আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

২০২৫ ছিল তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের সফলতার বছর

আমার দেশ অনলাইন

২০২৫ ছিল তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের সফলতার বছর

২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ তুরস্কের সামনে আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম জটিল কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হাজির করে। এমন এক সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়, যখন একদিকে পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে এবং অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ছিল।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়, বৈশ্বিক আর্থিক পরিস্থিতি কঠোর হয় এবং রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তুরস্ককে কঠিন অবস্থানে ফেলে। ন্যাটোর সদস্য হয়েও মস্কোর সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও পর্যটন সম্পর্ক বজায় রাখা তুরস্কের জন্য সহজ ছিল না। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, আঙ্কারাকে হয় পশ্চিম নয় রাশিয়া—এই দুইয়ের একটিকে বেছে নিতে হবে।

চার বছর পর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং তুরস্ক কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে এই সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবিলায় দক্ষ ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যস্থতার ভূমিকা

ইউক্রেন যুদ্ধে প্রথমে আনতালিয়া শান্তি আলোচনা, এরপর কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি, বন্দিবিনিময় এবং সাম্প্রতিক ইস্তাম্বুল শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তুরস্ক নিজেকে কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশ ও রাশিয়া—উভয়ের কাছেই আঙ্কারা কিছুটা ছাড় আদায় করতে পেরেছে।

এই কূটনৈতিক অবস্থান তুরস্ককে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সীমার মধ্যে থেকেও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একইসঙ্গে তুরস্ক ইউক্রেনকে বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোনসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যা কিয়েভ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে।

ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন ও তুরস্কের লাভ

ইউক্রেন যুদ্ধ দক্ষিণ ককেশাসেও বড় পরিবর্তন আনে। রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যস্ত থাকায় আজারবাইজান নাগোর্নো-কারাবাখে সামরিক সাফল্য অর্জন করে, যেখানে তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বৈশ্বিকভাবে নতুন পরিচিতি পায়।

একই সঙ্গে আর্মেনিয়া–আজারবাইজান শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা তুরস্ক–আর্মেনিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ খুলে দিতে পারে। সীমান্ত খুললে মধ্য এশিয়া ও চীনের সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও শক্তিশালী হবে।

সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব

ইউক্রেনে রাশিয়ার জড়িয়ে পড়া এবং সিরিয়ায় ইরান ও হিজবুল্লাহর দুর্বলতা বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনে ভূমিকা রাখে। তুরস্কের সামরিক ও কৌশলগত সহায়তায় বিরোধী শক্তিরা দামেস্ক দখলে সক্ষম হয়।

সিরিয়া নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে পুনর্গঠনের পথে গেলে তুর্কি নির্মাণ ও উৎপাদন খাত বড় সুবিধা পেতে পারে। একই সঙ্গে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া এগোলে তা তুরস্কের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

ইউরোপ ও বৈশ্বিক সম্পর্ক

ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের নিরাপত্তা ভাবনাকে নতুন করে সামনে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা দুর্বল হওয়ায় ইউরোপ বিকল্প প্রতিরক্ষা অংশীদার খুঁজছে। এই প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও উন্নত প্রতিরক্ষা শিল্পের কারণে তুরস্ক বড় লাভবান হতে পারে।

ইতোমধ্যে বায়কার–পিয়াজিও এবং লিওনার্দোর মতো চুক্তি ইউরোপ–তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়েছে। একই সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির আলোচনাও নতুন গতি পেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন অবস্থান

গাজা শান্তি প্রক্রিয়ায় গ্যারান্টর হিসেবে তুরস্কের ভূমিকা ওয়াশিংটনে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। শান্তি রক্ষায় সেনা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে আঙ্কারা বাস্তবভিত্তিক অবস্থান দেখিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। এর ফলে এফ-৩৫ কর্মসূচিতে তুরস্কের প্রত্যাবর্তন ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

একই সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং এমনকি চীনের সঙ্গেও তুরস্কের সম্পর্ক উন্নতির পথে। সব মিলিয়ে, ২০২৫ সাল তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ধৈর্যের ফলপ্রসূ বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জটিল বৈশ্বিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে তুরস্ক তার কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করেছে। উন্নত বৈদেশিক সম্পর্কের পাশাপাশি এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও।

তথ্যসূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড

এসআর

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন