কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের প্রতি ভারতের যে পুরোনো ভালোবাসা, এই উদাহরণ ছাড়া আর কিছু দিয়ে সেটা ভালোভাবে বোঝানো যাবে না। তিনজন বড় বড় বিশ্বনেতাকে একের পর এক স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি হয়েছে ভারত। ডিসেম্বরে আসবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটাই হবে তার প্রথম ভারত সফর। আগামী বছরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের। ভারত তখন ব্রিকস সম্মেলনের আয়োজন করবে। এদিকে, এ মাসেই ভারতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান আর অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কোয়াড সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা স্থগিত হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন যাচ্ছে ভারতের। আগামী বছর যদি এই সম্মেলন হয়, তাহলে হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ভারত সফর করবেন।
কিন্তু এই গল্পের আরেকটি দিক রয়েছে। অনেকেই এখন দেখছেন ভারত প্রত্যেকেরই কাছাকাছি থাকার, আবার একই সঙ্গে শীতল দূরত্ব বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করেছে। ট্রাম্প যখন ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করল, তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অনেক। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ভারতকে শাস্তি দিয়েছেন তিনি। অনেক দেশের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো বেশি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। অনেকেই আরো বেশি রাশিয়ার তেল কিনছে। কিন্তু তারা বড় অঙ্কের শুল্ক এড়াতে পেরেছে। বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের জন্য চীন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাপান আর তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মিত্র। এই ক্লাবে ভারতের জায়গা হয়নি। ভারতকে এখনো এমন দেশ হিসেবে দেখা হয় না, যাকে ছাড়া বিশ্ব চলতে পারবে না। বড় শিক্ষাটা তাই খুব সহজ। ভারতকে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। তাদের আরো গলার স্বর বাড়াতে হবে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য আরো সক্রিয় হতে হবে।
২০১৪ সালের পর থেকে ২০২৫ সালই ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্র নীতির জন্য সবচেয়ে কঠিন বছর। এপ্রিলে ভারতশাসিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা হলো। মে মাসে ভারত ও পাকিস্তান চার দিনের যুদ্ধে জড়াল। দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর মধ্যে বহু দশকের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ লড়াই।
এই স্বল্পকালীন যুদ্ধ ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ভালোই ক্ষতি করেছে। ট্রাম্প তখনই বলেছেন, তিনিই যুদ্ধ থামিয়েছেন। ভারত বলেছে, কথাটা সত্য না। পাকিস্তানও আনন্দের সঙ্গে ট্রাম্পের দাবিকে সমর্থন দিয়েছে। এরপর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো আচরণ শুরু করেছে আমেরিকা। হোয়াইট হাউস পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান আসিম মুনিরকে দুই দফা আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জুনে ট্রাম্প মোদির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। মোদি আর মুনিরকে একসঙ্গে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। মোদি না করেছেন। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত কখনোই বাইরের মধ্যস্থতাকারীকে মেনে নেয়নি। এরপর থেকেই দুই নেতা বহু মাস আর কথা বলেননি।
পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে। ছোট্ট একটা বাণিজ্য চুক্তির জন্য আগস্টের সময়সীমা মানতে পারেনি ভারত আর আমেরিকা। ট্রাম্প এরপর ভারতের ওপর সর্বোচ্চ হারে শুল্ক চাপিয়েছেন। ভারতকে তিনি ‘মৃত অর্থনীতি’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত আমেরিকার সঙ্গে সামান্যই ব্যবসা করে। তার বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর কথা ছিল আরো কঠোর। তিনি ভারতকে ‘ক্রেমলিনের লন্ড্রি’ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ ভারত রাশিয়ার তেল কিনছে আর পরিশোধিত জ্বালানি অন্যের কাছে বিক্রি করছে। দুই দেশের আস্থা এরপর দ্রুত পড়ে গেছে।
এখন দুই পক্ষই আবার নরম সুরে কথা বলছে। ভবিষ্যৎ বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথা চলছে। কিন্তু পুরোনো উত্তেজনাটা হারিয়ে গেছে। মার্কিন নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের আবার বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে বহু ভারতীয় খুবই খুশি ছিল। সেই মনোভাব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মোদি-ট্রাম্পের বিশেষ বন্ধুত্ব নিয়ে এখন আর কেউ কথা বলেনি। মোদি সবসময় বলে আসছেন, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু তার এই কথিত সম্পর্ক ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ হওয়া থেকে বা দেওয়া-নেওয়া স্টাইলের পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োগ ঠেকাতে পারেনি।
এ ঘটনাগুলো আরো গভীর সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ভারতের জন্য ভালো-খারাপ দুটোই এনেছে। এটা এক ধরনের স্বাধীনতা দেয়। ২০২০ সালে চীন যখন ভারতীয় সেনাদের ওপর হামলা করল, ভারত তখন দ্রুত আমেরিকার দ্বারস্থ হয়েছিল। কোয়াডের সঙ্গে আরো গভীরভাবে যুক্ত হয়েছিল ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছিল। নিজেদের বিকল্পগুলো খোলা রেখেছিল ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত বছর মিউনিখে বলেছেন, বিভিন্ন বিকল্প খোলা রাখার কারণে বিশ্বের উচিত ভারতকে ধন্যবাদ দেওয়া। ভারত কোনো একক পরাশক্তির সঙ্গে আটকে থাকেনি।
কিন্তু ২০২৫ সালে দেখা গেল এই ধারণাটা নিয়ে খুব বেশি অহংকারী হলে কী বিপদ হতে পারে। বড় শক্তিগুলো যখন লড়াইয়ে নামে, তখন ভারতকে অনেক সময় পক্ষ নিতে হয়। সেটাই ঘটেছে এ বছর। ইউক্রেন নিয়ে চুক্তিতে আসার জন্য রাশিয়াকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ট্রাম্প। তাই যেসব দেশ রাশিয়ার তেল কিনেছে, তাদের তিনি শাস্তি দিয়েছেন। ভারত সেখানে সুস্পষ্ট টার্গেট হয়ে গেছে। রাশিয়া আর আমেরিকার লড়াই যত তীব্র হবে, ওয়াশিংটন ততই মস্কোর সঙ্গে ভারতের পুরোনো বন্ধুত্বের দিকে নজর দেবে।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন শুরু হয়েছে অনেক আগে। ১৯৪৭ সালে মুক্ত হয়েছে ভারত। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অন্য কোনো দেশের জুনিয়র অংশীদার হওয়াকে ঘৃণা করতেন। তিনিই জোটনিরপেক্ষতা শুরু করেছিলেন। ভারত সবার সঙ্গেই কথা বলত। কিন্তু কোনো সামরিক ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয়নি তারা।
শুনতে এটা ভালোই শোনায়। কিন্তু সত্যিকারের সংকটের সময় এটা কাজ করে না। ১৯৬২ সালে চীন ভারতে হামলা করেছিল। সাহায্যের জন্য তখন আমেরিকার কাছে রীতিমতো ভিক্ষা চেয়েছিল ভারত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের আগে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্বের চুক্তি করেছিল। কারণ আমেরিকা আর চীন তখন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন বাজার খুঁজছিল ভারত। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নেই। তখন আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হয় ভারত। কিন্তু একই সঙ্গে অন্যসব জায়গাতেও বন্ধুত্ব ধরে রাখতে চেয়েছিল ভারত। বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন ফিরে এলো, তখনো এমনকি এই আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখতে চেয়েছিল ভারত।
এখন ভারতকে শুধু বন্ধুত্ব বজায় রাখার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে হবে। তাদের উপকারী হয়ে উঠতে হবে। এতটাই উপকারী হতে হবে, যাতে কোনো বড় শক্তিই তাদের সহজে আঘাত করতে না পারে। মোদি দক্ষিণ আফ্রিকায় জি২০ সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া আর কানাডার সঙ্গে ভারত নতুন প্রযুক্তি গ্রুপ শুরু করেছে। গ্লোবাল সাউথের পক্ষ হয়ে কথা বলতে চায় ভারত। আবার পশ্চিমেরও অন্যতম শীর্ষ অংশীদার হতে চায় তারা। ভারত নিজেকে বলে ‘বিশ্বমিত্র’। অর্থাৎ বিশ্বের তারা বন্ধু। বহু বন্ধু থাকা আর এই বন্ধুদের পরস্পরের মধ্যে কথা বলানো—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ভারত রাশিয়া আর আমেরিকার বন্ধু। ভারত ইরান আর ইসরাইলেরও বন্ধু। কিন্তু ইউক্রেন বা পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ প্রশমনে ভারত খুব সামান্যই করতে পেরেছে। ভারতের চেয়ে বরং কাতার, তুরস্ক, ব্রাজিল আর চীন অনেক জোরালো চেষ্টা চালিয়েছে।
ভারত যখন এখনকার তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল ছিল, তখন বরং তারা মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছিল। ১৯৫০-এর দশকে ভারত কোরিয়া ইস্যুতে, তাইওয়ান সংকটে এবং আরো অনেক জায়গায় কথা বলেছিল।
এ বছর ভারত মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। অক্টোবরে দুটো বড় বৈঠক হয়েছে। একটি হলো মিসরে অনুষ্ঠিত গাজা শান্তি সম্মেলন। অন্যটি হলো মালয়েশিয়ায় পূর্ব এশিয়া সম্মেলন। দুটো জায়গাই ভারতের বর্ধিত প্রতিবেশের মধ্যে পড়ে। দুই জায়গাতেই আমন্ত্রণও পেয়েছিল ভারত। কিন্তু কোনোটাতেই যাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এমনকি ভারতের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানও এখন অনেক সক্রিয়। পাকিস্তান একই সময়ে চীন, আমেরিকা, রাশিয়া, ইরান এবং উপসাগরীয় রাজাদের সঙ্গে কথা বলছে। পাকিস্তান ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকা আর চীনকে আলোচনায় সাহায্য করেছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তান। আজ তারা সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। চীন ও আমেরিকা উভয়কেই ঘাঁটির প্রস্তাব দিয়েছে। এটা ঠিক যে, পাকিস্তানের নীতির মধ্যে অনেক বৈপরীত্য আছে। এটাও হয়তো সত্য, তারা দেশ হিসেবে দরিদ্র ও অস্থিতিশীল। কিন্তু তারপরও পাকিস্তান খেলায় সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর ভারত বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।
ভারতকে অবশ্যই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের অর্থ বদলাতে হবে। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলব কিন্তু নিজে নিরাপদে থাকব—এই অর্থে আর চলবে না। এখন অর্থ হতে হবে—‘আমরা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রত্যেকেরই আমাদের প্রয়োজন পড়বে’। এই বছরে বোঝা গেছে, ভারত আমেরিকার ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হিসেবে আগে যে ধারণা ছিল, সেই ধারণাটা কয়েক মাসের মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেছে। ট্রাম্পের আমেরিকা জলবায়ু আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেছে। জি২০ চেতনা ত্যাগ করেছে। বহু বৈশ্বিক দায়দায়িত্ব তারা ঝেড়ে ফেলেছে। বিশ্বের শীর্ষ জায়গাটা এখন শূন্য পড়ে আছে।
এটাই ভারতের মুহূর্ত। ভারত যদি সামনে এগিয়ে আসে, তারা যদি যুদ্ধ থামাতে সাহায্য করে, তারা যদি নতুন সরবরাহ চেইন গড়তে পারে, তারা যদি সুস্পষ্ট ও সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলতে পারে, তাহলে কেউই ভারতের সঙ্গে আর দশটা বাণিজ্য অংশীদারের মতো আচরণ করার সাহস করবে না, যাদের ওপর চাইলেই শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যায়।
ভারতের পুরোনো নীরব স্বায়ত্তশাসন অনেকটাই অর্থহীন হতে চলেছে। বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। ২০২৫ সালে ভারত ধাক্কা খেয়ে শিখেছে, প্রত্যেকটি দরজা খোলা রাখাটাই যথেষ্ট নয়। কাউকে না কাউকে সেই দরজা দিয়ে ঢুকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
ফরেন পলিসি অবলম্বনে জুলফিকার হায়দার


জুলাই সনদের নোট অব ডিসেন্টের ভবিষ্যৎ কী
খালেদা জিয়ার প্রতীক্ষায় জাপানের চেরি ফুল
প্রবল ঝড়ে বিধ্বস্ত এশিয়ার চার দেশ