেবে ‘জুলাই চার্টার’ করে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। ফেব্রুয়ারিতে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, জুলাই চার্টার বাস্তবায়নের ওপর ভোটের সময় নির্ভর করছে। গত জুনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি‌ অর্জনসাপেক্ষে রমজানের আগে নির্বাচনের কথা বলা হয়।

গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে জুলাইয়ে সনদ চূড়ান্ত করার কথা বলেছিলেন আলী রিয়াজ। তবে সেটি বিলম্বিত হতে হতে অক্টোবরে এসে পৌঁছায়।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত