রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে ঠিকানা পেয়েছে জুলাই বিপ্লবের বহু বেওয়ারিশ শহীদের লাশ। গতকাল রোববার কাকডাকা ভোরে গোরস্থানের গেটের সামনে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাশেদা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন- ‘আমার ছেলে গত বছরের ১৮ জুলাই বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।
তাকে বার বার বারণ করেও আটকাতে পারিনি, যোগ দেয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। এরপর যাত্রাবাড়ী থেকে নিখোঁজ হয়। শত স্থানে গেছি, কিন্তু আজও লাশটা খুঁজে পাইনি। অন্তত আমি তার মরদেহটা চাই, নির্দিষ্ট কবরটা দেখতে চাই।’ এদিন রাশেদার মতো প্রায় ২০টি পরিবার এসেছিল জুলাই বিপ্লবে নিখোঁজ স্বজনের লাশের সন্ধানে।
কবরস্থানে ভিড় করা অনেকের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। অনেকেই কথা বলেছিলেন, কেউ শুধু চোখের পানি ফেলছিলেন। তারা জানান, লাশ উত্তোলনে আইনি বহু জটিলতা ছিল। অবশেষে সব জটিলতা পেরিয়ে নিহতদের লাশ উত্তোলন করল পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)।
সংস্থাটি জানায়, জুলাই বিপ্লবে শহীদ অজ্ঞাত পরিচয়ের ১১৪ জনের পরিচয় শনাক্তে মরদেহ উত্তোলনের কাজ শুরু হলো। স্বজনদের সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে। বিষয়টি জানানোর জন্য গতকাল সকালে রায়েরবাজারে প্রেস ব্রিফিংও আয়োজন করে সিআইডি।
এ সময় সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি ছিবগাত উল্লাহ বলেন, জুলাই বিপ্লবে আনাসের মতো যারা বুকের রক্ত ঢেলে দেশের জন্য রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। এই কবরস্থানে যারা নাম-পরিচয়হীন অবস্থায় শুয়ে আছেন, তখন তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করা হয়নি। তাদের পরিচয় উদঘাটন করা জাতির কাছে আমাদের একটি পবিত্র দায়িত্ব। আজ সেই মহান কাজের সূচনা হলো। অনেক বাবা-মা, ভাই-বোন বছরের পর বছর তাদের আপনজনের পরিচয়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। আমরা এই বেদনার দায় থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাই।
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে জুলাই বিপ্লবে অজ্ঞাত পরিচয় শহীদদের মরদেহ উত্তোলন করা হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে আর্জেন্টিনা থেকে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফন্ডিব্রাইডার ঢাকায় এসে পুরো কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি গত ৪০ বছরে ৬৫টি দেশে একই ধরনের অপারেশন পরিচালনা করেছেন। আন্তর্জাতিক প্রোটোকল, মিনেসোটা প্রোটোকল অনুসরণ করে মরদেহ উত্তোলন, পোস্টমর্টেম, ডিএনএ স্যাম্পলিংসহ প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন হবে। সিটি করপোরেশন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ডিএমপি, বিভাগীয় কমিশনারসহ সব স্টেকহোল্ডারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, আবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ১১৪টি কবর চিহ্নিত হয়েছে, যা বাস্তবে কমবেশি হতে পারে। মরদেহ উত্তোলনের পর পোস্টমর্টেম, বোন স্যাম্পল বা টিস্যু সংগ্রহ এবং ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হবে। পরিচয় নিশ্চিত হলে ধর্মীয় সম্মান বজায় রেখে পুনরায় দাফন করা হবে।
এই সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা জানি না, কোন কবরে কে আছেন। তাই এই প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই কার্যক্রমের মাধ্যমে সব শহীদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুযায়ী মরদেহের কোনো ছবি বা সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। বিষয়টি অত্যন্ত সম্মানজনক ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
লাশের পরিচয় শনাক্তের পর কেউ লাশ গ্রহণ করতে চাইলে তা পারবেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘লাশ গ্রহণের আবেদন করতে পারবেন।’
কতজন আবেদন করেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ১০ জন স্বজন আবেদন করেছেন। লাশ উত্তোলনের পর এই আবেদন বাড়তে পারে। তবে যারা আবেদন করবেন তারা সিআইডিতে যোগাযোগ করতে পারবেন। সিআইডি হটলাইনে যোগাযোগ করলে স্বজনদের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের (ইউএনএইচআর) আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফন্ডিব্রাইডার বলেন, ‘আমি গত তিন মাস ধরে সিআইডির সঙ্গে কাজ করছি। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আন্তর্জাতিক ফরেনসিক মানদণ্ড অনুসরণ করেই এই কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে স্থানীয় সংস্থা সিআইডিকে সহযোগিতা করা হবে।’
সিআইডি জানিয়েছে, গত ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাহিদুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ১১৪টি মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে প্রাণ হারানো অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের ১১৪ শহীদকে অজ্ঞাত পরিচয়ে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিহতরা অধিকাংশই যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর এলাকায় শহীদ হন। তাদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে জায়গা না হওয়ার কারণে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছিল। পরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে সেগুলো রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
রুবেল নামে এক অজ্ঞাত শহীদের ভাই জানান, ‘আমার ভাই যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছে। তাকে আমরা খুঁজে পাইনি। আমরা তার লাশটি চাই। এতে কিছুটা হলেও মনে সান্ত্বনা আসবে।
জানা গেছে, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও সংগঠকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সমাধান পাননি স্বজনরা। বারবার আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিপ্লবের ১৫ মাস পরও অজানা রয়ে গেছে সেসব শহীদের পরিচয়। ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার আমলি আদালতে একটি মামলা করে জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যবসায়ী সোহেল রানার পরিবার।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও মামলার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় সোহেল রানার পরিবার আদালতে আবার আবেদন করে। তারা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সোহেল রানাসহ অজ্ঞাত ১১৪ জনের লাশ উত্তোলন, ময়নাতদন্ত ও পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণের আবেদন করেন।
এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও আদালতে একটি আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুরও করে। আদালতের নির্দেশনার পর সরকার ১১৪ জনের লাশের ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ২ আগস্ট গণকবর পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওই সময় তিনি জানান, শুরুতে কবরগুলো থেকে লাশ তুলতে স্বজনরা রাজি না হলেও পরে মত দিয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশগুলো শনাক্ত করা হবে। পরিচয় শনাক্তের পর কোনো স্বজন লাশ নিতে চাইলে দেওয়া হবে।

