Ad T1

কাছের মানুষ, দূরের মানুষ

শফিক রেহমান
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯: ৫৬

কাছের মানুষ

সময়টা ছিল ২০১৬-এর জুনের মাঝামাঝি।

তখন রমজান শুরু হয়ে গিয়েছিল।

আদালতে আপিলের পর আমি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভেতরে উচু পাচিল দিয়ে ঘেরা আরেকটি জেলে স্থানান্তরিত হয়েছিলাম। সেন্ট্রাল জেলের মেডিকেল ওয়ার্ড থেকে ডিভিশন পাওয়া বন্দিদের জন্য এই মিনি জেলের নাম ছিল চম্পাকলি। এখান থেকে বের হওয়ার একটি দরজায় সব সময় অন্তত একজন প্রহরী থাকত।

এরই মধ্যে জানলাম গোটা জেলের সুয়ারেজ বা নর্দমাপ্রণালী আর রান্না-খাওয়া ও গোসলের পানির লাইন মাটির নিচে বিভিন্ন স্থানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে সব বন্দিকে কেরানিঞ্জে নতুন বানানো জেলে অথবা কাশিমপুরের চারটি জেলে (একটি নারী ও অপর তিনটি পুরুষ বন্দিদের জন্য) দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

আমাকে কাশিমপুর জেলে পাঠানো হয়। এর আগে আমি ছিলাম কাশিমপুর জেলের সলিটারি কনফাইনমেন্ট বা নির্জন কারাবাসে। এবার আমাকে বদলি করা হলো কাশিমপুর জেলে ডিভিশনপ্রাপ্ত ভবনে, যার নাম ‘সুরমা’। আমাকে নেওয়া হলো সুরমার দোতলায় একটি বড় ঘরে, যেখানে আট বন্দি থাকতে পারতেন। কিন্তু দেখলাম সেখানে আছেন মাত্র একজন, যার নাম ছিল শফিউদ্দিন (সম্ভবত)। তিনি কাজ করতেন একটি ব্যাংকের উচু পদে। আওয়ামী সরকারের ব্যাংক লুটের কারসাজিতে তাকে অন্যতম অপরাধী করে সেখানে রাখা হয়েছিল। মধ্যবয়সি এই বন্দি ব্যাংকার আনন্দিত হলেন আমাকে দেখে। ভাবলেন, যাক একজন সঙ্গী পাওয়া যাবে কথা বলার জন্য।

আমি সেই ঘরে যখন কিভাবে গুছিয়ে থাকব ভাবছি, তখন হঠাৎ এসে হাজির হলেন মাহমুদুর রহমান (এখন থেকে তাকে মাহমুদ বলেই লিখব)। তিনি সেখানে এসে বললেন, ‘এখানে কেন আপনি থাকবেন? আপনি এখানে গোছগাছ করবেন না। আপনি থাকবেন তেতলায় আমার পাশের রুমে। এখনই চলুন আমার সঙ্গে ওপরে।’

ঘরের বাইরের বারান্দায় উপস্থিত থাকা জেলপুলিশদের আদেশের স্বরে বললেন, ‘তার সব বই, লাগেজ আর পানির বোতলগুলো ওপরের তলায় আমার পাশের ঘরে নিয়ে দেন। জেলসুপারকে আপনাদের বলতে হবে না। আমিই তাকে বলে দেব।’

বুঝলাম কাশিমপুরে মাহমুদের প্রতিপত্তি আছে। তাই কমান্ড করতে পারলেন জেলসুপারের অনুমতি চাওয়ার আগেই। দেখলাম কিছুটা সভয়ে জেলপুলিশগুলো আদেশ মেনে আমার লাগেজ, বই ও পানির বোতলগুলো ওপরের তলায় নেওয়া শুরু করল। শফিউদ্দিনকে গুডবাই বলে আমি ওপরের তলায় গেলাম। দেখলাম তিনতলায় মাহমুদের বড় রুম, যেখানে ঠিক মাঝখানে রাখা তার সিঙ্গল বেড। একদিকের দেয়ালে, তারই খরচে বানানো শেলফে বহু বই, যার বেশিরভাগই হচ্ছে কৃমিনাল আইনের ওপর। জানালার পাশে তার চেয়ার ও টেবিল। আরেক দেয়ালের পাশে তারই খরচে বানানো আলনা, সেখানে পরিপাটিভাবে ঝুলছে তার সব জামাকাপড়। জেলখানায় কোনো আলমারি না থাকায় মাহমুদ স্বপ্রণোদিত হয়ে আলনার ব্যবস্থা করেছিলেন। আরেক দিকের দেয়ালে ঝোলানো অনেকগুলো কলা।

আমি সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকায় মাহমুদ বললেন, ‘জেলেও একটা দোকানে কলা কেনা যায়, কিন্তু আমি সেসব কিনি না। প্রতি সপ্তাহে আমার স্ত্রী পারভীন যখন আমাকে দেখতে আসে, তখন সে কলার ছড়াও নিয়ে আসে। আর নিয়ে আসে লনডৃতে ধোয়া ও ইস্ত্রি করা আমার সব পোশাক।’ আলনার দিকে দেখিয়ে তিনি বললেন। মাহমুদ সবসময়ই ফিটফাট থাকতে ভালোবাসেন।

আমার মনে পড়ল সাজানো মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে (সা কা নামেও পরিচিত)। যখন তিনি রিমান্ড ও জেলে ছিলেন, তখন তিনি জেলের খাওয়া খেতেন না। ফজলুর রহমান নামে জনৈক পুলিশ অফিসার (তিনি আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলার বাদী) আমাকে বলেছিলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ডিবি অফিসে রিমান্ডে থাকার সময়ে প্রথম দুদিন শুধু পেয়ারা খেয়ে থেকেছেন। কারণ তিনি হয়তো ভয় করতেন কয়েদিদের খাবারের মধ্যে স্লো পয়জনিং বা বিষাক্ত পদার্থ প্রয়োগে অপমৃত্যুর ব্যবস্থা করা হতে পারে। সাকা চৌধুরীর মৃত্যু অবশ্য স্লো পয়জনিংয়ে করা হয়নি। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ফাসিতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল।

পরবর্তীকালে শুনেছি ম্যাডাম খালেদা জিয়াও জেলে স্লো পয়জনিং বিষয়ে সতর্ক থাকলেও তার কিডনি ও লিভারে অসুস্থতা দেখা দেয় এবং সেই অসুখ তার এখনো আছে। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী, যিনি এখন ‘খুনি হাসিনা’ নামেই সুপরিচিত ও চিরপরিচিত থাকবেন, তিনি এই বিষয়ে কটাক্ষ করেছিলেন।

যেহেতু আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী, সেহেতু আমি বারবার প্রকাশ্যে বলেছি, খুনি হাসিনার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত নয়। তাকে বেঁচে থাকতে দিতে হবে। তবে তার একটি শাস্তি হতে হবে গু-মূত মেশানো সুয়ারেজের পানির সঙ্গে খাবার পানি মিশিয়ে খেতে দেওয়া। ধারণা করি, দুর্গন্ধেই সেই পানি তিনি খাবেন না। তখন তাকে বিশুদ্ধ পানি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তিনি হয়তো বুঝবেন বহু বন্দি কেন জেলের পানি বা খাবার খেতে ভীত থাকেন।

আমি নিজে খেতাম, আমার বাড়ি থেকে আনা দেশি মিনারাল ওয়াটার। আর আমার সহবন্দি বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী খেতেন বিদেশি মিনারাল ওয়ারটার এভিয়া (Evian), যেটা বোতলজাত হয় ফ্রান্সে আল্পস পাহাড়ের বরফ থেকে। যেহেতু এরশাদ (খুনি হাসিনার লং ড্রাইভের বন্ধু) আমলে রিজভী পায়ে এবং পেটে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তাই খাবার পানির বিশুদ্ধতা বিষয়ে ডাক্তারের উপদেশে তাকে এভিয়া খেতে হতো। শুধু খাওয়াই নয়, তিনি যে কাটাচামচ-প্লেট-গ্লাস-পেয়ালায় খেতেন, সেসবই এভিয়া দিয়ে আগে ধুয়ে নিতেন। এতে তার খরচ হতো অনেক।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, তেতলায় এই জেলে আমাদের খাবারের একটি মেস চালাতেন মাহমুদ। সেখানে আমি, মাহমুদ, রিজভী ও শফিউদ্দিন খেতাম। তবে আমার খাবার বেশিরভাগই নিয়ে আসত আমার স্ত্রী তালেয়া তার সাপ্তাহিক ভিজিটে। বাকিটুকু খাওয়া আমি সারতাম বিভিন্ন ফল খেয়ে। মাহমুদ গোছানো, পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন মানুষ। তাই তিনি জেলারের অনুমতি নিয়ে একটি ফ্রিজার এনেছিলেন তেতলায়। সেখানেই থাকত মাহমুদের ভিজিটরদের আনা মাছ-মাংস প্রভৃতি। আর তালেয়া আমাকে এনে দিয়েছিল একটি ফ্রিজ, যেখানে আমার সাপ্তাহিক খাবারগুলো থাকত। এই বিষয়ে সহযোগিতার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি তদানীন্তন জেলসুপার মি. প্রশান্তকে (সম্ভবত)।

তবে এসব ঘটনা থেকে একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, জেলে বন্দিরা বিশ্বাস করেন না জেল কর্তৃপক্ষকে। এই অবিশ্বাসের মূল কারণ খুনি হাসিনা। তিনি দিনকে রাত বলতে পারেন—রাতকে দিন বলতে পারেন অবলীলাক্রমে। আমি ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সতর্ক করে দিচ্ছি। খুনি হাসিনা যদি আপনার অতি সান্নিধ্যে গিয়ে বলেন, ‘আই লাভ ইউ’, তখনো তাকে বিশ্বাস করবেন না। বস্তুত, শেখ পরিবারের কেউ কাউকেই বিশ্বাস করে না। তাই খুনি হাসিনা থাকতেন ঢাকায়, একমাত্র বোন রেহানা লন্ডনে, একমাত্র ছেলে জয় (কুকুরকামী) ওয়াশিংটনে, একমাত্র মেয়ে দিল্লিতে। একমাত্র জামাই মিতু শারজাহতে গৃহবন্দি। এরা পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত নয়। এরা সামাজিক মানুষ নয়। এরা এক বিশেষ ধরনের দু-পেয়ে পশু মাত্র। মাহমুদ তার রুমে আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে বললেন, বলতে পারেন এটাই আমার বেড রুম, স্টাডি রুম এবং লিভিং রুম।

দেখলাম আরও তিন-চারটি চেয়ার সেখানে আছে। বুঝলাম জেলসুপার ও তার সহকারী এবং অন্য দু-একজন বন্দি হয়তো সেখানে এসে তার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন। মাহমুদের বিছানার চার কোনায় ছিল চারটি পেরেক। সেখানে জানালার শিক থেকে ঝোলানো হতো মশারির চার দড়ি। বারান্দা থেকে সেখানে মাহমুদের ঘরেই এসে মশারির দড়ির ওপর বসা শুরু করলো সাতটি একই রকমের ছোট পাখি।

‘ওদের বলা হয় সাত ভায়রা পাখি’, তিনি বললেন।

‘কেন?’

‘জানি না। ওরা একসঙ্গেই থাকে, আকাশে ওড়ে।’

‘আপনি কি ওদের বৌদের কখনো দেখেছেন?’

‘না। দেখিনি।’

‘আশ্চর্য! আমি এর আগে কখনোই দেখিনি সাত-সাতটি পাখিকে একসঙ্গে আসতে এবং ঘরের মধ্যে দড়িতে বসতে।’

‘হ্যা। আমিও দেখিনি।’

‘ওরা মুক্ত। এতই মুক্ত যে ঘরকেও ওরা বন্দিঘর মনে করে না। আর আমরা বন্দি থাকি—ঘরে ও বাইরে, বিশেষত খুনি হাসিনার কুশাসনে। ওই সাত ভায়রা আমাদের চেয়ে কতো বেশি ভাগ্যবান’, বললাম।

একটু পরেই সাত ভায়রা উড়ে চলে গেল কোথায় কে জানে?

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় মাহমুদ আয়োজিত ডাইনিং টেবিলে আমরা চারজন খেলাম। আমি দুটি বড় আম খেয়েছিলাম। আর কিছু নয়? কিন্তু মাহমুদ ভোজনবিলাসী। তার মা’র হাতের রান্না আমি একাধিকবার খেয়েছি তাদের ফ্ল্যাটে। তখনই বুঝেছিলাম মাহমুদের ভ্রমণপ্রিয়তার বিষয়টি।

মাহমুদের এত বই দেখে জানতে চেয়েছিলাম তিনি এত পড়ার সময় পেলেন কিভাবে?

তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘আপনারা অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন, সংসার শুরু করেছিলেন, তাই হয়তো পড়ার সময় পাননি। আমি মধ্য ত্রিশে বিয়ে করেছিলাম। পরীক্ষায় পাসের পর থেকে আমি অন্তত দশ-বারো বছর সময় পেয়েছিলাম বই পড়তে।’

‘আপনার এখানে শেলফে সবচেয়ে বেশি কৃমিনাল (ফৌজদারি) আইনের বই। এর কারণ?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘কারণ আর কিছুই নয়। কারণ আমার বিরুদ্ধে যেসব ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে, সেসবের বিরুদ্ধে আমিই লড়ছি, কোনো উকিল নিয়োগ করিনি। আমি যেসব উকিলের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাতে বুঝেছি তারা কম বই পড়েন। অথচ ওকালতিতে অবিরাম বই পড়তেই হবে যদি জানতে চান যে অপরাধে আপনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেই ধরনের মামলায় বিদেশে কি শুনানি ও রায় হয়েছিল? অর্থাৎ এই ধরনের মামলার পৃসিডেন্সগুলো (Precedence) । আমি তাই বিদেশের মামলার বিবরণগুলো খুটিয়ে পড়ি, লাল-নীল-সবুজ পেজ মার্ক করি এবং সংশ্লিষ্ট বইগুলো আদালতে নিয়ে যাই। তার আগেই আমি আমার বক্তব্য বুকলেট (ছোট বই) আকারে ছাপিয়ে নিই এবং আদালতে শুনানির সময়ে আমার সমর্থকরা সেসব উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করে দেন। এর ফলে কোনো পত্রিকায়ই আমার বক্তব্য বিকৃতভাবে ছাপাতে পারে না। ওদের জন্য আমি একটা মহা প্রবলেম!’ হাসিভরা মুখে মাহমুদ বললেন।

“আপনি মহাপ্রবলেম নন। ওদের কারো কারো ভাষায় আপনি ‘বাইচান্স সম্পাদক’। ওরা এখন জানছে আপনি শুধু বুয়েটে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ারই শুধু নন, আপনি সিরামিক শিল্প বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী এবং এখন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ফৌজদারি আইন বিশারদ। ওরা জানে আপনি ইচ্ছা করলেই পত্রিকা সম্পাদনার ঝুকিপূর্ণ কাজ ছেড়ে সিরামিক শিল্পে ফিরে যেতে পারবেন, অথবা আদালতে আইন পেশা শুরু করতে পারবেন। ফ্যাক্ট ইজ, বাংলাদেশের অধিকাংশ সম্পাদক ও সাংবাদিকদের এই মোবিলিটি অফ এমপ্লয়মেন্ট নেই। তাই তারা অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হন বিবেকের বিরুদ্ধে দালালি করতে। যেমন ধরুন, একজন কমিউনিস্ট নেতা হতে পারেন একজন ক্যাপিটালিস্টের দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এবং এত বড় অনৈতিকতার পরে প্রচার করতে পারেন নৈতিকতা, আদর্শ, দেশপ্রেম ইত্যাদি। এসবই ভণ্ডামি। তাই আপনার নতুন পর্যায়ে প্রকাশিতব্য দৈনিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকা ভবিষ্যত প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য নতুন পথের দিকনির্দেশনা দেবে বলে আমি আশা করি। আমি বিশ্বাস করি আপনি তাদের বলবেন, একাধিক গুণে গুণী হবার জন্য। আমার দেশের ‘দালালি’ (সাংবাদিকের বিবেচনায়) না করে অন্য পত্রিকায় অথবা অন্য পেশায় যাবার যোগ্যতাও যেন তারা অর্জন করে।”

এরপর প্রসঙ্গ পালটিয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি এত বই নিয়ে যান কি করে?’

প্রশ্নটি করলাম এই জন্য যে, প্রিজন ভ্যান বা জেলের গাড়ি আপনারা দেখেন, তখন লক্ষ্য করবেন ওই ভ্যানের মধ্যে বসার উপযুক্ত স্থান নেই। বরং ঠিক মাঝখানে থাকে স্পেয়ার চাকাসমূহ। ফলে বন্দিরা ভ্যানের ছাদের নিচে ছোট জানালার শিক ধরে থাকতে বাধ্য হন।

মাহমুদ সেটা করতেন না। তিনি নিজেই নির্দেশ দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলেন একটি ভারী চেয়ার। যেদিন তাকে শুনানির জন্য আদালতে যেতে হতো, সেদিন ভোরে তার সেই চেয়ার প্রিজন ভ্যানে জেলপুলিশরা রেখে দিত। আর মাহমুদ অনেকগুলো বই হাতে ভ্যানে উঠতেন। মাহমুদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আমি বহুভাবে কাছে থেকে দেখেছি কাশিমপুরে সুরমা জেলে।

যেমন তিনি সুনির্দিষ্ট সময়ে খেতেন, দুপুরে সহবন্দিদের সঙ্গে কনট্রাক্ট বৃজ খেলতেন, প্রতি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়াতেন, যেখানে জেলের বহু বন্দি নিজেদের জায়নামাজ নিয়ে এসে হাজির হতেন ইত্যাদি।

তবে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে যখন আওয়ামী নেতা (বর্তমানে প্রয়াত) মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জামাই লে. কর্নেল তারেক সাঈদ ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে সুরমায় বদলি হয়ে এলেন (দোতলায়), সেই সন্ধ্যা থেকে মাহমুদ আর এখানে নামাজও পড়াননি এবং খেতেও বসেননি। কারণ নারায়ণগঞ্জ সেভেন মার্ডার-এ (সাত খুন) লে. কর্নেল তারেক সাঈদ অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দি ছিলেন। চম্পাকলিতে তার সঙ্গে কয়েকবার আমার আলাপচারিতা হয়েছিল। এখানে বলা উচিত, নারায়ণগঞ্জে সাতটি খুন হয়—সেই ঘটনায় এগারজন খুন হয়েছিল। যে দুই মাঝি খুনি সেনা-পুলিশদের নিয়ে গিয়েছিল সাত ব্যক্তিকে হত্যার হুকুম কার্যকরের জন্য, সেই দুই মাঝি এবং সেই ভোর সকালে মাছ ধরারত দুজন জেলেকেও হত্যা করা হয়েছিল যেন সেভেন মার্ডারের কোনো সাক্ষী না থাকে। সুতরাং নারায়ণগঞ্জ সেভেন মার্ডারকে বলা উচিত নারায়ণগঞ্জের ইলেভেন মার্ডার (এগারজন)। আমি কর্নেল তারেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কোন ব্যক্তির হুকুমে ওই হত্যাগুলো করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ওপরের নির্দেশে এবং তার নাম বলা যাবে না।

হয়তো তখন লে. কর্নেল তারেক সাঈদ আশা করেছিলেন, শ্বশুর ও খুনি হাসিনার হস্তক্ষেপে তিনি জেলমুক্ত হয়ে যাবেন। তা আর এখন হলো না। সুরমায় মাহমুদকে তখন প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন, এই খুনির সঙ্গে আমি কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে চাই না।

কাশিমপুরে মাহমুদ আরেকটি কাজ করতেন। সেটা হলো জেলপুলিশ ও জেলবন্দিদের মধ্যে সালিশি করা। অর্থাৎ বন্দি অবস্থাতে মাহমুদ ছিলেন এক ধরনের বিচারক।

কাশিমপুর জেলের ভেতরে ঢুকলেই দেখবেন বড় বড় সাইনবোর্ডে স্টেইনলেস স্টিলের অক্ষরে লেখা আছে, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’।

আসলে ওই সাইনবোর্ডটি হওয়া উচিত ‘তোমাদের রাখিব বিপদে, আমরা যাবো টাকার পথে’।

সাধারণ পুলিশ বাহিনীর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ জেলপুলিশরা। কারণটা আমি জানতে চেয়েছিলাম জেলপুলিশদের কাছে। তাদের উত্তর ছিল, ‘বাইরের পুলিশরা তো সবার কাছ থেকেই টাকা আদায় করতে পারে। আমরা তো জেলে থেকে সেটা পারি না। সুতরাং জেলবন্দিরাই আমাদের একমাত্র ভরসা।’

এই টাকা তারা উপার্জন করতো জেলবন্দিদের জামিনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে। জেলবন্দিরা তাদের আত্মীয়স্বজনের মারফতে জেলপুলিশদের নির্বাচিত ব্যক্তিদের টাকা দিলেও জামিন হতো না। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে তারা মাহমুদের কাছে সালিশির জন্য যেত। সংশ্লিষ্ট পুলিশদের ডেকে মাহমুদ বিচার করতেন এবং জেলবন্দিদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতেন। মাহমুদের এই সুখ্যাতি অন্যান্য জেলবন্দির কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল এবং কাশিমপুরে থেকেই তিনি এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতেন।

মাহমুদের গভীর প্রভাব, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং ধর্মপরায়ণতার সঙ্গে যোগ করতে হবে তার সংগীত ও মুভিপ্রিয়তা। তিনি বহু বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মুভি দেখেছেন। ঘুমানোর আগে তিনি ইয়ারফোনে বিভিন্ন ধরনের গান শুনতেন।

আক্ষরিকভাবেই মাহমুদ আমার কাছের মানুষ ছিলেন। তার পাশের রুমটিই ছিল আমার রুম। রোজ বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতাম। একদিন তাকে বলেছিলাম, ‘আপনাকে মানুষ ইসলামপন্থী ও ভারতবিরোধী রূপেই চেনে। কিন্তু সেটা আপনার সামগ্রিক চরিত্রের অর্ধেক; বাকি অর্ধেক হলো আপনার বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষত আইন বিষয়ে জ্ঞান। এটা আপনার জানানো উচিত।’

মাহমুদ শুধু হেসেছিলেন।

দূরের মানুষ

মাহমুদের খুব কাছে থাকলেও বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে আমার মতভিন্নতা আছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দূরত্ব অনেক বেশি। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে সেসব বিষয়ে আজ ‘দৈনিক আমার দেশ’-এর শুভ নতুন যাত্রার সময়ে আলোচনা করছি না।

তিনি আমার কাছের মানুষই হোক এবং দূরের মানুষই হোক—তিনি আমার একজন প্রিয় মানুষ। তাছাড়া খুনি হাসিনা এটা বুঝেই হয়তো একটি বিশেষ মালার বাধনে আমাদের বেধে দিয়েছেন। আমাদের দুজনকেই তার কুকুরকামী পুত্র জয় অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা মামলার অপরাধী সাব্যস্ত করে দুজনকেই সাত বছরের সশ্রম জেলদণ্ড দিয়েছিলেন। মজার কথা এই যে, ওই বানোয়াট মামলার ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময়ে মাহমুদ জেলে ছিলেন (তিনি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর জেলে থেকেছেন) এবং আমি ঢাকায় ছিলাম। কাশিমপুর ও ঢাকা থেকে কুকুরকামী জয়ের বাসস্থান ওয়াশিংটনের দূরত্ব ৮০২৮ এয়ারমাইল!

এত দূরে থেকেও আমরা যদি ওই ধরনের অপরাধমূলক অপচেষ্টা করতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে খুনি হাসিনা আমাদের দুজনকে কত শক্তিমান মনে করেন।

হ্যা। আমরা শক্তিমান। আর তাই এখন তিনি আছেন ইন্ডিয়াতে, দিল্লিতে—আমরা দুজনই আছি মুক্ত বাংলাদেশে ঢাকায়।

খুনি হাসিনা যদি প্রমাণ করতে পারেন তিনি আমাদের চাইতে বেশি শক্তিমান, তাহলে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে ‘আই লাভ ইউ’ শব্দ তিনটি উচ্চারণ করে দেখতে পারেন তার কামনা-বাসনা বিছানা পর্যন্ত গড়ায় কি না। তাহলেই তিনি পাবেন তার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে এবং হয়তোবা ফিরেও আসতে পারেন বর্তমানে অতিদূরের দেশ বাংলাদেশে। প্রসঙ্গত, ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি সেইসব ছাত্রছাত্রী আন্দোলনকারীকে, যারা স্লোগান দিয়েছিলেন—‘হাসিনার ঠিকানা মোদির বিছানা’।

সবশেষে কামনা করছি ‘আমার দেশ’ পত্রিকার দ্রুত সাফল্য এবং এই পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদসহ সব কর্মীর জন্য রইল আমার লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।

২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকা।

Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত