আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের মোড়ক ইন্মোচন হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টায় জামায়াতে ইসলামী যুব বিভাগের উদ্যোগে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে যুব ম্যারাথনের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য রাখেন। পরে জামায়াত আমিরের নেতৃত্বে ম্যারাথন শুরু হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে শেষ হয়।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এই নির্বাচনে দেশ-বিদেশের ভোটারদের ভোট নিয়ে কেউ যেন কোনো ধরনের কারিগরি এবং ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা না করে। কোনো ষড়যন্ত্র থাকলে জনগণের প্রতিরোধের মুখে সব ভেসে যাবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনাদের ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করুন। সুষ্ঠূভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। আমরা তাদের কাছে কোনো আনুকূল্য চাই না কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, কারো প্রতি সামান্যতম আনুকূল্য দেখানো হলে তা বরদাশত করা হবে না। আমরা চাই, আপনারা শপথের আলোকে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করুন। জনগণ যাদেরকে ভোট ও সমর্থন দিয়ে বরণ করে নেবে, আমরাও তাদেরকে বরণ করে নেব। কিন্তু জনগণের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে বাঁকা রাস্তায় কেউ চলতে চাইলে সেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। জনজীবনে শান্তি-সমৃদ্ধি ফিরে না আসা, তারুণ্যের দুর্বার গতির মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ম্যারাথন অব্যাহত থাকবে।

জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। সেখানে ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন সহ মহানগর নেতারা বক্তব্য রাখেন। এ সময় ম্যারাথনে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা লড়াই করেছিলেন, জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু-আহত হয়েছেন—তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জামায়াত আমির বলেন, বাংলাদেশ মহান আল্লাহর দান, প্রিয় জন্মভূমি। ১৯৪৭ সালে আজাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ড অখণ্ড পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল। পাকিস্তানি আমলে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে শাসকদের বৈষম্য, ক্ষেত্রবিশেষ অবিচারের কারণে এদেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছিল। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের হাত ধরে সত্তরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একগুয়েমির কারণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার পাননি।
তিনি বলেন, সেদিন জনগণের প্রতি সম্মান জানাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই একটি যুদ্ধ অনির্বার্য হয়ে উঠেছিল। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা একতাবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বুক ভরা আশা আর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয় প্রিয় দেশকে সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত, দেশ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে পারার কথা জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন নির্বাচিতরা। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের মূল্যবান জীবন, সম্পদ আর ইজ্জতের ত্যাগ-কোরবানির মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে তারা কথা রাখেননি।
তিনি বলেন, তারা দেশকে ভুলে গিয়ে একটি পরিবার-গোষ্ঠী সর্বোপরি একটি দলকেই বাংলাদেশের মালিকে পরিণত করেছিলেন। বাকি সব মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রকে খতম করেছিলেন। মিডিয়ার স্বাধীনতা, মানুষের বাচার অধিকার, ভোটের অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছিলেন। এক কথায় মানুষের মৌলিক সব অধিকার দলিত-মথিত হয়েছিল। আমাদের সব বাহিনী থাকলেও একটি গোষ্ঠী পরিবারকে রক্ষার জন্য রক্ষী বাহিনীর নামে জল্লাদ বাহিনী করা হয়েছিল। এই বাহিনীর হাতে মানুষের জীবন-ইজ্জতকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। যখন যাকে ইচ্ছা খুন করা হয়েছে, এসব মানুষের বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না।
শফিকুর রহমান বলেন, মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ঘর থেকে মা-বোনরা বের হতে চাইতেন না। এরকম বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ছেলেরা ব্যাংক ডাকাতিতে লিপ্ত হয়েছিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের জন্য বিদেশ থেকে যেসব রিলিফ সামগ্রী দেওয়া হয়েছিল, তা বিদেশের মাটিতেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে দেশের সর্বত্র মানুষের লাশ পড়ে ছিল, দাফনের কেউ ছিল না। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম ঢাকার লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করেছিল। বাকি জায়গার চিত্র ছিল ভিন্ন।
জামায়াত আমির বলেন, তারা সোনার বাংলা গড়ার ওয়াদা করে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছিলেন। মাত্র পৌনে চার বছরের দুঃশাসন মানুষকে তটস্থ করে তুলেছিল। এরপর তাদের কার্যক্রমের পরিণতি হিসেবে দুনিয়া থেকে তারা বিদায় নিয়েছিলেন। কারা তাদের হত্যা করেছিল? একাত্তরে বুক চিতিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনকারী সৈনিকরা কেন ক্ষেপে গিয়েছিল? এর উত্তর আওয়ামী লীগকেই খুঁজতে হবে, জাতিকে নয়।
তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি থেকে পচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে যে ফ্যাসিবাদ-একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়েছিল, যার পরিণতি এদেশের মানুষ স্বচক্ষে দেখেছে; এটা থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে। কিন্তু কয়লা ধুলে ময়লা যায় না—আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তিন দফায় তারা ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ছোপ ছোপ রক্ত আর কাড়ি কাড়ি লাশ উপহার দিয়েছে। একটা লাশ পড়লে ১০টা লাশ ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রী। তারা তাই করেছিলেন। দেশের সর্বত্র টুকরা টুকরা লাশ পাওয়া যেত। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মেরেছে। পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করেছিল তারা। এভাবে খুন-ধর্ষণ, আয়নাঘর আর গুমের রাজনীতির পরিণতি ভোগ করে শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট তারা দেশ থেকে পালিয়ে গেল।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদীরা পালিয়ে গিয়েও এদেশের মানুষকে শান্তি দিচ্ছে না। সর্বশেষ শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে বিপ্লবীদের মাঝে ফিরিয়ে দেন।
তিনি বলেন, এই যুব ম্যারথন দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে একথা জানানোর জন্য যে, অতীতের বস্তাপচা রাজনীতিকে পায়ের নিচে ফেলে দিতে চাই। এই রাজনীতি বাংলাদেশ অচল। এই রাজনীতির পাহাদার যারা করতে পারে, তারা রাজনীতিতে অচল মালে পরিণত হবে। এখন বাংলাদেশে নতুন রাজনীতি করতে হবে। যে রাজনীতি হবে দেশ-জাতি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে। যে রাজনীতি হবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পক্ষে। যে রাজনীতি হবে দুর্নীতি, চাঁদাবাজ, দখলদার, মামলাবাজ ও ধর্ষণকারীদের বিপক্ষে।
তিনি বলেন, আমরা শান্তির এক টুকরা বাংলাদেশ চাই, যে দেশের প্রাণ হবে যুব সমাজ। যে যুব সমাজের হাত ধরে ম্যারাথনের মতো আগামীর বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। মুক্তির এই মিছিল, মঞ্জিলে মকসুদে না পৌঁছা পর্যন্ত থামবে না। আমরা আমাদের দলের বিজয় নয়, ১৮ কোটি মানুষের বিজয় চাচ্ছি। এই বিজয়ই হবে আমাদের দলের বিজয়, বিজয়ের অংশীদার। এই বিজয়ের যত বাধার দেয়াল সব ভেঙে চুরমার করে দেবে যুবকরা। কোনো দেয়ালই আমরা টিকতে দেব না। কোনো ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না। কেউ যেন নিজেকে অতি ধূর্ত না ভাবে। জনগণ এখন তার নিজের বুঝটা বুঝতে শিখেছে। কাউকে আর ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো কালো হাত এগিয়ে এলে জনগণ তা অবশ করে দেবে। কালো টাকা দিয়ে মানুষকে কেনার দুঃসাহস দেখালে তাদের মুখে ছাই মেরে দেওয়া হবে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে
মোদির বিজয় দিবসের বার্তায় নেই বাংলাদেশের নাম