গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের দুই বছর আজ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ০২
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ৪৯
ছবি: আল জাজিরা

ফিলিস্তিনে অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের দুবছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গোটা উপত্যকায় দীর্ঘ ১৬ বছরের অবৈধ অবরোধ ভাঙতে স্থানীয় স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরাইলের মূল ভূখণ্ডে অভিযান চালায়। এর জেরে গাজায় যে বর্বর আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী, আধুনিক ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দুবছরের আগ্রাসনে গাজায় ৬৭ হাজারের বেশি বাসিন্দাকে হত্যা করেছে ইসরাইল। কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিকদের তথ্য অনুসারে ক্রমাগত ইসরাইলি হামলার জেরে হতাহত সবাইকে উদ্ধার করতে পারছেন না চিকিৎসাকর্মীরা। বিধ্বস্ত ভবনের নিচে এখনো চাপা পড়ে আছে অনেকের লাশ। এর ফলে হতাহতের পুরো চিত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তালিকায় আসেনি।

বিজ্ঞাপন

২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয় স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। মোট ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৪টি আসন পায় সংগঠনটি। হামাসের এ বিজয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ইসরাইল ও পশ্চিমা শক্তিগুলো। অপরদিকে ক্ষমতাসীনরা ফাতাহ নির্বাচনের এ ফল মানতে অস্বীকার করে। তা সত্ত্বেও ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে হামাস সরকার গঠন করে।

কিন্তু নানা টানাপোড়েন ও মতপার্থক্যের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের জুনে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীর থেকে হামাস সদস্যদের বহিষ্কার করে ফাতাহ। এর জেরে গাজা উপত্যকার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। সে সময় থেকেই ইসরাইল গাজার ওপর পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে।

ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের এ অবরোধের জেরে পুরো উপত্যকাই এক খোলা কারাগারে পরিণত হয়। তেল আবিবের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের বস্তুই গাজায় প্রবেশ বা বের করা যেত না, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ওপর ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে চার দফায় আগ্রাসনে গাজার ঘরবাড়িসহ বিবিধ অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়।

দীর্ঘ ১৬ বছর টানা অবরোধ ভাঙতে হামাসসহ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংগঠনের যোদ্ধারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। হামলায় ৩৭৩ ইসরাইলি সেনাসহ মোট এক হাজার ১৩৯ জন নিহত হয়। এছাড়া ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এর জেরে টানা দুবছরের নির্মম আগ্রাসন শুরু হয়। দুবছরের যুদ্ধ বন্ধে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। শুধু অস্থায়ীভাবে দুই দফা যুদ্ধবিরতি ছাড়া অবিরাম বোমাবর্ষণের শিকার হয়ে এসেছেন গাজার বাসিন্দারা।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সোমবারের বিবৃতিতে বলা হয়, আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ২১ জন নিহত ও ৯৬ জন আহত হন। এর ফলে ৭৩০ দিনের ইসরাইলি আগ্রাসনে অবরুদ্ধ এ উপত্যকায় মোট নিহত ৬৭ হাজার ১৭০ ও আহতের সংখ্যা এক লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৯ জনে দাঁড়িয়েছে।

ইসরাইলের আগ্রাসনের জেরে খাদ্যবস্তু দুর্লভ হয়ে পড়েছে পুরো উপত্যকায়। যুদ্ধের জেরে এখানকার মানুষ খাবারের জন্য ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। চলতি বছরের আগস্টে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, গাজায় দুর্ভিক্ষ চলমান রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুবছরে অনাহারে ১৫৪ শিশুসহ ৪৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়া দুবছরের আগ্রাসনে আরো বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবরুদ্ধ এ ভূখণ্ডটি। সোমবার প্রকাশিত জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইউএনআরডব্লিউএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার ৮০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। একইসঙ্গে ৯৮ শতাংশ কৃষিজমি নষ্ট এবং ৯০ শতাংশ পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, ইসরাইলি হামলায় গাজার ৯২ শতাংশ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ছয় লাখ ৬০ হাজার শিশুর শিক্ষাকার্যক্রম তৃতীয় বছরের মতো বন্ধ রয়েছে।

দুবছরের এ আগ্রাসনের অবসানে বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে ইসরাইলের আলোচনা হয়েছে। কাতার, মিসর ও আমেরিকার মধ্যস্থতায় সমাধানের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আসা হলেও ইসরাইলিদের অনিচ্ছায় তা বারবারই ব্যর্থ হয়।

তবে গাজায় প্রথম দফায় ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয়। এ সময় মোট ১১০ জিম্মিকে মুক্তি দেয় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীরা। অন্যদিকে ইসরাইলি কারাগার থেকে ২৪০ বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার অনিচ্ছায় গাজায় আবার আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।

দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি গাজায় ৪২ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা অনুযায়ী অস্থায়ী এ যুদ্ধবিরতির মধ্যেই আগ্রাসনের স্থায়ী অবসানে বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু এবারো ইসরাইলিরা চুক্তি ভেঙে মার্চ থেকে আরো জোরালোভাবে অবরোধ ও আগ্রাসন চাপিয়ে দেয়।

এ পর্যায়ে মোট ৩৩ জিম্মিকে গাজা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিপরীতে ইসরাইলি কারাগার থেকে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

নতুন করে গাজায় যুদ্ধ বন্ধে গত মাসের শেষে ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ পরিকল্পনায় সম্মতি জানিয়েছেন। আলোচনাসাপেক্ষে এ পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছে হামাসসহ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলো। এ নিয়ে আলোচনার জন্য সোমবার পর্যন্ত মিসরের কায়রোতে দুই পক্ষের প্রতিনিধিদল অবস্থান করছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত