দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বাগেরহাট সরকারি (প্রফুল্ল চন্দ্র) পিসি কলেজের এখন ভগ্ন দশা। দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোগত জীর্ণতা ও শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
কলেজটি শতবর্ষ অতিক্রম করলেও প্রতিষ্ঠানটির ভবন, শ্রেণিকক্ষ, জনবল ও শিক্ষা সুবিধায় উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন না হওয়ায় প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রতি বিভাগে ১২ জন করে শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও অনেক বিভাগে শিক্ষক আছেন মাত্র দু-একজন। এই কলেজে শিক্ষকদের ৬৮টি পদের মধ্যে ৩৩টি পদ শূন্য থাকায় নিয়মিত পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
একাধিক শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘পুরো কলেজটাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিনিয়ত আমরা ভূমিকম্পের আতঙ্কে থাকি। এই বুঝি বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে—এমন আশঙ্কার মধ্য দিয়ে ভাঙা ভবনে ক্লাস করতে হয় আমাদের। শিক্ষক নেই, কক্ষ নেই—এভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমাদের পড়ালেখা।’
কলেজ সূত্রে জানা যায়, মোট পাঁচটি শিক্ষা ভবনের মধ্যে দুটি পরিত্যক্ত। ৮৪টি শ্রেণিকক্ষের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রয়েছে মাত্র ৪৮টি, যার অধিকাংশরই আংশিক ভগ্নদশা। শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের চাপাচাপি করে ক্লাস করতে হচ্ছে। নেই কোনো অডিটোরিয়াম। ১১টি সেমিনার কাম বিভাগীয় কক্ষের মধ্যে পাঁচটির অবস্থাই নাজুক, যা প্রায় অকার্যকর। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, ভবনের জীর্ণ অবস্থা, ভাঙা সিলিং ও দেয়ালের নিচে বসে ক্লাস করতে হয়। পরিবহন না থাকায় দূরবর্তী শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়েন। প্রতিষ্ঠানটিতে নেই কোনো ক্যান্টিন সুবিধা। এখানে হল না থাকায় শিক্ষার্থীদের বাইরে ভাড়া মেসে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। ক্লাস সুবিধা ও নিরাপত্তার সংকটে পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
সরকারি পিসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শেখ জিয়াউল ইসলাম জানান, এত বড় প্রতিষ্ঠানে হাজারো শিক্ষার্থী, কিন্তু অবকাঠামো এখনো সেই পুরোনো মানের। এই পরিস্থিতিতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন একাডেমিক ভবন, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক সংকট নিরসন, আধুনিক সেমিনার হল—সবকিছুই এখন জরুরি প্রয়োজন। আমরা আশা করছি অতি দ্রুতই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে, কারণ এসব সমস্যা আর টেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। কলেজের দীর্ঘদিনের সংকট ও সমস্যাগুলো আমরা ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
জেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার মো. ছাদেকুল ইসলাম বলেন, এটা অনেক ঐতিহ্যবাহী এবং পুরোনো কলেজ। এখানে শিক্ষক সংকট রয়েছে। নেই কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, যা অন্যান্য কলেজগুলোয় আছে। এখানে শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে লেখাপড়ার যে সুযোগ সেটা হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
জেলা শিক্ষা প্রকৌশলী কর্মকর্তা মো. নাফিজ আক্তার বলেন, পিসি কলেজের অধ্যক্ষ একটি ১০ তলা বিল্ডিংয়ের জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছেন। প্রধান প্রকৌশলী বরাবর আবেদন করেছেন, আমি সেটা ফরওয়ার্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছি।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন বলেন, শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কলেজটির অবকাঠামোগত অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষ করে দুটি ভবন অত্যন্ত জরাজীর্ণ। এ বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে যদি প্রস্তাবনা পাঠায়, আমরা সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠাব। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে তারা নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
শতবর্ষের ঐতিহ্য কিন্তু উন্নয়ন শূন্য এই প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। ১৯১৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজকে দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর বলা হলেও অব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত দুরবস্থার কারণে আজ প্রতিষ্ঠানটি গভীর সংকটে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে করেন, দ্রুত নতুন ভবন নির্মাণ, সংস্কার, শিক্ষক নিয়োগ, পরিবহন ও ক্যান্টিন সুবিধা নিশ্চিত না করতে পারলে কলেজের শিক্ষার পরিবেশ আরো নষ্ট হবে।

