কাজী ওমর ফারুক এফসিএ
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের মানুষের অসীম ত্যাগ এবং জাতীয় বীরদের অসীম সাহসী সংগ্রামের মাধ্যমে ৫ আগস্ট মানুষ প্রত্যাশার এক আলোকরশ্মি দেখতে পেয়েছে। জাতির দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সংস্কার প্রচেষ্টার ফলাফলের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ। তারা বিশ্বাস করতে চায়, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিয়ে যখন দায়িত্ব হস্তান্তর করবে, তখন মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষা ও অর্জনের একটি সমন্বয় অবলোকন করার সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়, যত সময় না আমাদের আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে, কার্যত কোনো সংস্কারই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনবে না।
শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু গণনির্বাচনের মূল লক্ষ্যই জাতির জন্য সৎ, শক্তিশালী, বলিষ্ঠ ও ভিশনারি নেতৃত্ব খুঁজে নিয়ে তাদের হাতে দেশ ন্যস্ত করা। স্বাধীনতার পর দু-একটি নির্বাচনে মানুষের ভোট প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে কালোটাকা ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন ও মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করা, যার সুযোগ সৃষ্টি হয় আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতিতে।
জানিপপের পর্যবেক্ষণ অনুসারে নির্বাচনে ভোট ক্রয়ে ভোটপ্রতি এক হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আর টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থই হলো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির পক্ষে জাতির নেতা হয়ে বসে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। প্রার্থীদের পক্ষে এ অবৈধ টাকা ব্যয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, কারণ প্রার্থীরা আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণে তাদের আয়ব্যয়ের হিসাব সহজেই গোপন করতে সক্ষম।
এর থেকেও ভয়ংকর হলো, আর্থিক খাতের কুশাসন দেশে একটি শক্তিশালী ক্ষমতাধর গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, যারা দেশের রাজনীতির পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক, বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার হরণকারী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধক এবং শ্রমবাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে শ্রম বা কর্মজীবী মানুষ শোষণকারীর ভূমিকায় অবস্থান নিয়েছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কেউ বিত্তবৈভবের মালিক হতেই পারেন, প্রতিষ্ঠা করতে পারেন বহু শিল্পকারখানা, তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে বেশ কিছু বিজনেস কনগ্লোমারেট সৃষ্টি হয়েছে, যাদের উত্থানটা হয়েছে অনৈতিক ও অসাধু পন্থায় এবং দুষ্কর্মের মাধ্যমে। তারা সেই অনৈতিক পন্থা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিধারাকে বিপন্ন করে তুলছে। আর তাদের জন্য এ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে আমাদের দেশের আর্থিক খাতের কুশাসন। তাদের ব্যবসায়ের প্রকৃত বা সঠিক হিসাব কোনো কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় না, তাদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের বিষয়ে কোনো জবাবদিহি নেই, সরকারের রাজস্ব খাতে তাদের কন্ট্রিবিউশন অনেকটাই তাদের ইচ্ছানির্ভর, তাদের প্রদর্শিত বার্ষিক আয়-ব্যয় ও সম্পদের প্রবৃদ্ধির ব্যবধান দেখার কেউ নেই। তারা তাদের অর্থ-বিত্ত দিয়ে সবকিছুকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে সক্ষম হয়। শঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য হলো ব্যাংকিং খাত পুরোটাই এখন তাদের উদরে প্রবেশ করেছে। ব্যাংকঋণের সিংহভাগ গুটিকয়েক কথিত বিজনেস কনগ্লোমারেটদের করায়ত্ত হয়ে আছে, যার বৃহৎ অংশ আবার দেশের সীমানা পার হয়ে বেগম পাড়ার মতো অসংখ্য বিদেশি শহরে সম্পদ গঠনে ব্যবহার করা হয়েছে বা বৈদেশিক ব্যাংকে জমা পড়েছে। শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর ঋণ-সম্পদ তুলনা করলে দেখা যাবে বড় রকমের ঘাটতি। তারা কি লোকসান দিয়ে ব্যবসা করেছেন? কখনো না, বরং বড় অঙ্কের মুনাফা অর্জন করে ওই মুনাফা এবং অনৈতিক প্রভাব ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে গৃহীত ব্যাংকঋণ, উভয়টির মাধ্যমে অর্থসম্পদ পুঞ্জীভূত করে বিদেশে পাচার করেছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের দিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ জানে, প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের মুখে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এর ভেতরের ঘটনা ভিন্ন, যা তাদের কোনো কোনো আর্থিক কনসালটেন্ট জানতেন। তাদেরই একজনের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ সরকারের দমননীতির কারণে দেশে নিরাপদবোধ করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে এর সম্পদের বিপরীতে সৃষ্টি করা হয় বহুগুণ ঋণ ও আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডিসহ বিভিন্ন পন্থায় অর্থ পাচার করা হয় দেশের বাইরে। তারা এই অপরাধকে সুচতুরভাবে ঢেকে দিয়ে ব্যবসায়িক পতন দেখিয়ে মানুষের সহানুভূতি নিয়ে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করে। অথচ এর মধ্যে আমাদের জন্য অনেকগুলো সতর্কবার্তা ছিল, যা কাজে লাগিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি চিহ্নিত করলে জাতির জন্য সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যেত।
অতি সম্প্রতি মেঘনা গ্রুপের এক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের একটি সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ ২১ বছর থেকে আর্থিক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা, আত্মসাৎ করেছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আত্মসাৎ করেছে রাষ্ট্রের রাজস্ব ও ব্যাংকের সুদ, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে করেছে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে গণ্য। আর্থিক ক্ষেত্রে এই অপরাধগুলোর সুযোগ অবারিত রেখেছে মূলত দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতি, যার অন্যতম উপজীব্য হলো আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের ক্ষেত্রে জালিয়াতির বাধাহীন সুযোগ।
দেশের মানুষের দুর্ভোগের আরেক কারণ, দেশে অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি তথা মূল্যস্তরের ব্যাপক অস্থিতিশীলতা, যার মূল কারণও হলো দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতি। কোনো একটি সময়ের মধ্যে যদি মুদ্রাস্ফীতি হয় ১৫ শতাংশ, নিম্নবিত্ত একজন মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চিত এক লাখ টাকার বিনিময়ে ওই ব্যক্তি ১৫ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য কম পাবেন, তার অর্থ হলো তার পকেট থেকে ১৫ হাজার টাকা ‘নাই’ হয়ে যাওয়া, যা ন্যায়সংগত হতে পারে না। অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে অন্যায্য ঋণ বিতরণের মাধ্যমে অর্থের অতিপ্রবাহ সৃষ্টি, অনুৎপাদনশীল খাতে অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়, বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কর ফাঁকি, অন্যদিকে প্রকল্পগুলোয় প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অতিমাত্রায় অধিক প্রদর্শিত ব্যয়, সরকারের বাহুল্য ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার কর্তৃক মানি সার্কুলেশন প্রভৃতি কারণে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়ে মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এ ঘটনাগুলো অবিরতভাবে সংগঠিত হওয়া স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে মূলত আমাদের আর্থিক খাতের তথ্য উপস্থাপনায় অনিয়ন্ত্রিত ম্যানুপুলেশনের চর্চা থেকে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা এবং দেশে রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপানো হয়। ফলে মূল্যস্তর ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
দেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ফিরিস্তি সংবাদপত্রের পাতায় এক লেখায় সংকুলান হওয়ার নয় বলে এতটুকু উদাহরণে সীমিত রেখে বলতে চাই, নির্বাচন কমিশন সংস্কার বলেন আর আইন সংস্কার বলেন, সব সংস্কারের পরেও যাদের নেতৃত্বে যাবে দেশ, তারা কিন্তু সেই ব্যবসায়ী ব্যক্তিরাই, যারা আর্থিক অনিয়মের প্রাণপুরুষ হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনকে তাদের ভোগবিলাসিতার উপকরণে পরিণত করে রেখেছে। তারা কি তাদের এ দীর্ঘ বিলাসী জীবন ত্যাগ করতে সম্মত বা প্রস্তুত হবেন? তারা কি চাইবেন আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে দীর্ঘ জীবনের অস্বচ্ছ পথে অর্থ উপার্জনের চর্চার সুযোগ হারাতে?
সে কারণেই প্রয়োজন সবার আগে আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন সুনিশ্চিত করা। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যেসব কার্যকর পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে, তা হলো—১. ব্যবসায়ীদের হিসাব বিবরণী প্রস্তুতের ক্ষেত্রে হিসাব বিবরণীতে সত্য ও ন্যায়সংগত অবস্থার প্রতিফলন নিশ্চিত করা; ২. সরকারি প্রতিটি ব্যয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ ন্যায্যতা নিশ্চিত করা; ৩. ব্যাংকিং খাতকে ক্ষতবিক্ষতকারী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের রাজত্বকে বিজিত করা; ৪. ভবিষ্যতে আর্থিক দস্যু সৃষ্টির সব পথকে বন্ধ করে দেওয়া।
সুযোগ হলে পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য উপরোক্ত প্রতিটি বিষয় বাস্তবায়নের উপায়-উপকরণ ও সম্ভাব্যতা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার আশা রাখি।
লেখক : চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট
ksofaruk@yahoo.com
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের মানুষের অসীম ত্যাগ এবং জাতীয় বীরদের অসীম সাহসী সংগ্রামের মাধ্যমে ৫ আগস্ট মানুষ প্রত্যাশার এক আলোকরশ্মি দেখতে পেয়েছে। জাতির দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সংস্কার প্রচেষ্টার ফলাফলের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ। তারা বিশ্বাস করতে চায়, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিয়ে যখন দায়িত্ব হস্তান্তর করবে, তখন মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষা ও অর্জনের একটি সমন্বয় অবলোকন করার সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়, যত সময় না আমাদের আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে, কার্যত কোনো সংস্কারই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনবে না।
শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু গণনির্বাচনের মূল লক্ষ্যই জাতির জন্য সৎ, শক্তিশালী, বলিষ্ঠ ও ভিশনারি নেতৃত্ব খুঁজে নিয়ে তাদের হাতে দেশ ন্যস্ত করা। স্বাধীনতার পর দু-একটি নির্বাচনে মানুষের ভোট প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে কালোটাকা ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন ও মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করা, যার সুযোগ সৃষ্টি হয় আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতিতে।
জানিপপের পর্যবেক্ষণ অনুসারে নির্বাচনে ভোট ক্রয়ে ভোটপ্রতি এক হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আর টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থই হলো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির পক্ষে জাতির নেতা হয়ে বসে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। প্রার্থীদের পক্ষে এ অবৈধ টাকা ব্যয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, কারণ প্রার্থীরা আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণে তাদের আয়ব্যয়ের হিসাব সহজেই গোপন করতে সক্ষম।
এর থেকেও ভয়ংকর হলো, আর্থিক খাতের কুশাসন দেশে একটি শক্তিশালী ক্ষমতাধর গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, যারা দেশের রাজনীতির পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক, বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার হরণকারী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধক এবং শ্রমবাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে শ্রম বা কর্মজীবী মানুষ শোষণকারীর ভূমিকায় অবস্থান নিয়েছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কেউ বিত্তবৈভবের মালিক হতেই পারেন, প্রতিষ্ঠা করতে পারেন বহু শিল্পকারখানা, তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে বেশ কিছু বিজনেস কনগ্লোমারেট সৃষ্টি হয়েছে, যাদের উত্থানটা হয়েছে অনৈতিক ও অসাধু পন্থায় এবং দুষ্কর্মের মাধ্যমে। তারা সেই অনৈতিক পন্থা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিধারাকে বিপন্ন করে তুলছে। আর তাদের জন্য এ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে আমাদের দেশের আর্থিক খাতের কুশাসন। তাদের ব্যবসায়ের প্রকৃত বা সঠিক হিসাব কোনো কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় না, তাদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের বিষয়ে কোনো জবাবদিহি নেই, সরকারের রাজস্ব খাতে তাদের কন্ট্রিবিউশন অনেকটাই তাদের ইচ্ছানির্ভর, তাদের প্রদর্শিত বার্ষিক আয়-ব্যয় ও সম্পদের প্রবৃদ্ধির ব্যবধান দেখার কেউ নেই। তারা তাদের অর্থ-বিত্ত দিয়ে সবকিছুকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে সক্ষম হয়। শঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য হলো ব্যাংকিং খাত পুরোটাই এখন তাদের উদরে প্রবেশ করেছে। ব্যাংকঋণের সিংহভাগ গুটিকয়েক কথিত বিজনেস কনগ্লোমারেটদের করায়ত্ত হয়ে আছে, যার বৃহৎ অংশ আবার দেশের সীমানা পার হয়ে বেগম পাড়ার মতো অসংখ্য বিদেশি শহরে সম্পদ গঠনে ব্যবহার করা হয়েছে বা বৈদেশিক ব্যাংকে জমা পড়েছে। শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর ঋণ-সম্পদ তুলনা করলে দেখা যাবে বড় রকমের ঘাটতি। তারা কি লোকসান দিয়ে ব্যবসা করেছেন? কখনো না, বরং বড় অঙ্কের মুনাফা অর্জন করে ওই মুনাফা এবং অনৈতিক প্রভাব ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে গৃহীত ব্যাংকঋণ, উভয়টির মাধ্যমে অর্থসম্পদ পুঞ্জীভূত করে বিদেশে পাচার করেছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের দিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ জানে, প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের মুখে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এর ভেতরের ঘটনা ভিন্ন, যা তাদের কোনো কোনো আর্থিক কনসালটেন্ট জানতেন। তাদেরই একজনের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ সরকারের দমননীতির কারণে দেশে নিরাপদবোধ করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে এর সম্পদের বিপরীতে সৃষ্টি করা হয় বহুগুণ ঋণ ও আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডিসহ বিভিন্ন পন্থায় অর্থ পাচার করা হয় দেশের বাইরে। তারা এই অপরাধকে সুচতুরভাবে ঢেকে দিয়ে ব্যবসায়িক পতন দেখিয়ে মানুষের সহানুভূতি নিয়ে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করে। অথচ এর মধ্যে আমাদের জন্য অনেকগুলো সতর্কবার্তা ছিল, যা কাজে লাগিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি চিহ্নিত করলে জাতির জন্য সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যেত।
অতি সম্প্রতি মেঘনা গ্রুপের এক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের একটি সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ ২১ বছর থেকে আর্থিক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা, আত্মসাৎ করেছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আত্মসাৎ করেছে রাষ্ট্রের রাজস্ব ও ব্যাংকের সুদ, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে করেছে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে গণ্য। আর্থিক ক্ষেত্রে এই অপরাধগুলোর সুযোগ অবারিত রেখেছে মূলত দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতি, যার অন্যতম উপজীব্য হলো আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের ক্ষেত্রে জালিয়াতির বাধাহীন সুযোগ।
দেশের মানুষের দুর্ভোগের আরেক কারণ, দেশে অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি তথা মূল্যস্তরের ব্যাপক অস্থিতিশীলতা, যার মূল কারণও হলো দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অনুপস্থিতি। কোনো একটি সময়ের মধ্যে যদি মুদ্রাস্ফীতি হয় ১৫ শতাংশ, নিম্নবিত্ত একজন মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চিত এক লাখ টাকার বিনিময়ে ওই ব্যক্তি ১৫ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য কম পাবেন, তার অর্থ হলো তার পকেট থেকে ১৫ হাজার টাকা ‘নাই’ হয়ে যাওয়া, যা ন্যায়সংগত হতে পারে না। অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে অন্যায্য ঋণ বিতরণের মাধ্যমে অর্থের অতিপ্রবাহ সৃষ্টি, অনুৎপাদনশীল খাতে অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়, বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কর ফাঁকি, অন্যদিকে প্রকল্পগুলোয় প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অতিমাত্রায় অধিক প্রদর্শিত ব্যয়, সরকারের বাহুল্য ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার কর্তৃক মানি সার্কুলেশন প্রভৃতি কারণে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়ে মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এ ঘটনাগুলো অবিরতভাবে সংগঠিত হওয়া স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে মূলত আমাদের আর্থিক খাতের তথ্য উপস্থাপনায় অনিয়ন্ত্রিত ম্যানুপুলেশনের চর্চা থেকে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা এবং দেশে রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপানো হয়। ফলে মূল্যস্তর ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
দেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ফিরিস্তি সংবাদপত্রের পাতায় এক লেখায় সংকুলান হওয়ার নয় বলে এতটুকু উদাহরণে সীমিত রেখে বলতে চাই, নির্বাচন কমিশন সংস্কার বলেন আর আইন সংস্কার বলেন, সব সংস্কারের পরেও যাদের নেতৃত্বে যাবে দেশ, তারা কিন্তু সেই ব্যবসায়ী ব্যক্তিরাই, যারা আর্থিক অনিয়মের প্রাণপুরুষ হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনকে তাদের ভোগবিলাসিতার উপকরণে পরিণত করে রেখেছে। তারা কি তাদের এ দীর্ঘ বিলাসী জীবন ত্যাগ করতে সম্মত বা প্রস্তুত হবেন? তারা কি চাইবেন আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে দীর্ঘ জীবনের অস্বচ্ছ পথে অর্থ উপার্জনের চর্চার সুযোগ হারাতে?
সে কারণেই প্রয়োজন সবার আগে আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন সুনিশ্চিত করা। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যেসব কার্যকর পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে, তা হলো—১. ব্যবসায়ীদের হিসাব বিবরণী প্রস্তুতের ক্ষেত্রে হিসাব বিবরণীতে সত্য ও ন্যায়সংগত অবস্থার প্রতিফলন নিশ্চিত করা; ২. সরকারি প্রতিটি ব্যয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ ন্যায্যতা নিশ্চিত করা; ৩. ব্যাংকিং খাতকে ক্ষতবিক্ষতকারী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের রাজত্বকে বিজিত করা; ৪. ভবিষ্যতে আর্থিক দস্যু সৃষ্টির সব পথকে বন্ধ করে দেওয়া।
সুযোগ হলে পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য উপরোক্ত প্রতিটি বিষয় বাস্তবায়নের উপায়-উপকরণ ও সম্ভাব্যতা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার আশা রাখি।
লেখক : চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট
ksofaruk@yahoo.com
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করা হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে দাবি আদায়ের জন্য মিছিল-সমাবেশ বা বিক্ষোভ করার অধিকার সবার আছে।
১৮ ঘণ্টা আগেখুব অস্থির হয়ে আছি। শুধু আমি নই। দেশে, সমাজে, একালে যারা বাস করছেন তারা সবাই অধীর। পরিস্থিতি অস্থির। সময় অধীর। কী হয়, কী হয় শঙ্কা চারদিকে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার এক ঝড়ো অভ্যুত্থানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম পড়ে যায়। কিন্তু সে অভ্যুত্থান ছিল এক অসমাপ্ত বিপ্লব।
১ দিন আগেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে তিনি ঘোষণাটি দিলেন, তা দেখে রীতিমতো চমকে উঠেছেন বেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। কারণ এ ঘোষণার মাত্র এক দিন আগেই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘দুটি নিউক্লিয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের যুদ্ধে
১ দিন আগেমাত্র চার দিনের সংক্ষিপ্ত একটি যুদ্ধ। কিন্তু এর প্রভাব ও গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কেউ কারো সীমানা অতিক্রম না করে এমন এক যুদ্ধ দেখাল, যা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অভূতপূর্ব সাফল্য বিশ্বের তাবৎ সামরিক বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে।
১ দিন আগে