জুলাই বিপ্লবী শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার পর বিভিন্ন ধরনের তথ্য সামনে আসছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার একদিনের মাথায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলায় সংঘবদ্ধ চক্র ও সুদূরপ্রসারী নাশকতার ছক আছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ফাঁস হয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি নির্মূলে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় পরিকল্পনা।
আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ‘আওয়ামী লীগ অনলাইন কমিউনিটি’ নামে টেলিগ্রাম চ্যানেলে একটি বৈঠকের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তফসিল ঘোষণার পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ফাঁস হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই টেলিগ্রাফ কনভারসেশন প্রকাশ করেছেন আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের।
ভিডিওতে অ্যাডমিনকে বলতে শোনা যায়, পাঁচ মাস ধরে তারা একটি পরিকল্পনা করছেন। একটি টিম প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী ১১ তারিখ (ডিসেম্বর) থেকে এই টিম ‘ওজেবি’ (সাংকেতিক নাম) ওয়েল প্ল্যানড হয়ে কাজ করবে। আমাদের অলরেডি বাংলাদেশে পুশ ইন করা শুরু হয়েছে।
গ্রুপ মেম্বারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনারা যেটা চিন্তা করছেন তার চেয়েও অনেক বেশি আকারে আমাদের জায়গা থেকে যা করা যায় সেই প্রস্তুতি অলরেডি শুরু হয়েছে। আপনারা আশাহত হবেন না, সাহস হারাবেন না। রাজপথে থাকেন বাকিটা যা করার আমরা করে দিচ্ছি। আপনারা লজিস্টিকের যে বিষয়টি বলছেন দুলাল দা জানেন জুলাই মাসে কীভাবে কাজ করেছিল। সেম জিনিস এখন আরো ওয়েল প্ল্যানে করা হবে।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু লাইসেন্স অলরেডি পেয়ে গেছি। ‘প্রধানমন্ত্রী’ লাইসেন্স অলরেডি নিয়েছেন। রাশিয়া থেকে যেভাবে কথা হয়েছে সেভাবে লাইসেন্স অলরেডি প্রাপ্ত হয়েছে। এখন কী দরকার। সে অনুযায়ী আমরা তিনটি ধাপ করছি, তো থার্ড যে অপারেশন সে অনুযায়ী মোটামুটি আমাদের মেকানিজম শেষ করে ফেলেছি। মোটামুটি আমাদের পরশু থেকে আমাদের টিম প্রবেশ করা শুরু করবে। শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক অপারেশনগুলো চলবে। বাকি কিছু হয়তো খুলনা কেন্দ্রিক হতে পারে, সেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ভর করবে।
ভিডিওতে অন্য একজনকে প্রথমে দাদা ও পরে চিফ বলে সম্বোধন করে সাতক্ষীরা এলাকায় অভিযান চালানোর প্রস্তাব দেন অ্যাডমিন।
টেলিগ্রাম গ্রুপটিতে আওয়ামী লীগের পদধারী বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মীরাই সদস্য। কারা কারা ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এবং কথিত চিফের পরিচয় নিশ্চিত করতে কাজ করছেন গোয়েন্দারা।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বন্দর নগরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নিজেদের ও কর্মী-সমর্থকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। নির্বাচন কেন্দ্রিক ‘টার্গেট কিলিং’ শুরু হয়েছে বলে তাদের ধারণা।
বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশের একদিন পর গত ৫ নভেম্বর প্রথম গণসংযোগে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন দলটির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী এরশাদ। ওই হামলায় যুবদল কর্মী সারোয়ার হোসেন বাবলা নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন প্রার্থী নিজেও। নিহত বাবলার বিরুদ্ধে অতীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকায় বিষয়টি অনেকেই হালকাভাবে দেখে। কেউ কেউ আবার অভ্যন্তরীণ কোন্দল আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে শুরু থেকেই হামলাটিকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করা হচ্ছে।
মাসখানেক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও আতঙ্কে পুরোদমে নির্বাচনি প্রচার শুরু করতে পারেননি এরশাদ। এরই মাঝে ঢাকায় হাদির ওপর হামলা ও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও ভারতে পলাতক শেখ হাসিনাসহ সন্ত্রাসীদের ফোনালাপ এবং নাশকতার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় নতুন আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে এরশাদসহ অন্য প্রার্থীদের।
ধানের শীষের প্রার্থী এরশাদ বলেন, পলাতক আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে প্রচুর টাকা ও অস্ত্র আছে। আর দেশকে অস্থিতিশীল করতে এই দুটি উপকরণই যথেষ্ট। তার নিজের ওপর হামলার পর হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে নির্বাচন বানচালে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এখনো তৎপর। সরকার ও প্রশাসন আন্তরিক না হলে শুধু ঢাকা আর চট্টগ্রামই নয়, দেশের সব আসনই ঝুঁকিপূর্ণ। উৎসবমুখর নির্বাচনের যে আয়োজন চলছে তা বাস্তবায়ন করতে প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হতে হবে।
চট্টগ্রাম-২ আসনের এমপি প্রার্থী জামায়াতে ইসলামী মহানগরী শাখার সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নুরুল আমিন বলেন, নির্বাচনি প্রক্রিয়াটি হলো জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া। এ জায়গায় কেউ যদি প্রার্থীদের টার্গেট করে হামলা করতে চায় সেটা সহজেই করতে পারে। চট্টগ্রামে এরশাদ ও ঢাকায় হাদির ওপর হামলার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। এখানে প্রার্থীদের আসলে তেমন কিছু করণীয় নেই। ঝুঁকি নিয়ে হলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেই হবে। আর এই সুযোগ নিতে পারে পলাতক সন্ত্রাসী-অপশক্তি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনকেই আন্তরিক হতে হবে। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করতে হবে।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের এনসিপির প্রার্থী জোবাইরুল হাসান আরিফ বলেন, জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের টার্গেট করেছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ। হাদিসহ গণঅভ্যুত্থানের নেতারা ভারতীয় নম্বর থেকে অব্যাহতভাবে হুমকি পাচ্ছেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে জানানো হলেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে বেপরোয়া হচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এর বাইরে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছোটখাটো বিষয়গুলো নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। পুরোনো দোষারোপের রাজনীতিও করছেন কেউ কেউ। যার সুবিধা নিচ্ছে পতিত শক্তি। তাই সবার আগে আওয়ামী লীগ ইস্যুতে আমরা কীভাবে ডিল করব সে ব্যাপারে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। নাহলে এখন হয়তো ছাত্র নেতারা টার্গেট হচ্ছেন, ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, ভাইরাল হওয়া নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের টেলিগ্রাম সংলাপটিসহ বেশ কিছু সোর্স থেকে পাওয়া অনেক তথ্য একত্রিত করে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ঝটিকা মিছিল থেকে গ্রেপ্তার সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলোও যাচাই-বাছাই করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। সে অনুযায়ী টহল জোরদার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারে অভিযানের পরিমাণ বাড়ানোসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আসন্ন নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের সমুচিত জবাব দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনে প্রার্থীদের প্রতি তাদের গণসংযোগের খবর ২৪ ঘণ্টা আগে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করার অনুরোধ করা হয়েছে। এতে আগে থেকে ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নজরদারিতে রাখা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের ব্যাপারেও গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ক্ষেত্র বিশেষে কিছু প্রার্থীকেও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি পুলিশের পরিকল্পনায় আছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোর কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীকে আরো সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় ৮৪২টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অস্ত্রগুলো জমা দিতে দফায় দফায় নোটিস দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১২৫টি এখনো জমা পড়েনি। কার্যত ওই অস্ত্রগুলো এখন অবৈধ। এছাড়া গণঅভ্যুত্থানের দিন বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া চার শতাধিক অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এর বাইরে সন্ত্রাসীদের কাছেও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র থাকার তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে। তাই নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধারকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অভিযান পরিচালনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। কারণ, এখানে অভ্যন্তরীণ অস্ত্রভান্ডারের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলা হয়ে ভারত থেকে আর কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার থেকে বড় অস্ত্রের চালান আসার সুযোগ আছে। দেশের বাইরে থেকে অস্ত্রের চালান আসতে পারে এমন ১৫টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে ১১টিই ভারত আর চারটি মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত।
সূত্রটি আরো জানায়, অস্ত্রপাচারে জড়িত আছে মিয়ানমারভিত্তিক বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ও পার্বত্য অঞ্চলের কিছু সশস্ত্র সংগঠন। এর মধ্যে আরসা, আরএসও, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ অন্যতম। যারা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অস্ত্র বিক্রি ও শুটার ভাড়া দেওয়ার কাজও করে। চট্টগ্রাম মহানগরের কাছাকাছি ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়ার বিভিন্ন এলাকা দুর্গম পাহাড়ি। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরী ও সীতাকুণ্ডেও গহীন পাহাড়ি এলাকা আছে। যেগুলো সন্ত্রাসীদের লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ এলাকা। ইতোমধ্যে গত ছয় মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে যেগুলো পাহাড় থেকে এসে সংঘটিত করে আবার পালিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা।

