Ad T1

ছায়ানট ও হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির বিকাশ

মেজর (অব.) নাসিম
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ৪৫
সানজিদা খাতুনের (সাখা) মৃতদেহ ঘিরে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সমাবেশে গীত পরিবেশনের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গভীর প্রভাব ফেলেছে। নেটিজেনরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরূপ মন্তব্য করছেন। তবে তার মৃত্যুর জন্য রবীন্দ্রধারার অনুসারীরা যথেষ্ট বিলাপও করছেন। সাখাকে দেখা হয় ষাটের দশকে রমনার বটমূলে রবীন্দ্র কনসার্ট চালুর সাংস্কৃতিক বিপ্লবী হিসেবে। তিনি তখন তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের ‘রবীন্দ্র বিতৃষ্ণার’ বিপরীতে বিদ্রোহ করে রবীন্দ্রসংগীতকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে তুলে ধরেন, যেজন্য তিনি দেশে আওয়ামী, বাম ও ভারতে বেশ সমাদৃত ছিলেন।
পক্ষান্তরে যারা ইসলামপন্থি রাজনীতি করতেন, নির্দিষ্ট করে বললে বাঙালি মুসলিম মানসকে যারা অগ্রগণ্য মনে করতেন, তারা ছায়ানটের বাড়বাড়ন্তকে এ দেশের মুসলিম আইডেন্টিটির প্রতিপক্ষ মনে করেন। ছায়ানটকর্মীদের বাহ্যিক বেশভূষা, যেমন কপালে আধুলি সাইজের লাল টিপ, হাতাকাটা ব্লাউজ, পুরুষদের খদ্দের পাঞ্জাবি, চটের ব্যাগ—এসব দেখে তারা ভুরু কুচকান এবং একধরনের শ্লেষমিশ্রিত মন্তব্যও করেন।
উল্টো চিত্রে এই মুসলিম আইডেন্টিটির ধারক-বাহকদের দাড়ি-টুপি, পাগড়ি, টাখনুর ওপরে প্যান্ট-পাজামা পরা, মেয়েদের হিজাব পরা প্রভৃতি নিয়ে ছায়ানটকর্মীদের চিন্তা-ভাবনার ধারক-বাহকদের মধ্যে আতঙ্ক মেশানো মন্তব্য থাকে। দেশটা ভারতের করতলে চলে গেল—এর বিপরীতে দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেছে, বা তালেবানে ভরে গেছে, এমন সাংস্কৃতিক ভিন্নতা অনেক দিন থেকেই চলছে।
আমাদের দেশের সংস্কৃতির দুটো ধারা—ছায়ানটধারা বনাম ইসলামি, এই দেশের আওয়ামী সাংস্কৃতিক বোদ্ধারা যাকে তালেবানি সংস্কৃতি বলতে চান।
আওয়ামী লীগের ও ভারতের স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছিল ছায়ানট সাংস্কৃতিক লাইনকে জোরালো করার। আমাদের ইসলামিক আইডেনটিটিকে কটাক্ষ করার একটা রাষ্ট্র প্রযোজিত উদ্যোগকে ভারত খুব প্রমোট করত। রবীন্দ্রসংগীতকে নিয়ে ভারতের যত্নের ছিটেফোঁটাও নজরুলসংগীতকে নিয়ে করা হয়নি। ভারতের আধিপত্যের বাহন হিসেবে রবীন্দ্রসংগীতকে মোদি সরকার খুব অগ্রাধিকার দিত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ধ্যানমগ্ন হয়ে রেজোয়ানা বন্যাজির গান শুনছেন, যা দেখে আমাদের ছায়ানট সংস্কৃতির জগতে বিশাল ঢেউ খেলে গেছে। পদ্মশ্রী খেতাব পেয়ে আমরা যারপরনাই খুশি। এই দেশের মুসলিম আইডেন্টিটিকে কটাক্ষ করা যায়, এমন সবকিছুই ছিল ছায়ানট সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের লক্ষ্য—অনাবশ্যকভাবে একটি নাটকের একটি খারাপ চরিত্রের মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দেওয়া হবে। তাই তো আমরা দেখি পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঘিরে রাষ্ট্রের হুড়োহুড়ি, দাড়ি-টুপিওয়ালা চাঁদ-তারকার দানবটিকে মুসলিম আইডেন্টিটি হিসেবে প্রতিবার দেখানো হয়।
মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত ও দাফন-কাফন করা ইসলামিক রীতি। অন্যদিকে ছায়ানটকর্মীদের মতে, এসবের কোনো দরকার নেই, জানাজার দরকার কী, কবর দেওয়ার দরকার কী? চলো শহীদ মিনারে—লাশকে মানবতার সেবার জন্য মেডিকেল কলেজে দান করে দাও, ল্যাঠা চুকে যাবে। মৌলভি ডেকে জানাজা পড়ার এবং কোথায় কবর হবে, তার ঝক্কি সামলানোর কোনো দরকার নেই।
‘স্রষ্টার কাছে গেলাম না, বা তাকে মানি না’ এ রকম একটা দুর্বিনীত মনোভাবকে তুলে আনা; আমাদের সমাজের সব সময়কার দেখা অভ্যস্ত চোখকে ভিন্ন এক জগতে ঠেলে দেওয়া, যেন দেখতে দেখতে সব গা-সওয়া হয়ে যায়, ইসলামিক সেনসিটিভিটি বিলীন হয়ে যায়—এ সবই করা হয় মুক্ত চিন্তা, প্রগতিশীল চিন্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে। তাই উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাস্তার মোড়ে সিগারেট হাতে তরুণীদের শক্তির জোগান দিতে ব্যস্ত তৎপর কিছু মহল; কারণ সেই একই—এটা আমাদের মুসলিম আইডেন্টিটিকে চ্যালেঞ্জ করে।
অধিকাংশ বাম শাহবাগি ও ছায়ানটকর্মী আমাদের ইসলামিক আইডেনটিটির বিরুদ্ধে একটা কালচারাল ক্যু ঘটিয়ে ফেলেছে। যেসব ক্ষেত্রে মুসলিম আইডেন্টিটি আছে, সেই সবকিছুতেই তারা তালেবানি গন্ধ পায়।
এই ছায়ানট সংস্কৃতির বিপরীতে বা তাকে টেক্কা দিতে নামতে দেখি ঈদে মিলাদুন্নবী বা ঈদ মিছিলের আয়োজন। এবার শুনতে পাচ্ছি বটমূলে নাকি গরু কোরবানি হবে!
রবীন্দ্রসংগীত চর্চা বা তার সাহিত্যের চর্চা ছিল শুধুই একটা মামুলি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এখন এটা হয়ে গেছে ফেনী নদীর ওপর ভারতের আগ্রহে সেতু নির্মাণের নামে আগ্রাসনের একটা সেতুবন্ধ!
রবীন্দ্রসংগীতকে একটা ধর্মীয় আচার-আচরণে পরিণত করার মধ্য দিয়ে এ দেশে আওয়ামী লীগ কর্তৃক নব প্রচলিত ধর্ম দীন-ই-আওয়ামী লীগের সমার্থক করা হচ্ছে।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত