আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও গণঅভিপ্রায়

আবদুল লতিফ মাসুম

২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও গণঅভিপ্রায়

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের গণঅভিপ্রায় ছিল গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্র মানেই জনগণের শাসন। নগর-রাষ্ট্র থেকে আধুনিক রাষ্ট্র এতই বিস্তৃত হয়েছে যে, আসলে সব মানুষ একত্র হয়ে শাসন করতে পারে না। তাই গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কীভাবে নির্ধারিত হবে? অবশেষে সভ্যতার পথ বেয়ে ‘নির্বাচন’ নামের ব্যবস্থার মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গণঅভিপ্রায়ের বাস্তবায়ন ঘটে। আধুনিক বিশ্বে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি এতই জনপ্রিয় যে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বৈরতন্ত্রও নিজেকে ‘গণতন্ত্রী’ বলে দাবি করে। পাকিস্তানের একসময়ের তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করেছিলেন। শেখ মুজিব মার্কসীয় স্টাইলে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’র নামে বাকশালতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নয়া গণতন্ত্রের কথা বলতেন। শেখ মুজিবকন্যা আমাদের ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ উপহার দিয়েছিলেন! গণতন্ত্রের আগে-পিছে যখন বিশেষণ ব্যবহৃত হবে, তখন বুঝতে হবে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’! নিশ্চয়ই ভেজাল আছে সেখানে। প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য আমাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষা সুবিদিত। কোম্পানি আমল থেকে এতদঞ্চলের মানুষরা কম-বেশি গণতন্ত্রের অনুশীলন করে আসছে। ১৯৪৬, ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৯১ বছরগুলোই এর প্রমাণ। যখনই গণতন্ত্রের ব্যতিক্রম হয়েছে, তখনই ফুঁসে উঠেছে মানুষ। বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং ১৯৯০-এর গণআন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থান একেকটি মাইলফলক। অবশেষে সবকিছুকে ছাপিয়ে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান গণতন্ত্রের জন্য গণআকাঙ্ক্ষার, গণঅভিপ্রায়ের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেকোনো ব্যাকরণে এটি একটি অনন্যসাধারণ ও অভূতপূর্ব ঘটনা। ভবিষ্যতের ইতিহাস এই অভ্যুত্থানকে সেভাবেই চিহ্নিত করবে। এ অভ্যুত্থানে জেন-জি নামে পরিচিত নতুন প্রজন্মের উত্থান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলাদেশের আর কোনো গণঅভ্যুত্থানে এতভাবে সর্বসাধারণের এত বিপুল ও ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটেনি। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনরূপে প্রতিভাত হয়নি। এটি হয়ে উঠেছে সব পেশার, সব ধরনের মানুষের মুক্তির আবাহন। সেই মুক্তি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এই মুক্তি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। আর এসবই হচ্ছে গণতন্ত্রের অঙ্গীকার। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শৃঙ্খলা, ঐক্য ও কৌশল গোটা জাতির জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে। শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের অবসানে যে স্বপ্ন দেখেছে, দেশের কোটি কোটি মানুষ একই স্বপ্নে বিভোর হয়েছে, ব্যাপৃত হয়েছে এবং সম্পৃক্ত হয়েছে। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন যাত্রার সূচনা হয়েছে। অনস্বীকার্যভাবে তা দ্বিতীয় স্বাধীনতা নামে অভিহিত হয়েছে। স্বাধীন মানচিত্রের অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গণস্বাধীনতার জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ দেশের মাটিতে যেসব আন্দোলন হয়েছে, তা থেকে এটি স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যে মহীয়ান। এই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়-বৈশিষ্ট্য, গতি-প্রকৃতি, রণকৌশল এবং স্বতঃস্ফূর্ততা অনন্য। যে বৈশিষ্ট্যটি এই গণঅভ্যুত্থানকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে, তা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ববর্জিত তরুণ প্রজন্মের তথা ‘জেন-জি’র অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের মাঠে-ঘাটে-বাটে এই গণঅভ্যুত্থান যে ব্যাপক গণঅভিপ্রায় সৃষ্টি করে, তার প্রমাণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী আন্দোলনের প্লাবন্য। প্রেস ক্লাব থেকে শাহবাগ, সচিবালয় থেকে যমুনা এবং রাজধানীর প্রতিটি অংশে এটি অনুভূত হয়। আজও এর রেশ অনুভূত হচ্ছে সর্বত্র। নতুন প্রজন্ম তথা ‘জেনারেশন-জি’র এই আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব জনগণের মনে যে আশা-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান এর মিলনমোহনা। অতীতের সব রাজনৈতিক আন্দোলন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তোলে। আওয়ামী শাসক-এলিটরা রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনের মোকাবিলা না করে নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের যে অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা প্রকারান্তরে তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সহিংসতা মোকাবিলায় নতুন প্রজন্ম, নতুন শব্দ, নতুন ঘোষণা ‘বাংলা ব্লকেড’, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এবং ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এর মতো কৌশল দিয়ে সরকারের নির্মমতাকে মোকাবিলা করে। কঠোরতা ও দমননীতি অবশেষে তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনগুলোর হামলা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে। প্রধানমন্ত্রীর কটূক্তি শিক্ষার্থীদের উত্যক্ত করে তোলে। কোনোকিছুই তাদের পরাজয় এবং পলায়ন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতি, ব্যাপ্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, সাংগঠনিক তৎপরতার সমন্বয় সাধন এবং সমান্তরালভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গণজাগরণকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব মূলত শিক্ষার্থীদের। এটি গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির যে গতি সৃষ্টি করে, তা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। ‘আন্দোলনটি সমাজের ব্যাপক অংশের দীর্ঘদিনের অসন্তোষের প্রকাশ ঘটায়, যা একটি নির্দিষ্ট সংস্কার থেকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বৃহত্তর সম্মিলিত আহ্বানে রূপান্তরিত হয়’। [আল মাসুদ হাসানউজ্জামান, ২০২৪: ১৫]। ছাত্র আন্দোলনে উঠে আসা বিষয়গুলো নাগরিক অধিকার, কর্মসংস্থানের সুযোগ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তোলে।

বস্তুত গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে আছে। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে গণতান্ত্রিক সংকট থেকে। সেদিন যদি পাকিস্তানি নির্বোধ শাসকরা ১৯৭০ সালের বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ন্যায্য ক্ষমতার আসন দিত, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আরো কিছুটা কালবিলম্ব হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যে বা যারা এই পাকিস্তানি দানবদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশটি অর্জন করল, তাদের মধ্যেই গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিল না। শেখ মুজিব পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু যখন নিজ হাতে কর্তৃত্বের অধিকার পেলেন, তখন গণতন্ত্রকে অস্বীকার করলেন। আমিত্বের মোহে তিনি অন্ধ ছিলেন। যে সংবিধান তিনি রচনা করালেন, নাগরিক অধিকারের অবারিত যে ঘোষণা সংবিধান দিল, স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট করে তিনিই তা অস্বীকার করলেন। সংবাদপত্রের যে স্বাধীনতার কথা বলা হলো, প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স করে তিনিই তা অস্বীকার করলেন। বাম নেতা সিরাজ শিকদারকে হত্যা করে জাতীয় সংসদে দম্ভোক্তি করলেন। বিরোধী নেতাদের দমনে নিজের ভাষায়ই ‘লাল ঘোড়া দাবড়ে’ দিলেন। অবশেষে বাকশাল কায়েম করে চিরতরে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করলেন। পরবর্তীতে নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনার মতো একজন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করলেন। এরশাদের সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র আরেকবার সামরিকতন্ত্রের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা ১৬ বছরের মতো সময়কালে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রে আবারও পরোক্ষ সামরিক শাসনে নিপতিত হয় দেশ। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করে। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করে। মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। সরকার পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্বাচনকে তারা কার্যত নির্বাসনে পাঠায়। ‘নির্বাচিত স্বৈরশাসকরা গণতন্ত্রের একটি বাহ্যিক আবরণ বহাল রাখে, কিন্তু তখনই তারা গণতন্ত্রের সারবস্তুর প্রাণবায়ু বেরে করে ফেলে’। [আলী রিয়াজ, ২০১৮:৪৮-৪৯]। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেপরোয়াভাবে দলীয়করণ করা হয়। সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভি-ডেমের ২০২৪ সালের সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে ‘নির্বাচনি স্বৈরশাসন’ কায়েম হয়েছে। ফ্রিডম হাউস ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৪’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একই ধরনের মন্তব্য করে। বার্টেলসম্যান ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘কঠোর কর্তৃত্ববাদী’ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের এই বিপর্যয় থেকে উত্তরণ আকাঙ্ক্ষা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়। গণতন্ত্র নির্মাণ ও সংহতকরণে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ, লালন ও প্রয়োগ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরকরণ জরুরি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ জুলাই-২৪ অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক বৈধতার সংকটে নিপতিত হয়েছে, তা অনুধাবনযোগ্য হয়ে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়াকে অধিকতর ফলপ্রসূ করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা অনুধাবন করে যে, উন্নয়নশীল সমাজের পটভূমিতে উন্নয়নতত্ত্ব, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, জনসেবা, মানবকল্যাণ, নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন জরুরি। দৃশ্যত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও দুর্দশার কবলে নিপতিত হয়েছে। এ দেশে রাষ্ট্রিক, সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো একরকম ভেঙে পড়েছে। সবাই অনুধাবন করেন যে, কেবল গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমেই এর পরিবর্তন সম্ভব। এখন দৃশ্যমান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক কর্মপদ্ধতি বিভিন্ন সমস্যায় নিপতিত হয়েছে। এগুলো বরং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল, অস্থির ও সংকটময় করে তুলেছে।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য যেসব মৌলিক সংকটের মোকাবিলা করছে, তার স্বরূপ এরকম :

ক) সংবিধান : দেশের সর্বোচ্চ বৈধ আইন হিসেবে সংবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। কী কী বিষয়ে সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন, তা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তথা সামাজিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা যায়। এসব সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ১৯৭২ সালের সংবিধান মোতাবেক দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার প্রয়োজনে এটি ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগকে প্রিভেন্টিভ-ডিটেনশনসহ জরুরি ক্ষমতা দিয়ে শক্তি বাড়ানো হয়। ফলে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এরপর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ‘বাকশাল’ ঘোষিত হয় এবং একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। ১৯৭৯ সালের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী অনুযায়ী খালেদা জিয়া দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিএনপি সরকার। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। এখন জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

খ) ক্ষমতার ভারসাম্য : সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয় First among equals অথবা Moon among the stars. সোজা কথায় সমমর্যাদাবানদের প্রথম হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারের মতো আচরণ করেন। কারণ, সাংবিধানিক ব্যবস্থায় ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। অনেকে মজা করে এই ব্যবস্থাকে বলেন, Presidential prime minister. নানাবিধ বিধি-ব্যবস্থার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতার ভারসাম্য বিধানের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনী আনয়ন করেছে।

গ) বিচার বিভাগের পৃথককরণ : বাংলাদেশের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথককরণের কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে বিষয়টি অবহেলিত ছিল। বর্তমান সরকার পৃথক সুপ্রিম কোর্ট মন্ত্রণালয় গঠনের মাধ্যমে পৃথককরণের বিষয় অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ, যথা- আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ পৃথককরণ হলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হবে।

ঘ) রাজনৈতিক দল : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও নির্বাচনি রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ আবশ্যক। রাজনৈতিক দলগুলোই রাজনীতিকে পরিচালনা করে; সরকার গঠন করে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য আছে; কিন্তু প্রায়ই গঠনমূলক ও সমঝোতার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বন্দ্ব, বিতর্ক, বিভেদ; এমনকি পারস্পরিক রক্তারক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে বিশেষ করে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর সংযম ও শৃঙ্খলা যখন বেশি প্রয়োজন, তখন তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে দলীয় এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নির্বাচনি পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। এখন যখন তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের কথা, তখন বিভেদ-বিদ্বেষ দুর্ভাগ্যজনক।

ঙ) আমলাতন্ত্র : নির্বাহী বিভাগের স্থায়ী অংশ হিসেবে সব দেশের মতো বাংলাদেশেও আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক সরকারগুলো আমলাতন্ত্রকে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে নির্মাণ করেনি। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরে হাসিনা সরকার আমলাতন্ত্রকে দলতন্ত্রে পরিণত করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে একরকম হিমশিম খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দলীয় ভূমিকা আশা করে। আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা নির্ণয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন।

চ) মাফিয়াচক্র : বাংলাদেশের বিগত সময়ের রাজনীতি একধরনের মাফিয়াচক্র বা সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। সমাজে দুর্বিত্তায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণÑএ দুই শব্দে তাদের পরিচয়। বিষয়টি অনেক সময় অদৃশ্য এবং অস্পষ্ট। বাংলাদেশের বর্তমান জনগণ এ ধরনের মাফিয়াচক্রের কবলে পড়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চক্রান্তে নিপতিত হয়েছে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরো চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছেÑনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন, রাজনৈতিক দলের অবিশ্বাস, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা, নির্বাচন-পরবর্তী আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনার পর যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ(১) নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার, (২) তত্ত্বাবধায়ক/অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মডেল, (৩) রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণবিধি, (৪) নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা, (৫) সংবিধান ও আইনি সংস্কার, (৬) গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, (৭) জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি, (৮) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব, (৯) অর্থনৈতিক নীতি ও উন্নয়ন, (১০) পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা। এই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জুলাই সনদ প্রণয়ন। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় প্রায়োগিক হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের মাধ্যমে সেই সনদ প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে। তা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলেছে। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল এই যে, দেশ একটি নিকৃষ্ট, কর্তৃত্ববাদী ও স্বেচ্ছাচারী সরকার থেকে মুক্ত হয়েছে। সে সঙ্গে রাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামোয় পরিবর্তন তথা সংস্কারের দাবি উচ্চকৃত হয়েছে। বস্তুত ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে নতুন কিছু আনার, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার এবং একটি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক রূপান্তরের উপায় হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এই রাজনৈতিক অভ্যুত্থান শুধু নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য নয়; বরং একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নবসম্ভাবনাময় সৃজনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রয়াস। এই অভ্যুত্থান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণতা নির্দেশ করে না। এর স্বার্থকতা একটি নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নির্মাণের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এটি শুধু একটি নিকৃষ্ট কর্তৃত্ববাদেরই অবসান ঘটায়নি; বরং বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। সেই কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের মধ্যেই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সফলতা নিহিত।

##

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন