আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ইরানে হামলায় কেন বেকায়দায় ইসরাইল

ইবরাহিম আল মারাসিমোহাম্মদ এসলামী
ইরানে হামলায় কেন বেকায়দায় ইসরাইল
ছবি: সংগৃহীত

ইরানে ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলা দেশটিতে সরকারবিরোধী ক্ষোভ উসকে দেওয়ার পরিবর্তে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকেই আরো জোরদার করেছে। এই গণজাগরণ বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন নয়, বরং জাতীয় প্রতিরক্ষার প্রতি জনগণের দৃঢ় সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ।

ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহতদের জানাজায় বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ শরিক হচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইনেও নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং দোয়া করা হচ্ছে। এমনকি একসময় যারা ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারাও এখন ‘মাতৃভূমির রক্ষক’দের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছেন।

বিজ্ঞাপন

কর্মজীবী জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত এলাকা এবং গ্রামাঞ্চলে যেখানে বিরোধী দলগুলো তাদের অবস্থান শক্ত করার জন্য লড়াই করছে, সেসব এলাকায়ও এখন ইসরাইলি আগ্রাসনবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। তারাও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধে জোরালো সমর্থন জানাচ্ছেন। ফলে ইরানি জনগণকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরাইল যে চেষ্টা শুরু করেছিল, তা এখন কোনোই কাজে আসেনি, বরং উল্টো হয়েছে। ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। তাদের এই ঐক্য কার্যত সরকারের পক্ষেই যাচ্ছে।

ফলে ইসরাইল ইরানে সরকার পরিবর্তনের যে টার্গেট নিয়ে ইরানে হামলা করেছিল, তা উল্টো ফল বয়ে এনেছে। বর্তমান ইসলামপন্থি সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার পরিবর্তে দলমত নির্বিশেষে ইরানিরা তাদের জাতীয় পতাকার নিচে সমবেত ও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এটা ইরানের প্রতি বাইরের যেকোনো শক্তির হুমকির বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ইরানে সরকার পরিবর্তনের জন্য দেশটির উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছে ইসরাইল, সেটাকে এখন অনেক ইরানি নাগরিকই তাদের জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখছেন।

ইরানের পরমাণু স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামোর ওপর ইসরাইলের হাই-প্রোফাইল হামলা এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে অকার্যকর করে দেওয়ার বাইরে ইসরাইলের হামলার মূল সাফল্য অন্য জায়গায়। আর সেটি হচ্ছে, ইরানের শীর্ষ সেনা নেতৃত্বকে টার্গেট করে হত্যা করা। সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি এবং আইআরজিসির আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার আমির আলি হাজিজাদেহসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সেনা কমান্ডারকে হত্যা করে ইসরাইল ইরানের সামরিক নেতৃত্বের কাঠামোতে বড় ধরনের আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে।

কারণ এরাই ছিলেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর নীতিনির্ধারক। অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এদের হত্যা করতে পারাটা ইসরাইলের সামরিক অভিযানের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কৌশলগত কমান্ড কাঠামোতে এ ধরনের সমন্বিত আঘাত নিঃসন্দেহে ইসরাইলের একটি বড় সাফল্য এবং ইরানের বড় ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা।

তবে অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে এই সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইসরাইল অজ্ঞাতসারেই ইরানকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক উপহার দিয়েছে। আর সেটি হচ্ছে রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি জোরদার হওয়া। দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তারা ইসরাইলকে তাদের অভিন্ন জাতীয় শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে।

ইসরাইলি কর্মকর্তারা অবশ্য সরকারিভাবে এ কথা বলার চেষ্টা করছেন, তাদের সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্যই ছিল পরমাণু কর্মসূচির লক্ষ্য অর্জন করা থেকে ইরানকে বিরত রাখা, সেটাতে তারা সফল হয়েছেন। শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পাশাপাশি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সম্প্রচার ভবনে হামলা করা থেকে এটা বোঝা যায়, ইসরাইলের এই সামরিক অভিযান তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফসল।

মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ও পশ্চিমা রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক মহলে একটি ধারণা রয়েছে যে, ইসরাইলের দীর্ঘদিনের কৌশলগত বিশ্লেষণ হচ্ছে, শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও অখণ্ড ইরান তাদের জন্য মারাত্মক এক ভূরাজনৈতিক হুমকি। ইসরাইল ইরানকে কেবল তাদের বৈরী একটি রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে না, একইসঙ্গে তারা ইরানকে তাদের আঞ্চলিক সভ্যতাগত প্রতিদ্বন্দ্বীও বিবেচনা করে। এজন্যই ইহুদি বর্ণবাদী এই রাষ্ট্রটি চাইছে ইরানকে নিয়ন্ত্রণের বা নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে। এজন্য কেবল দেশটির পরমাণু কর্মসূচিই নয়, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকেও ইরানকে দাবিয়ে রাখতে চায় ইসরাইল।

কৌশলগত এসব দিক বিবেচনা করেই ইরানের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে গোপন তৎপরতা চালিয়ে আসছে ইসরাইল। চেষ্টা করা হয়েছে, কূটনৈতিকভাবে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার। অর্থনীতিকে পঙ্গু করার জন্য পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার খড়্‌গ তো অব্যাহত আছেই। এর পাশাপাশি ইরানের ইসলামপন্থি শাসকদের ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে দিয়ে বছরের পর বছর ধরে নানামুখী প্রচারণা চালানো হয়েছে।

মোটকথা, ইরানকে দুর্বল করার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টাই করা হয়েছে ইসরাইলের পক্ষ থেকে। এজন্য ইরানের ভিন্নমতাবলম্বীদের দিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের ব্যবস্থাও করা হয়। বিশেষ করে ২০২২ সালে মাহসা আমিনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারী ও তরুণদের যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, তার প্রধান স্লোগানই ছিল ‘নারী, জীবন, মুক্তি’। এই আন্দোলন ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠার পর দেশটির শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকার বিরুদ্ধে গুরুতর একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলনে সমর্থন ও নানাভাবে সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।

এই আন্দোলনের সময় ইরানের ক্ষমতাচ্যুত শাসক রেজা শাহ পাহলভির উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত নির্বাসিত যুবরাজ রেজা পাহলভি লাইমলাইটে চলে আসেন। সে সময় তিনি ইসরাইলও সফর করেন এবং ইরানের বর্তমান শাসকদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ইসরাইলের পক্ষ থেকেও সেসময় বলা হয়েছিল, ইরানের জনগণকে দেশটির নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে উদ্ধার করতে তাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

এ সময় ইসরাইল ও পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও ইরানের জনগণের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে জনগণকে দেশটির শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করার প্রচারণা চালানো হয়। বলা হয়, তাদের এই প্রচারণা ইরানের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশটির শাসকদের বিরুদ্ধে। রেজা পাহলভি ছাড়াও ইরানের সাবেক ফুটবলার আলী কারিমি সরকারবিরোধী এই প্রচারণায় প্রকাশ্যেই যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাসব্যাপী স্থায়ী হওয়া এই আন্দোলন ইরানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন না পাওয়ায় ধীরে ধীরে থেমে যায়।

ইরানে সরকার পরিবর্তনের জন্য ইসরাইলের এবারের চেষ্টা শুরুতেই বুমেরাং হয়ে উঠেছে। ইসরাইলের নির্বিচার বিমান হামলা দেশটির জনগণকে এক কাতারে সমবেত করেছে। তারা এখন ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। ইরানের সমাজে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিরোধ থাকলেও এখন সেসব নিয়ে কেউই মাথা ঘামাচ্ছে না, বরং এখন সবাই ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাদের জাতীয় পতাকার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইলের হামলা ইরানের সমাজে বিভাজন তৈরি দূরের কথা, সবাইকেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক কাতারে নিয়ে এসেছে।

মোহাম্মদ এসলামি : ইউনিভার্সিটি অব মিনহোর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক

ইবরাহিম আল মারাসি : ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মার্কোসের সহযোগী অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন