
আমার দেশ অনলাইন

ভারত বিভাজনের সময়, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় বাংলা বা পাঞ্জাবের মতো রক্তপাতের কথা শোনা যায়নি।
এই সময় ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জম্মু প্রদেশের পরিস্থিতি কিন্তু একেবারে আলাদা ছিল।
জম্মুর রাজনৈতিক কর্মী এবং দৈনিক কাশ্মীর টাইমসের প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক বেদ ভাসিনের বয়স সেই সময় ছিল ১৮ বছর। ২০১৫ সালে প্রয়াত ভাসিনের লেখা থেকে সেই সময়কালের জম্মুর একটা চিত্র পাওয়া যায়।
তিনি ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে 'বিভাজনের অভিজ্ঞতা: জম্মু ১৯৪৭' শিরোনামের একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে ভাসিন উল্লেখ করেন, "মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা (ভারত বিভাজনের) ঘোষণার পরপরই জম্মুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে"।
"পুঞ্চে, মহারাজা হরি সিংয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং কর আরোপের কয়েকটা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক ধরনের অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মহারাজার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের নির্মম বল প্রয়োগ মানুষের আবেগকে উস্কে দেয় এবং এই আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক থেকে সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়"।
বেদ ভাসিন তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, "মহারাজার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন শুধু মুসলিমদের আত্মসমর্পণ করতেই বলেনি, ডোগরা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক মুসলিম সৈন্য এবং মুসলিম পুলিশ অফিসারদেরও ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল যাদের আনুগত্য সম্পর্কে তাদের (প্রশাসনের) সন্দেহ ছিল"।
ভাসিন ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে জম্মুতে তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি লিখেছেন, "গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞকে ন্যায্য প্রমাণ করতে মুসলিমরা অস্ত্র হাতে তুলে নেবে, তারা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে"।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বিসনা, আরএসপুরা, আখনুরের মতো সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ পাকিস্তানের শিয়ালকোট অঞ্চলে চলে এসেছিলেন।
এদিকে, প্রতিবেশী পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সীমান্ত এলাকায় তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
"উধমপুর জেলায়, বিশেষত উধমপুর, চেনানি, রামনগর এবং রিয়াসি অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মুসলিমদের হত্যা করা হয়। এমনকি ভাদেরওয়াহতে (উধমপুর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত) বহু মুসলিম ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছিলেন"।
ভাসিনের মতে এই হত্যাকাণ্ডে আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ)-এর সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তাদের সাহায্য করেছিল সশস্ত্র শিখ শরণার্থীরা, "যারা হাতে তলোয়ার নিয়ে জম্মুর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল"।
উধমপুর ও ভাদেরওয়াহর দাঙ্গার নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ পরে ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দেয় এবং কেউ আবার মন্ত্রী হয়।
ছাম্ব, দেবা বাটালা, মানুসার এবং আখনুরের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের হত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল যাদের অনেকেই জম্মুর বিভিন্ন অঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
কাঠুয়া জেলায় মুসলিমদের গণহত্যা এবং নাদীদের অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়।
প্রশাসনের মনোভাব সম্পর্কে ভাসিন বলেন, "সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলার পরিবর্তে মহারাজার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন সাম্প্রদায়িক গুন্ডাদের সাহায্য করেছে এবং তাদের অস্ত্র দিয়েছে"।
তিনি আরো জানিয়েছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার বাইরে বসবাসরত বহু মুসলিম ব্যক্তিকে দাঙ্গাকারীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। শহরে সরকারিভাবে কারফিউ জারি করা সত্ত্বেও অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে অবাধে গাড়িতে চলাচল করছিল দাঙ্গায় সামিল এই লোকজন।
বেদ ভাসিন উল্লেখ করেছেন, "মুসলিমদের চলাচলে বাধা দেওয়ার জন্যই এই কারফিউ জারি করা হয়েছিল"।
এরপর তালাব খাতিকান এলাকায় মুসলিমদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয় এবং শেষপর্যন্ত নির্বিচারে হত্যার ওই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।
তাদের প্রথমে তাদের যোগী গেট পুলিশ লাইনে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে এখন দিল্লি পাবলিক স্কুল রয়েছে।
নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে প্রশাসনের তরফে বলা হয়, তারা যেন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানে চলে যান।
প্রথম ব্যাচে প্রায় ৬০টা লরিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষকে বোঝাই করা হয় শিয়ালকোটে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কী হতে চলেছে তা না জেনেই ওই পরিবারগুলো গাড়িতে উঠে বসে।
বেদ ভাসিনের কথায়, "ওই গাড়িগুলো সেনার নজরদারিতে ছিল। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে জম্মু শিয়ালকোট রোডের চাট্টায় পৌঁছানোর পর বিপুল সংখ্যক আরএসএস-এর লোক এবং শিখ উদ্বাস্তুরা ওই গাড়িগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। গাড়িতে সওয়ার ব্যক্তিদের থেকে টেনে বের করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়"।
এই সময় সৈন্যরা হয় হত্যাকাণ্ডে যোগ দিয়েছিল বা দর্শকের ভূমিকায় ছিল। গণহারে হত্যার খবর গোপন রাখা হয়।
একইভাবে পরেরদিন অন্যান্য পরিবারগুলোও আরো একটা গাড়িতে সওয়ার হয়। তাদেরও একই পরিণতি হয়েছিল।
যারা কোনোরকমে হত্যাকারীদের হাত থেকে বেঁচে যান, তাদের মধ্যে কেউ কেউ শিয়ালকোটে পৌঁছে নিজেদের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনান।
এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে প্রশাসন। এমনকি জম্মুর জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনার বিষয়েও অস্বীকার করে। তবে এই প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন ভাসিন।
তৎকালীন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, "ভদ্র হওয়া সত্ত্বেও এর পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে তিনি আমাকে সতর্ক করেন"।
"তিনি আমাকে প্রথমে বলেন, আমি তোমাকে অপকর্মের জন্য জেলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু তুমি আমার মতো ক্ষত্রিয় এবং এখানে আমার আত্মীয় রয়েছে, তাই আমি শুধু তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি। এখন শান্তি কমিটি গঠন করে শান্তির প্রতিষ্ঠার কাজ করার সময় নয়"।
"হিন্দু ও শিখদের এখন মুসলিম সাম্প্রদায়িকদের হাত থেকে রক্ষা করার সময়, যারা তাদের হত্যা ও পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলার পরিকল্পনা করছে। আমরা ইতিমধ্যে এক হিন্দু-শিখ ডিফেন্স কমিটি গঠন করেছি। এই কমিটিকে সমর্থন করাই তোমার এবং তোমার সঙ্গীদের পক্ষে ভালো"।
ওই কর্মকর্তা ভাসিন এবং তার সঙ্গীদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলেন। ভাসিন উল্লেখ করেছেন, "ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা রেহারি এলাকায় হিন্দু ও শিখ ছেলেদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তুমি এবং তোমার সঙ্গীরা প্রশিক্ষণে যোগ দিলে ভালো হবে"।
"আমি আমার এক সঙ্গীকে প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠিয়েছিলাম, সে ফিরে এসে জানায় ওই শিবিরে আরএসএস-এর যুবা সদস্য এবং অন্যরা ৩০৩ রাইফেল ব্যবহারের জন্য সৈন্যদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে"।
এই হত্যাকাণ্ডে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা নেই, তবে অনুমান করা হয় এই সংখ্যা ২০ হাজার থেকে দুই লাখ ৩৭ হাজার।
এই সময়ে, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের কিছু অংশে চলে যান। জম্মুতে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে বদল দেখা দেয়।
ভাসিন বলেছেন, "আমার একটা ঘটনা মনে আছে। মেহেরচাঁদ মহাজন (রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী), যিনি জম্মুতে পৌঁছনোর পর প্রাসাদে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হিন্দুদের প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন- এখন যেহেতু ক্ষমতা জনগণের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে, তাদের উচিত সমতা দাবি করা"।
"ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে জনসংখ্যার অনুপাতে এত বৈষম্য রয়েছে, তারা কীভাবে সমতার দাবি করতে পারে? নিচে রামনগর রাখ (জঙ্গল) এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি (মেহেরঁচাদ) বলেছিলেন- জনসংখ্যাগত গঠনও পরিবর্তন হতে পারে"।
ভারতীয় সাংবাদিক সাঈদ নাকভি তার বই 'বিয়িং আদার: মুসলিমস ইন ইন্ডিয়া'তে লিখেছেন, "১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, জম্মু প্রদেশের মুসলিম জনসংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়নেরও (১২ লাখ) বেশি ছিল এবং ওই প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল দুই মিলিয়ন (২০ লাখ)"।
"জম্মু জেলার মোট জনসংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৫ লাখ যার মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৭ লাখ। রাজধানী জম্মুর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ হাজার যার মধ্যে মুসলিম ১৬ হাজার"।
কাশ্মীর টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা জামওয়াল বলেন, জম্মু প্রদেশের ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায় যে দেশভাগের জনতাত্ত্বিক গঠন পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের গণহত্যার কারণে জম্মু জেলার অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামে শুধু হিন্দু বা শিখ জনগোষ্ঠীই রয়ে গিয়েছিল।
শুধু জম্মু জেলাতেই (যা জম্মু প্রদেশের একটা প্রধান অংশ) মুসলিম জনসংখ্যা ছিল এক লাখ ৫৮ হাজার ৬৩০।
এদিকে ১৯৪১ সালে মোট জনসংখ্যা, অর্থাৎ চার লাখ ২৮ হাজার ৭১৯-এর ৩৭ শতাংশ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। ১৯৬১ সালে মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখ ১৬ হাজার ৯৩২-এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৬৯৩ জন, অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ।
'ক্যালকাটা স্টেটসম্যান'-এর সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স তার বই 'পাকিস্তান'-এ লিখেছেন যে "আগস্ট থেকে ১১ সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাঞ্জাব, পাতিয়ালা এবং কাপুরথালায় শুরু হওয়া পদ্ধতিগত নৃশংসতা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল"।
"প্রায় দুই লাখ মানুষ নিখোঁজ হন যাদের সম্ভবত হত্যা করা হয়েছিল, মহামারী বা কঠোর আবহাওয়ার কারণে মারা যান। বাকিরা অসহায় অবস্থায় পশ্চিম পাঞ্জাবে পালিয়ে যান"।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৫১ সালের ছয়ই মার্চ অনুষ্ঠিত ৫৩৪ নম্বর সভায় উল্লেখ করা হয়েছে- "ভারতের দেশভাগের সঙ্গে সমসাময়িক ভয়াবহ গণহত্যার পরপর মহারাজা এক ধরনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন যার মাধ্যমে (টাইমস অফ লন্ডনের বিশেষ সংবাদদাতার ১৯৪৮ সালের দশই অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে) তার নেতৃত্বে অবশিষ্ট ডোগরা অঞ্চলে ডোগরা বাহিনী, হিন্দু ও শিখদের সাহায্যে পরিকল্পিতভাবে দুই লাখ ৩৭ হাজার মুসলিমকে হয় নির্মূল কর হয় বা তাদের সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়"।
ওই একই প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাঠানদের আক্রমণের পাঁচ দিন আগে এবং মহারাজার ভারতে অন্তর্ভুক্তির নয় দিন আগে এই ঘটনাগুলো ঘটে।
হোরেস আলেকজান্ডার ১৯৪৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি 'দ্য স্পেক্টেটর'-এ উল্লেখ করেছিলেন জম্মুতে নিহত মুসলিমদের সংখ্যা দুই লাখ।
বেদ ভাসিনের মতে, জম্মু শহরে তালাব খাতিকান এবং কনক মান্ডির মতো অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যা ছিল, অন্যদিকে বেশিরভাগই হিন্দুরা থাকতেন। মহারাজার সেনাবাহিনী হিন্দুদের বাড়ির ভেতরে অবস্থান নিয়েছিল এবং সেখান থেকেই তারা মুসলিম বাসিন্দাদের ওপর গুলি চালায়।
তিনি উল্লেখ করেছেন, আরএসএস লোকেরা এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অন্য ব্যক্তিরা শিশু এবং নারীদেরও রেহাই দেয়নি। নারীদের ধর্ষণ করা হয় এবং শিশু ও পুরুষদের হত্যা করা হয়।
তবে মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা বিভাজন ছিল। মুসলিমদের একটা অংশ মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল এবং তাই তারা সুরক্ষিত ছিল। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন দরিদ্র মুসলমানরা।
১৯৪৭ সালের ২৪শে অক্টোবর করাচীর সংবাদপত্র 'ডেলি গেজেট'-এর সংখ্যায় কাশ্মীর টাইমসের হিন্দু সম্পাদক জি কে রেড্ডি বলেছিলেন, "নিরস্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে ডোগরায় যে সহিংসতার উন্মাদ নগ্ন নৃত্য চলেছে তা যে কোনো মানুষকে বিব্রত করবে। আমি দেখেছি কীভাবে নৃশংসতা চালানো এই লোকগুলো এবং সৈন্যদের সশস্ত্র দল পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হওয়া অসহায় মুসলিম শরণার্থীদের গুলি করেছে এবং তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলেছে..."।
"জম্মুর যে হোটেল রুমে আমাকে আটক করা হয়েছিল, সেখান থেকে আমি এক রাতে ২৬টা গ্রাম পুড়িয়ে ফেলার কথা গুনেছি এবং আশেপাশের শরণার্থী শিবির থেকে সারা রাত ধরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছিল"।
ব্রিটিশ কূটনীতিক সিবি ডিউকও একই কথা বলেছেন যিনি অক্টোবর মাসে ওই অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর জম্মুর পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। সাঈদ নাকভি তার সংকলিত লেখার ৯০ তম খণ্ড থেকে উদ্ধৃত করেছেন, "জম্মুর হিন্দু, শিখ এবং বাইরে থেকে আসা লোকেরা মুসলমানদের হত্যা করেছিল। সেখানে যা ঘটছে তার জন্য দায়ী কাশ্মীরের মহারাজা"।
ভাসিনের মতে, জম্মুতে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছে তা একতরফা ছিল না। এই অঞ্চলের কিছু অংশে, বিশেষত রাজৌরি, মিরপুর এবং বর্তমানে পাকিস্তান শাসিত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ও শিখকেও হত্যা করা হয়।
কিন্তু এটাও বাস্তব যে আরএসএস-এর দ্বারা মুসলমানদের গণহত্যার নেপথ্যে সেখানকার প্রশাসনের স্পষ্ট সমর্থন ছিল।।
আমস্টার্ডাম ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল হিস্ট্রির ফেলো ইদ্রিস কান্ট ১৯৪০-এর দশকের কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ডোগরা সরকার এই ঘটনার নথি নষ্ট করে দেশভাগের সময়কার এই ভয়াবহ গণহত্যাকে চাপা সমন্বিত চেষ্টা চালিয়েছিল।
'দ্য হিস্টোরিক্যাল রিয়েলিটি অফ দ্য কাশ্মীর ডিসপিউট' বইয়ের লেখক পিজি রসুলের মতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও কাশ্মীরি নেতা শেখ আবদুল্লাহ যখন জম্মুতে মুসলিমদের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেন তখন তাদের এই 'মর্মান্তিক ঘটনা' সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন তারা নীরব ছিলেন।
রসুল বলেছেন, "নিশ্চয়ই তারা ভেবেছিলেন কাশ্মীর হারালেও জম্মু তাদের হাতে থাকা উচিত এবং এর একমাত্র উপায় হলো সেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা"।
বেদ ভাসিনের মতে মহারাজার ভীম্বের সফরের পরে, পুঞ্চের কিছু অঞ্চলে যেমন পালান্দারি, বাগ এবং সুধৌতিতে গণহত্যা চালানো হয়য়। এরপরই ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়া সৈন্যরা মহারাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন।
এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সদ্য স্বাধীন দুই দেশ- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটা ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। এইভাবে কাশ্মীর নিয়ে সংঘাতেরও সূত্রপাত হয়।
জম্মু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পরে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া) থেকে উপজাতি মিলিশিয়ারা কাশ্মীর আক্রমণ করে। জম্মুর অনেক মুসলিম পারিবারিক সম্পর্ক ছিল কাশ্মীরের সঙ্গে। উপজাতি বাহিনী কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডোগরা সেনাবাহিনী জম্মুর দিকে পালিয়ে যায়।
হরি সিং দিল্লির সঙ্গে ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকশন স্বাক্ষর করেন। এরপর ওই উপজাতি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দিল্লি থেকে সেনা পাঠানো হয়।
কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই লড়াই শেষ পর্যন্ত প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে পরিচালিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি এবং ইসলামাবাদ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য দুই দেশের মধ্যে বিভক্ত ছিল। তবে দুই দিকের কাশ্মীরিরাই ছয়ই নভেম্বর এই হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা

ভারত বিভাজনের সময়, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় বাংলা বা পাঞ্জাবের মতো রক্তপাতের কথা শোনা যায়নি।
এই সময় ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জম্মু প্রদেশের পরিস্থিতি কিন্তু একেবারে আলাদা ছিল।
জম্মুর রাজনৈতিক কর্মী এবং দৈনিক কাশ্মীর টাইমসের প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক বেদ ভাসিনের বয়স সেই সময় ছিল ১৮ বছর। ২০১৫ সালে প্রয়াত ভাসিনের লেখা থেকে সেই সময়কালের জম্মুর একটা চিত্র পাওয়া যায়।
তিনি ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে 'বিভাজনের অভিজ্ঞতা: জম্মু ১৯৪৭' শিরোনামের একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে ভাসিন উল্লেখ করেন, "মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা (ভারত বিভাজনের) ঘোষণার পরপরই জম্মুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে"।
"পুঞ্চে, মহারাজা হরি সিংয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং কর আরোপের কয়েকটা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক ধরনের অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মহারাজার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের নির্মম বল প্রয়োগ মানুষের আবেগকে উস্কে দেয় এবং এই আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক থেকে সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়"।
বেদ ভাসিন তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, "মহারাজার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন শুধু মুসলিমদের আত্মসমর্পণ করতেই বলেনি, ডোগরা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক মুসলিম সৈন্য এবং মুসলিম পুলিশ অফিসারদেরও ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল যাদের আনুগত্য সম্পর্কে তাদের (প্রশাসনের) সন্দেহ ছিল"।
ভাসিন ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে জম্মুতে তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি লিখেছেন, "গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞকে ন্যায্য প্রমাণ করতে মুসলিমরা অস্ত্র হাতে তুলে নেবে, তারা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে"।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বিসনা, আরএসপুরা, আখনুরের মতো সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ পাকিস্তানের শিয়ালকোট অঞ্চলে চলে এসেছিলেন।
এদিকে, প্রতিবেশী পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সীমান্ত এলাকায় তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
"উধমপুর জেলায়, বিশেষত উধমপুর, চেনানি, রামনগর এবং রিয়াসি অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মুসলিমদের হত্যা করা হয়। এমনকি ভাদেরওয়াহতে (উধমপুর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত) বহু মুসলিম ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছিলেন"।
ভাসিনের মতে এই হত্যাকাণ্ডে আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ)-এর সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তাদের সাহায্য করেছিল সশস্ত্র শিখ শরণার্থীরা, "যারা হাতে তলোয়ার নিয়ে জম্মুর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল"।
উধমপুর ও ভাদেরওয়াহর দাঙ্গার নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ পরে ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দেয় এবং কেউ আবার মন্ত্রী হয়।
ছাম্ব, দেবা বাটালা, মানুসার এবং আখনুরের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের হত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল যাদের অনেকেই জম্মুর বিভিন্ন অঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
কাঠুয়া জেলায় মুসলিমদের গণহত্যা এবং নাদীদের অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়।
প্রশাসনের মনোভাব সম্পর্কে ভাসিন বলেন, "সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলার পরিবর্তে মহারাজার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন সাম্প্রদায়িক গুন্ডাদের সাহায্য করেছে এবং তাদের অস্ত্র দিয়েছে"।
তিনি আরো জানিয়েছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার বাইরে বসবাসরত বহু মুসলিম ব্যক্তিকে দাঙ্গাকারীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। শহরে সরকারিভাবে কারফিউ জারি করা সত্ত্বেও অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে অবাধে গাড়িতে চলাচল করছিল দাঙ্গায় সামিল এই লোকজন।
বেদ ভাসিন উল্লেখ করেছেন, "মুসলিমদের চলাচলে বাধা দেওয়ার জন্যই এই কারফিউ জারি করা হয়েছিল"।
এরপর তালাব খাতিকান এলাকায় মুসলিমদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয় এবং শেষপর্যন্ত নির্বিচারে হত্যার ওই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।
তাদের প্রথমে তাদের যোগী গেট পুলিশ লাইনে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে এখন দিল্লি পাবলিক স্কুল রয়েছে।
নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে প্রশাসনের তরফে বলা হয়, তারা যেন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানে চলে যান।
প্রথম ব্যাচে প্রায় ৬০টা লরিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষকে বোঝাই করা হয় শিয়ালকোটে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কী হতে চলেছে তা না জেনেই ওই পরিবারগুলো গাড়িতে উঠে বসে।
বেদ ভাসিনের কথায়, "ওই গাড়িগুলো সেনার নজরদারিতে ছিল। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে জম্মু শিয়ালকোট রোডের চাট্টায় পৌঁছানোর পর বিপুল সংখ্যক আরএসএস-এর লোক এবং শিখ উদ্বাস্তুরা ওই গাড়িগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। গাড়িতে সওয়ার ব্যক্তিদের থেকে টেনে বের করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়"।
এই সময় সৈন্যরা হয় হত্যাকাণ্ডে যোগ দিয়েছিল বা দর্শকের ভূমিকায় ছিল। গণহারে হত্যার খবর গোপন রাখা হয়।
একইভাবে পরেরদিন অন্যান্য পরিবারগুলোও আরো একটা গাড়িতে সওয়ার হয়। তাদেরও একই পরিণতি হয়েছিল।
যারা কোনোরকমে হত্যাকারীদের হাত থেকে বেঁচে যান, তাদের মধ্যে কেউ কেউ শিয়ালকোটে পৌঁছে নিজেদের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনান।
এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে প্রশাসন। এমনকি জম্মুর জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনার বিষয়েও অস্বীকার করে। তবে এই প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন ভাসিন।
তৎকালীন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, "ভদ্র হওয়া সত্ত্বেও এর পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে তিনি আমাকে সতর্ক করেন"।
"তিনি আমাকে প্রথমে বলেন, আমি তোমাকে অপকর্মের জন্য জেলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু তুমি আমার মতো ক্ষত্রিয় এবং এখানে আমার আত্মীয় রয়েছে, তাই আমি শুধু তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি। এখন শান্তি কমিটি গঠন করে শান্তির প্রতিষ্ঠার কাজ করার সময় নয়"।
"হিন্দু ও শিখদের এখন মুসলিম সাম্প্রদায়িকদের হাত থেকে রক্ষা করার সময়, যারা তাদের হত্যা ও পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলার পরিকল্পনা করছে। আমরা ইতিমধ্যে এক হিন্দু-শিখ ডিফেন্স কমিটি গঠন করেছি। এই কমিটিকে সমর্থন করাই তোমার এবং তোমার সঙ্গীদের পক্ষে ভালো"।
ওই কর্মকর্তা ভাসিন এবং তার সঙ্গীদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলেন। ভাসিন উল্লেখ করেছেন, "ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা রেহারি এলাকায় হিন্দু ও শিখ ছেলেদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তুমি এবং তোমার সঙ্গীরা প্রশিক্ষণে যোগ দিলে ভালো হবে"।
"আমি আমার এক সঙ্গীকে প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠিয়েছিলাম, সে ফিরে এসে জানায় ওই শিবিরে আরএসএস-এর যুবা সদস্য এবং অন্যরা ৩০৩ রাইফেল ব্যবহারের জন্য সৈন্যদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে"।
এই হত্যাকাণ্ডে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা নেই, তবে অনুমান করা হয় এই সংখ্যা ২০ হাজার থেকে দুই লাখ ৩৭ হাজার।
এই সময়ে, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের কিছু অংশে চলে যান। জম্মুতে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে বদল দেখা দেয়।
ভাসিন বলেছেন, "আমার একটা ঘটনা মনে আছে। মেহেরচাঁদ মহাজন (রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী), যিনি জম্মুতে পৌঁছনোর পর প্রাসাদে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হিন্দুদের প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন- এখন যেহেতু ক্ষমতা জনগণের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে, তাদের উচিত সমতা দাবি করা"।
"ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে জনসংখ্যার অনুপাতে এত বৈষম্য রয়েছে, তারা কীভাবে সমতার দাবি করতে পারে? নিচে রামনগর রাখ (জঙ্গল) এর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি (মেহেরঁচাদ) বলেছিলেন- জনসংখ্যাগত গঠনও পরিবর্তন হতে পারে"।
ভারতীয় সাংবাদিক সাঈদ নাকভি তার বই 'বিয়িং আদার: মুসলিমস ইন ইন্ডিয়া'তে লিখেছেন, "১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, জম্মু প্রদেশের মুসলিম জনসংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়নেরও (১২ লাখ) বেশি ছিল এবং ওই প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল দুই মিলিয়ন (২০ লাখ)"।
"জম্মু জেলার মোট জনসংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৫ লাখ যার মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৭ লাখ। রাজধানী জম্মুর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ হাজার যার মধ্যে মুসলিম ১৬ হাজার"।
কাশ্মীর টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা জামওয়াল বলেন, জম্মু প্রদেশের ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায় যে দেশভাগের জনতাত্ত্বিক গঠন পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের গণহত্যার কারণে জম্মু জেলার অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামে শুধু হিন্দু বা শিখ জনগোষ্ঠীই রয়ে গিয়েছিল।
শুধু জম্মু জেলাতেই (যা জম্মু প্রদেশের একটা প্রধান অংশ) মুসলিম জনসংখ্যা ছিল এক লাখ ৫৮ হাজার ৬৩০।
এদিকে ১৯৪১ সালে মোট জনসংখ্যা, অর্থাৎ চার লাখ ২৮ হাজার ৭১৯-এর ৩৭ শতাংশ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। ১৯৬১ সালে মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখ ১৬ হাজার ৯৩২-এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৬৯৩ জন, অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ।
'ক্যালকাটা স্টেটসম্যান'-এর সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স তার বই 'পাকিস্তান'-এ লিখেছেন যে "আগস্ট থেকে ১১ সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাঞ্জাব, পাতিয়ালা এবং কাপুরথালায় শুরু হওয়া পদ্ধতিগত নৃশংসতা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল"।
"প্রায় দুই লাখ মানুষ নিখোঁজ হন যাদের সম্ভবত হত্যা করা হয়েছিল, মহামারী বা কঠোর আবহাওয়ার কারণে মারা যান। বাকিরা অসহায় অবস্থায় পশ্চিম পাঞ্জাবে পালিয়ে যান"।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৫১ সালের ছয়ই মার্চ অনুষ্ঠিত ৫৩৪ নম্বর সভায় উল্লেখ করা হয়েছে- "ভারতের দেশভাগের সঙ্গে সমসাময়িক ভয়াবহ গণহত্যার পরপর মহারাজা এক ধরনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন যার মাধ্যমে (টাইমস অফ লন্ডনের বিশেষ সংবাদদাতার ১৯৪৮ সালের দশই অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে) তার নেতৃত্বে অবশিষ্ট ডোগরা অঞ্চলে ডোগরা বাহিনী, হিন্দু ও শিখদের সাহায্যে পরিকল্পিতভাবে দুই লাখ ৩৭ হাজার মুসলিমকে হয় নির্মূল কর হয় বা তাদের সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়"।
ওই একই প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাঠানদের আক্রমণের পাঁচ দিন আগে এবং মহারাজার ভারতে অন্তর্ভুক্তির নয় দিন আগে এই ঘটনাগুলো ঘটে।
হোরেস আলেকজান্ডার ১৯৪৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি 'দ্য স্পেক্টেটর'-এ উল্লেখ করেছিলেন জম্মুতে নিহত মুসলিমদের সংখ্যা দুই লাখ।
বেদ ভাসিনের মতে, জম্মু শহরে তালাব খাতিকান এবং কনক মান্ডির মতো অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যা ছিল, অন্যদিকে বেশিরভাগই হিন্দুরা থাকতেন। মহারাজার সেনাবাহিনী হিন্দুদের বাড়ির ভেতরে অবস্থান নিয়েছিল এবং সেখান থেকেই তারা মুসলিম বাসিন্দাদের ওপর গুলি চালায়।
তিনি উল্লেখ করেছেন, আরএসএস লোকেরা এবং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অন্য ব্যক্তিরা শিশু এবং নারীদেরও রেহাই দেয়নি। নারীদের ধর্ষণ করা হয় এবং শিশু ও পুরুষদের হত্যা করা হয়।
তবে মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা বিভাজন ছিল। মুসলিমদের একটা অংশ মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল এবং তাই তারা সুরক্ষিত ছিল। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন দরিদ্র মুসলমানরা।
১৯৪৭ সালের ২৪শে অক্টোবর করাচীর সংবাদপত্র 'ডেলি গেজেট'-এর সংখ্যায় কাশ্মীর টাইমসের হিন্দু সম্পাদক জি কে রেড্ডি বলেছিলেন, "নিরস্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে ডোগরায় যে সহিংসতার উন্মাদ নগ্ন নৃত্য চলেছে তা যে কোনো মানুষকে বিব্রত করবে। আমি দেখেছি কীভাবে নৃশংসতা চালানো এই লোকগুলো এবং সৈন্যদের সশস্ত্র দল পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হওয়া অসহায় মুসলিম শরণার্থীদের গুলি করেছে এবং তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলেছে..."।
"জম্মুর যে হোটেল রুমে আমাকে আটক করা হয়েছিল, সেখান থেকে আমি এক রাতে ২৬টা গ্রাম পুড়িয়ে ফেলার কথা গুনেছি এবং আশেপাশের শরণার্থী শিবির থেকে সারা রাত ধরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছিল"।
ব্রিটিশ কূটনীতিক সিবি ডিউকও একই কথা বলেছেন যিনি অক্টোবর মাসে ওই অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর জম্মুর পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। সাঈদ নাকভি তার সংকলিত লেখার ৯০ তম খণ্ড থেকে উদ্ধৃত করেছেন, "জম্মুর হিন্দু, শিখ এবং বাইরে থেকে আসা লোকেরা মুসলমানদের হত্যা করেছিল। সেখানে যা ঘটছে তার জন্য দায়ী কাশ্মীরের মহারাজা"।
ভাসিনের মতে, জম্মুতে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছে তা একতরফা ছিল না। এই অঞ্চলের কিছু অংশে, বিশেষত রাজৌরি, মিরপুর এবং বর্তমানে পাকিস্তান শাসিত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ও শিখকেও হত্যা করা হয়।
কিন্তু এটাও বাস্তব যে আরএসএস-এর দ্বারা মুসলমানদের গণহত্যার নেপথ্যে সেখানকার প্রশাসনের স্পষ্ট সমর্থন ছিল।।
আমস্টার্ডাম ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল হিস্ট্রির ফেলো ইদ্রিস কান্ট ১৯৪০-এর দশকের কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ডোগরা সরকার এই ঘটনার নথি নষ্ট করে দেশভাগের সময়কার এই ভয়াবহ গণহত্যাকে চাপা সমন্বিত চেষ্টা চালিয়েছিল।
'দ্য হিস্টোরিক্যাল রিয়েলিটি অফ দ্য কাশ্মীর ডিসপিউট' বইয়ের লেখক পিজি রসুলের মতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও কাশ্মীরি নেতা শেখ আবদুল্লাহ যখন জম্মুতে মুসলিমদের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেন তখন তাদের এই 'মর্মান্তিক ঘটনা' সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন তারা নীরব ছিলেন।
রসুল বলেছেন, "নিশ্চয়ই তারা ভেবেছিলেন কাশ্মীর হারালেও জম্মু তাদের হাতে থাকা উচিত এবং এর একমাত্র উপায় হলো সেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা"।
বেদ ভাসিনের মতে মহারাজার ভীম্বের সফরের পরে, পুঞ্চের কিছু অঞ্চলে যেমন পালান্দারি, বাগ এবং সুধৌতিতে গণহত্যা চালানো হয়য়। এরপরই ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়া সৈন্যরা মহারাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন।
এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সদ্য স্বাধীন দুই দেশ- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটা ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। এইভাবে কাশ্মীর নিয়ে সংঘাতেরও সূত্রপাত হয়।
জম্মু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পরে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া) থেকে উপজাতি মিলিশিয়ারা কাশ্মীর আক্রমণ করে। জম্মুর অনেক মুসলিম পারিবারিক সম্পর্ক ছিল কাশ্মীরের সঙ্গে। উপজাতি বাহিনী কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডোগরা সেনাবাহিনী জম্মুর দিকে পালিয়ে যায়।
হরি সিং দিল্লির সঙ্গে ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকশন স্বাক্ষর করেন। এরপর ওই উপজাতি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দিল্লি থেকে সেনা পাঠানো হয়।
কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই লড়াই শেষ পর্যন্ত প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে পরিচালিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি এবং ইসলামাবাদ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য দুই দেশের মধ্যে বিভক্ত ছিল। তবে দুই দিকের কাশ্মীরিরাই ছয়ই নভেম্বর এই হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা

নিউইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানি নির্বাচিত হওয়ায় ইসরাইলের রাজনৈতিক ও বিশ্লেষক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইসরাইলি কর্মকর্তারা শুক্রবার বলেছেন, ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থানের জন্য পরিচিত মামদানির জয় ইসরাইল–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
১৩ মিনিট আগে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শনিবার দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরাইলকে হিজবুল্লাহর সঙ্গে বিদ্যমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
১ ঘণ্টা আগে
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) আগামী বছর থেকে বহুল প্রতীক্ষিত একক পর্যটন ভিসা চালু করতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে এক ভিসা দিয়েই ছয়টি দেশ ভ্রমণ করা যাবে।
২ ঘণ্টা আগে
ইরান ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ খরার মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজধানী তেহরানে পর্যায়ক্রমে পানি সরবরাহ বন্ধ বা সীমিত রাখার পরিকল্পনা করছে দেশটি, শনিবার এমনটি জানিয়েছেন ইরানের জ্বালানি মন্ত্রী আব্বাস আলিআবাদি।
২ ঘণ্টা আগে