রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগামী ৪–৫ ডিসেম্বর ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে আসছেন বলে শুক্রবার নিশ্চিত করেছে ক্রেমলিন ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরিবর্তিত বৈশ্বিক মিত্রতা, রাশিয়ার ওপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা এবং এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে এই সফরকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পুতিন ২৩তম ভারত–রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে তাঁর একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। ক্রেমলিন জানিয়েছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিসহ নানা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু আন্তঃসরকারি ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
তিন বছর পর পুতিনের ভারত সফর
পুতিন শেষবার ভারতে এসেছিলেন ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক কয়েক মাস আগে। যুদ্ধ বিশ্ব বাণিজ্য ও নিরাপত্তা কাঠামো বদলে দিলেও ভারত–রাশিয়া সম্পর্ক স্থিতিশীলই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি মস্কোর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে ভারত “কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন” নীতি অনুসরণ করছে।
চাপের মধ্যেও স্থিতিশীল অংশীদারিত্ব
২০১০ সালে “বিশেষ ও সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারিত্ব” ঘোষণার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। বার্ষিক সম্মেলন, প্রতিরক্ষা কমিশন এবং প্রযুক্তি–জ্বালানি সহযোগিতার মতো আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক টিকে আছে নানা বৈশ্বিক ধাক্কা সত্ত্বেও।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য রেকর্ড ৬৮.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়—যার প্রায় পুরোটাই ভারতের ছাড়মূল্যে রুশ ক্রুড অয়েল আমদানির ফল। এখন রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও রাশিয়া ভারতের অস্ত্রভাণ্ডারের ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে এবং এস-৪০০ সিস্টেমের চালান এখনও চলছে।
বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতাও বাড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম গবেষণা, আর্কটিক স্টাডি—বিভিন্ন ক্ষেত্রেই যৌথ উদ্যোগের পরিকল্পনা আছে। প্রতি বছর শত শত ভারতীয় শিক্ষার্থী রুশ বৃত্তি পেয়ে থাকেন।
তেল, নিষেধাজ্ঞা ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ
এবারের দিল্লি বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় শক্তি–সহযোগিতা। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতীয় রিফাইনারিগুলো ডিসেম্বর মাসে রুশ তেল আমদানি তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নামাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নভেম্বরেই অতিরিক্ত তেল কিনে রিফাইনারিগুলো নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর চেষ্টা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে এসে) বারবার ভারতকে রুশ তেল ক্রয় কমাতে চাপ দিচ্ছেন। রুশ তেলের ওপর সর্বোচ্চ ৫০০% পর্যন্ত নতুন মার্কিন শুল্ক—যা জি-৭-এর ৬০ ডলার মূল্যসীমা কার্যকরের অংশ—ভারতের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
তবু ভারত স্পষ্ট করেছে যে জ্বালানি নিরাপত্তা দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ সালের শুরুতে নিষেধাজ্ঞা বদলানো ও রাশিয়ার নতুন ছাড়মূল্যের ফলে ভারতের রুশ তেল আমদানি আবার বাড়তে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন ও বৈশ্বিক সমীকরণ
ইউক্রেন যুদ্ধ চতুর্থ বছরে প্রবেশ করলেও শান্তি আলোচনার অগ্রগতি নেই। ভারত ২০২২ সাল থেকেই সংলাপের আহ্বান জানায় এবং জাতিসংঘে রাশিয়াবিরোধী ভোটে অনুপস্থিত থাকে।
মোদির প্রচলিত বার্তা—“এটা যুদ্ধের যুগ নয়”—পুতিনের সঙ্গেও জুলাই মাসে পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি, যা ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার কূটনৈতিক সংকেত।
ভারত–রাশিয়া–চীন সমন্বয় বাড়তে পারে কি না তা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের নজরে থাকলেও ভারত–চীন সীমান্ত উত্তেজনা এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। রাশিয়া বলছে, তারা ভারত–চীন সংঘাতে নিরপেক্ষ, যা দিল্লি–মস্কোর সম্পর্ককে আঞ্চলিক উত্তেজনা থেকে আংশিকভাবে সুরক্ষিত রাখছে।
পুতিনের এই সফর তাই বৈশ্বিক ভূরাজনীতির জটিল অধ্যায়ে ভারত–রাশিয়া সম্পর্কের নতুন বার্তা বয়ে আনবে বলে বিশ্লেষকদের মত।
তথ্যসূত্র: ডেইলি সাবাহ
এসআর

