জুলাই বিপ্লবের পর পতিত ফ্যাসিবাদী শাসকের পলায়নের মধ্য দিয়ে যখন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের অন্ধকার অধ্যায় ভাঙতে শুরু করে, ঠিক তখনই ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত ভয়াবহ বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন বছরের পর বছর ধরে গুমের শিকার হওয়া নির্যাতিতরা।
কেউ ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, কেউ আইনজীবী, কেউ সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। বহুজন ফিরতে পারলেও অসংখ্য মানুষের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত মিলেনি। যারা ফিরেছেন, তারা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন নির্যাতনের ক্ষত; আর যারা ফেরেননি, তাদের পরিবার আজও অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার এক নতুন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। গুম ফেরত ব্যক্তি এবং গুমের শিকারদের পরিবারের সদস্যরা সরাসরি ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। কেউ নিজের বন্দি জীবনের যন্ত্রণা নিয়ে, কেউ হারানো প্রিয়জনের ছায়া বুকে নিয়ে এখন নির্বাচনি মাঠে।
গুমের অন্ধকার ইতিহাস
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াল ও ভয়ঙ্কর অধ্যায়গুলোর একটি হলো ‘গুম’। বিরোধী দল-মতের রাজনীতিকদের উপর নেমে এসেছিল নির্যাতন-নিপীড়নের নির্মম স্টিম রোলার। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই গুমের সংস্কৃতি যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশে পরিণত হয়েছিল। গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির তথ্যমতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯ শত অভিযোগ পড়েছে। কমিশন মনে করে, ওই শাসনামলে গুমের সংখ্যা তিন হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এই গুমকাণ্ড পরিচালনা করে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত, যাদের মধ্যে এখনো ২৭ শতাংশ ব্যক্তির সন্ধান মেলেনি। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে গেছে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত ‘গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারি’ ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে এই অন্ধকার অধ্যায়ের পর্দা। বেরিয়ে আসছে আসল সত্য।
জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে নেমে আসা ঢল ভেঙে দেয় দীর্ঘ দেড় দশকের দমনযন্ত্র। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের আশ্বাস দেয়।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গুম ফেরতদের নতুন লড়াই
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—গুম ও নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোর অংশগ্রহণ এবার উল্লেখযোগ্য। কেউ নিজের জীবনের গুমের ক্ষত নিয়ে, কেউ হারানো প্রিয়জনের ক্ষত নিয়ে এখন ভোটের মাঠে রয়েছেন।
ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম (ব্যারিস্টার আরমান)– জামায়াত, ঢাকা-১৪
বিচারিক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারানো জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমানকে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮ বছরের বিভীষিকাময় ‘আয়নাঘর’ থেকে শেষে জুলাই বিপ্লবে মুক্তি পান। এবার তিনিই দাঁড়াচ্ছেন সেই রাজনীতিতে, যেই রাজনীতির কারণেই সারা জীবন নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে তার পরিবারকে। তিনি লড়ছেন বিএনপির প্রার্থী সানজিদা ইসলাম তুলির বিরুদ্ধে।
সানজিদা ইসলাম তুলি–বিএনপি, ঢাকা-১৪
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গুম হন তার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমন, তৎকালীন বিএনপি নেতা। ভাই হারানোর পর তিনি গড়ে তোলেন সংগঠন ‘মায়ের ডাক’, যেখানে গুম পরিবারগুলোর আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। সংগঠনটির মাধ্যমে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের পর তিনি ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধানের মুখ খুলতে বাধ্য করেন। নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে ভাই হারানোর ক্ষত নিয়েই লড়াই করে গেছেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এবার তিনিও প্রত্যক্ষভাবে ভোটযুদ্ধে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ–বিএনপি, কক্সবাজার-১
২০১৫ সালের ১০ মার্চ দলীয় মুখপাত্র থাকাকালে গুম হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। ৬১ দিন আয়নাঘরে রাখার পর তাকে ঠেলে দেওয়া হয় ভারতের ভেতরে। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সেখানে আবার তার বিচার হয়। বহু নিপীড়ন সহ্য করে জুলাই বিপ্লবের পর দেশে ফিরেছেন। এবার কক্সবাজার-১ আসনে তিনি বিএনপির মনোনীত প্রার্থী।
হুম্মাম কাদের চৌধুরী–বিএনপি, চট্টগ্রাম-৭
আওয়ামী লীগের আমলে বিচারিক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারানো বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দলটির সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্তান তিনি। ২০১৬ সালের আগস্টে গুম হয়ে হারিয়ে ফেলেন জীবনের প্রায় একটি বছর। প্রতিহিংসামূলক এ নির্যাতন তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরাতে পারেনি। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন চট্টগ্রাম-৭ আসনে।
তাহসিনা রুশদীর–বিএনপি, সিলেট-২
স্বামী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুম হন। এখন পর্যন্ত তার সন্ধান মেলেনি। সংসার, সন্তান, জীবন—সবকিছু সামলে তিনি আন্দোলন করে গেছেন স্বামীর সন্ধানে। এবার তিনিও নির্বাচনি মাঠে। স্বামী হারানো এ নারী গুমের ক্ষত নিয়েই নির্বাচন করবেন সিলেট ২ আসন থেকে।
সাবিরা সুলতানা মুন্নি–বিএনপি, যশোর-২
২০১১ সালে গুম করে হত্যার শিকার হন তার স্বামী যশোর জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলাম। এরপর থেকে রাজনীতিতে আসেন সাবিরা মুন্নি। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি। স্বামী হারানোর বেদনা নিয়েই সাবিরা মুন্নি এবার নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার আরমান, সানজিদা ইসলাম তুলি—এদের মতো আরো অনেকেই গুমের ক্ষত নিয়েই এবার নির্বাচনি মাঠে নেমেছেন। ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়নের দীর্ঘ সময় পার করে তারা কেউ নিজে গুম থেকে ফিরে এসেছেন, আবার কেউ হারিয়েছেন পরিবারের সদস্যকে। এবার একই ক্ষত নিয়ে তারা সরাসরি নির্বাচনের লড়াইয়ে।
কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে গুমের অভিযোগ জমা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, গত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে আমার মতো যারা গুম হয়েছেন, যারা পুলিশের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, যারা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন, যারা আওয়ামী সন্ত্রাস দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেনÑসব অভিযোগের বিচার যেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই হয়। বিএনপি ক্ষমতায় এলেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। এ অন্যায়ের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি আরো যোগ করেন, এটা শুধু বিএনপির প্রতিশ্রুতি নয়Ñএটা জাতির আকাঙ্ক্ষা। জুলাই শহীদদের রক্তের দাবিÑন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ব্যারিস্টার আরমান এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, আমার স্বপ্ন বাংলাদেশকে এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে বিচারব্যবস্থা জনগণের অধিকার নিশ্চিত করবে। কোনো দল, কোনো পরাশক্তি বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির ইশারায় জনগণের অধিকার খর্ব হবে না।
গুমের শিকারদের সম্পর্কে তিনি বলেন, গুমফেরত অধিকাংশই ছাত্র, যারা ফিরে এসে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি; তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। গুম-শিকার পরিবারগুলোও বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিজয়ী হলে আমার প্রথম কাজ হবে গুম-শিকার পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা।
ব্যক্তিগতভাবে নিজের ওপর করা অপরাধগুলো ক্ষমা করলেও ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিচার না হলে গুম আবার ফিরে আসবে। তাই এই সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ করতে বিচার প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, এ রাজনীতির কারণেই আমি বাবাকে ও জীবনের সোনালি সময় হারিয়েছি। তবু রাজনীতিতে এসেছি প্রমাণ করতে যে জুলুম আদর্শকে পরাজিত করতে পারে না। আমাদের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়াই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় হবেই ইনশাআল্লাহ।
বিশ্লেষকদের মত : এ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরীক্ষা
বিশ্লেষকদের মতে এ প্রেক্ষাপটে আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। কারণ, প্রথমবারের মতো গুমের শিকার ও তাদের পরিবার সরাসরি নির্বাচনি রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে আসছেন। তারা শুধু প্রার্থী নন, বরং রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের জীবন্ত সাক্ষ্যও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, এ নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়, তবে এটি দেশের জন্য হবে এক প্রতীকী মুক্তির সূচনা। গুমের অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। তবে বাস্তবতা এখনো জটিল। সমাজে ভয় আর অবিশ্বাসের ছায়া পুরোপুরি কাটেনি। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, নতুন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পুরোনো বিভাজন হয়তো আবার মাথা তুলতে পারে। তবু আশা হারাচ্ছে না সাধারণ জনগণ। তারা বিশ্বাস রাখে বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ আর পথ হারাবে না।
তিনি আরো বলেন—গুমের ক্ষত গভীর, কিন্তু এই ক্ষত নিয়েই জাতি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে। যারা ফিরেছেন, তারা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির হিসাব মিলাতে আসেননি, তারা ন্যায়ের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছেন। তার মতে, এই নির্বাচন কেবল ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নয়; এটি ন্যায়বিচার, স্মৃতি ও মানবতার পুনর্জাগরণের লড়াই।
গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সদস্য নুর খান লিটন আমার দেশকে বলেন, আগামী নির্বাচনে গুম ফেরত ও তাদের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই প্রার্থী হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ জনপ্রতিনিধি হলে আমরা আশা করি, তারা কার্যকর নীতি গ্রহণ করবেন, যাতে গুম সংস্কৃতি চিরতরে বিলুপ্ত হয়।

