গাজীপুর জেলার সবকটি আসনেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। কোনো কোনো আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে দলীয় ত্যাগী ও প্রভাবশালী নেতাদের মাঝে ক্ষোভ ছিল। তবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে সে ক্ষোভ অনেকটাই মিটে গেছে। তারা আশা করছেন, তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি আরো ভালো হবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই জোরদারভাবে মাঠে নেমেছে। ভোটাররা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বেশ কয়েকটি আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
গাজীপুর-১
কালিয়াকৈর উপজেলা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক তিনটি ইউনিয়ন (কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, বাসন) নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন কালিয়াকৈর পৌরসভার সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান। শুরুতে এ আসনে কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, হুমায়ুন কবির খান, ব্যারিস্টার ইসরাক আহমেদ সিদ্দিকী ও মজিবুর রহমানসহ একাধিক প্রভাবশালী নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। মজিবুর রহমান বলেন, দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মানুষ ধানের শীষে ভোট দেবে। দলের নেতাকর্মীরাও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।
জামায়াতে ইসলামী এ আসনে প্রার্থী করেছে সাবেক সচিব শাহ আলম বকশিকে। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ নির্বাচনি এলাকায় জামায়াত নির্বাচনি প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে। জামায়াত প্রার্থী বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে তারা দুঃশাসনমুক্ত দেশ গড়তে চায়।
কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সিকদার বলেন, নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তবে জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটবে। এতদিন মানুষ ভোট দিতে পারেনি, ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে প্রবল। তাই জনগণের প্রত্যাশা বর্তমান সরকার একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে।
এছাড়া গাজীপুর-১ আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যারা আলোচনায় রয়েছেন, তারা হলেন গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী পাঠান আজহার, এনসিপির দেওয়ান মাহবুব আলম পনির, জাকের পার্টির মানিক সরকার, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মাওলানা রুহুল আমিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এএইচএম আরিফ।
গাজীপুর-২
গাজীপুর-২ আসনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানের ছেলে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মনজুরুল করিম রনি। তিনি মনে করেন, তার বাবার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই এবার ভোটে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ফলে এ আসনের জনগণ বিএনপির বাইরে ভোট দেবে না।
অন্যদিকে জামায়াত মনোনয়ন দিয়েছে মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির (শ্রমবিষয়ক) মোহাম্মদ হোসেন আলীকে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর বিকল্প নেই। তাই জনগণ আগামীতে দাঁড়িপাল্লা মার্কাতেই ভোট দেবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আলফাজ উদ্দিনের মতে, শিল্পাঞ্চল হওয়ায় শ্রমিক কল্যাণে যে দল বেশি কার্যকর হবে, ভোটাররা তাকেই বেছে নেবেন।
ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য দলগুলো জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আট দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নির্বাচন করতে জোট গঠন করায় তাদের কোনো প্রার্থী প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।
গাজীপুর-৩
গাজীপুর সদর উপজেলার তিন ইউনিয়ন ও শ্রীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসন সব সময় আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। তবে দুঃশাসন, কল-কারখানায় চাঁদাবাজি ও জমি দখলসহ নানা কারণেই বিতর্কিত ছিলেন দলটির সংসদ সদস্যরা। ৫ আগস্টের গণআন্দোলনে রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনের পর জনগণ যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
এবার বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সহসম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চুকে প্রার্থী করেছে। মনোনয়ন ঘোষণার পর কিছু ক্ষোভ থাকলেও দলীয় নির্দেশে তা অনেকটাই কমে এসেছে। রফিকুল ইসলাম বাচ্চু এলাকায় উঠান বৈঠক ও দলীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, এ দেশে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বিএনপির নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ড. জাহাঙ্গীর আলম। দলীয় কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অত্যাচারে মানুষ বিরক্ত। তাই সেদিক বিবেচনায় এবং সমাজে ইসলামের আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর বিকল্প নেই। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতে ইসলামী সব সময় কাজ করে যাচ্ছে, আগামী দিনেও তা অব্যাহত থাকবে।
গাজীপুর-৪
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে। বিএনপি এ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহর ছেলে শাহ মো. রিয়াজউল হান্নানকে। তিনি জানান, আওয়ামী লীগের শাসনে কাপাসিয়ার জনজীবন দুর্বিষহ ছিল, মানুষ এবার পরিবর্তন চায়। তিনি বলেন, আগামী দিনে মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য।
আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সালাউদ্দিন আইয়ুবী। তার দাবি, আওয়ামী লীগ মাঠে নেই, বিএনপির ওপর জনগণের আস্থা কমে গেছে, তাই জামায়াতের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে।
এ আসন সম্পর্কে স্থানীয় ভোটার অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, অন্য কোনো দল শক্তিশালী প্রার্থী না দিলে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
এছাড়া গাজীপুর-৪ আসনে ইসলামী আন্দোলনের মোহাম্মদ কাজিম উদ্দিন এলাকায় নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মানবেন্দ্র দে (কাস্তে প্রতীক) প্রকাশ্যে গণসংযোগ না করলেও দলীয় কর্মসূচিতে আলোচনার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন।
গাজীপুর-৫ আসন
এ আসনে বিএনপি প্রার্থী সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপি সভাপতি একেএম ফজলুল হক মিলন। একক প্রার্থী হওয়ায় নির্বিঘ্নে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। এ আসনে ভোট বিপ্লব হবে আশা করে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্বাচন।
জামায়াত থেকে গাজীপুর মহানগর নায়েবে আমির খায়রুল হাসান প্রার্থী হয়েছেন। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, এ এলাকা আজও বঞ্চিত, অনুন্নত ও অবহেলিত। জনগণের করের টাকা জনগণের উন্নয়নেই ব্যয় হতে হবে। শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা মাঠে আছি। জামায়াতের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ নিরাপদ।
এ আসনে জনতার দল থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির নেতা মোহাম্মদ আজম খান; যদিও এখনো প্রকাশ্য প্রচারে নামেননি তিনি।
এ আসনের ভোটার কৃষক আব্দুর রহমান আকন্দ বলেন, ভোট তো অনেকবার দিয়েছি। আওয়ামী লীগকে দিয়েছি, বিএনপিকে দিয়েছি; এবার কী করব এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। সময় এলে আমরা চিন্তা করব নতুন কিছু করার।
নির্বাচন কমিশন আসন পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে বাগেরহাট জেলার চারটি সংসদীয় আসন থেকে একটি কমিয়ে এবং ‘গাজীপুর-৬ সংসদীয় আসন’ বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করে। পরে হারানো আসন ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করে বাগেরহাটবাসী। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গাজীপুর-৬ আসন বাতিল করে বাগেরহাটের আসন পুনর্বহালের রায় দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করে নির্বাচন কমিশন ও গাজীপুর-৬ আসনের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা। গত বুধবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ-সংক্রান্ত পৃথক চারটি লিভ টু আপিল খারিজ করে বাগেরহাট ও গাজীপুরের সীমানা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে।

