মন্তব্য প্রতিবেদন

মাহমুদুর রহমান

আমেরিকায় রীতিমতো রাজনৈতিক ভূমিকম্প সৃষ্টি করে জোহরান মামদানি যে কদিন আগে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, সেটি সব পাঠকই জানেন। কিন্তু তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার, রাজনীতিতে প্রবেশ, ইত্যাদি সম্পর্কে সবার হয়তো পুরো ধারণা নাও থাকতে পারে। আমি তাই অতি সংক্ষেপে সেই তথ্যগুলো দিয়ে তারপর আজকের আসল আলোচনায় যাচ্ছি।
জোহরান মামদানি ১৯৯১ সালে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় জন্মেছিলেন। তার বাবা ও মায়ের নাম যথাক্রমে মাহমুদ মামদানি এবং মীরা নায়ার। জোহরান এই দম্পতির একমাত্র সন্তান। মাহমুদ মামদানি ভারতের গুজরাটের শিয়া মুসলমান বংশোদ্ভূত হলেও তার বাবা অর্থাৎ জোহরান মামদানির দাদা আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ায় বসতি গেড়েছিলেন। পরে তারা সেখান থেকে উগান্ডায় চলে যান। মাহমুদ মামদানি একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি। অসম্ভব মেধাবী মাহমুদ মামদানি স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসেন। তিনি বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। হার্ভার্ডে পিএইচডি সমাপ্ত করার পর মাহমুদ মামদানি উগান্ডায় শিক্ষকতা জীবন শুরু করে ১৯৯৯ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য এক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়ায় অধ্যাপক হন এবং এখন পর্যন্ত সেখানেই অধ্যাপনা করছেন। জোহরানের মা মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনির্মাতা। মীরা ভারতের পাঞ্জাবের এক হিন্দু পরিবারের মেয়ে। তার বাবা অমৃতলাল নায়ার ভারতীয় উচ্চপদস্থ আইসিএস অফিসার ছিলেন। দিল্লিতে লেখাপড়া শুরু করে মীরা নায়ার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। তিনি ২০১২ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ পেয়েছেন। মীরা ও মাহমুদের সন্তান জোহরান মামদানি এ বছরই সিরিয়ার মুসলমান পরিবারের মেয়ে রামা দুয়াজিকে বিয়ে করেছেন। রামা দুয়াজি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিতে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। গাজার গণহত্যার ওপর তার অনেক চিত্রকর্ম রয়েছে।
জোহরান মামদানির বাবা ১৯৯৯ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি নিলে সাত বছরের বালক জোহরান উগান্ডা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ২০১৪ সালে তিনি নিউ ইয়র্কের বাউডেন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই জোহরান লেখালেখি করতেন এবং সংগীত তার নেশা ছিল। মায়ের সিনেমাতেও তিনি সংগীতের কাজ করেছেন। রাজনীতিতেও তার হাতেখড়ি ছাত্র অবস্থাতেই হয়েছিল। ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি তিনি ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনে আলি নাজমি নামের এক কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর জন্য প্রচার চালিয়েছিলেন। আলি নাজমি সেই নির্বাচনে হেরে গেলেও এখনো দুজনার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। আলি নাজমিকে জোহরান তার ভাই বলে সম্বোধন করেন। ২০১৫-পরবর্তী সময়ে মামদানি ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের পক্ষে বিভিন্ন অ্যাকটিভিজমে ব্যস্ত থেকেছেন। ২০২০ সালে জোহরান সর্বপ্রথম নিউ ইয়র্কের ৩৬ নম্বর স্টেট অ্যাসেম্বলি কুইন্সের সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে তিনি নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে কেউ সেটিকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। সবাই ধারণা করেছিলেন, চূড়ান্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তো দূরের কথা, জোহরান মামদানি তার দলের নমিনেশনই পাবেন না। রাজনীতির সাধারণ বিবেচনায় মামদানির অনেকগুলো অসুবিধা ছিল।
প্রথমত তিনি শুধু মুসলমান বাবারই সন্তান নন, উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসলামোফোবিক সমাজে বসবাস করেও ইসলাম ধর্ম নিয়ে মামদানি কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা বোধ করেননি। উল্টো তিনি বেশ গর্বের সঙ্গে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত নিউ ইয়র্কের জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও, মামদানি ফিলিস্তিন ইস্যুতে সব সময় অবিচলভাবে ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন। ভোটের জন্য তিনি ধর্ম নিয়ে কখনো কোনো ধরনের চালাকি অথবা ভণ্ডামির আশ্রয় নেননি। মামদানি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি আইসিসির ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, ইসরাইলের গণহত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্কে এলে তাকে গ্রেপ্তার করবেন। তৃতীয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটি তার কিংবা তার পরিবারের ছিল না। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে একটি এককক্ষের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। চতুর্থত যেই ধনকুবেররা সাধারণত প্রার্থীদের বিপুল অঙ্কের চাঁদা দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন, মামদানির নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো সরাসরি সেই ধনকুবেরদের স্বার্থবিরোধী ছিল। সুতরাং তারা মামদানিকে পরাজিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। পঞ্চমত মামদানির ফিলিস্তিনপন্থি নীতির কারণে তার নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রভাবশালী জায়নিস্ট অংশ তার বিরোধিতা করেছে। ষষ্ঠত কট্টর ইহুদি সমর্থক, ক্যাপিটালিস্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মামদানিকে পরাজিত করার জন্য নিজে মাঠে নেমেছিলেন। অতীতে ট্রাম্পের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট এভাবে স্থানীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি এবং সপ্তমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া প্রধানত জায়োনিস্ট-নিয়ন্ত্রিত হওয়ায়, মামদানিকে তথাকথিত ‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া’র ভয়ানক বৈরী প্রচারণাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
এতখানি বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তাহলে জোহরান মামদানি কোন জাদুবলে এই অসাধ্য সাধন করলেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এত দূরে অবস্থান করে আমার পক্ষে প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করা অতি কঠিন কাজ। পত্রপত্রিকা পড়ে, টেলিভিশনে সংবাদ দেখে এবং নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে আলাপ করে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, সেটিই আজ পাঠকদের জানাচ্ছি। মামদানি নিউ ইয়র্কের মতো অসম্ভব ব্যয়বহুল শহরে সাধারণ জনগণের দিনযাপনের কষ্টটা ধরতে পেরেছেন। তাই ম্যানিফেস্টোতে তিনি প্রধানত বাসস্থান, যাতায়াত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যের সমস্যা সমাধানের দিকে জোর দিয়েছেন। এতে করে সাধারণ ভোটাররা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা মামদানিকে নিজেদের লোক মনে করেছেন। ‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া’র নেতিবাচক প্রচারণা মোকাবিলা করতে তিনি মুনশিয়ানার সঙ্গে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’কে ব্যবহার করেছেন এবং যথাসম্ভব ঘরে ঘরে গিয়ে তার কথা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মামদানি ভোট পাওয়ার আশায় নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। তার বক্তব্যে তিনি এতটুকু হেরফের করেননি। তার এই ধারাবাহিক সততাকে ভোটাররা পছন্দ করেছেন। মামদানির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, নিউ ইয়র্কের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুওমো এবং বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে নৈতিক ও অর্থনৈতিক স্খলনের গুরুতর অভিযোগ থাকায় মামদানির ব্যক্তিগত সততা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল। সুদর্শন মামদানির তারুণ্য এবং চমৎকার বাগ্মিতাও তরুণ ভোটারদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। ফলে তিরিশ বছর বয়সের নিচের ৭৮ শতাংশ ভোটার মামদানির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সেখানকার ‘জেন-জি’ গোষ্ঠী এই ভোট প্রদানের মাধ্যমে ধনবান এবং অসৎ শ্রেণির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘স্টেটাস কো’ (স্থিতাবস্থা) ভেঙে দিয়েছে। মেয়র পদের চূড়ান্ত নির্বাচনে ৬৮ বছরের এন্ড্রু কুওমো তার অন্ধ ইসরাইল সমর্থন এবং অভিজ্ঞতাকে প্রধান পুঁজি করে যে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করেছিলেন, সেটি তার জন্য বুমেরাং হয়েছে। আমেরিকার তরুণরা সে দেশের বুড়োদের মতো ইসরাইলের প্রতি বিবেক ও যুক্তিহীন এবং অন্ধ আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে আর সম্মত নয়। তারা উদ্ধত ইসরাইলকে ক্রমেই একটি বোঝা হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। আর এন্ড্রু কুওমো নির্বাচনি প্রচারে তার অভিজ্ঞতার যে বড়াই করেছেন, সেটিকে তরুণ ভোটাররা দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের উদাহরণ হিসেবে দেখেছেন। সাবেক গভর্নর কুওমো কয়েকশ মিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রচারের জৌলুসেও এই সত্য ঢেকে দিতে পারেননি যে, তিনি নৈতিক স্খলনের অপরাধেই নিউ ইয়র্কের গভর্নর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এন্ড্রু কুওমো ইহুদিবাদ এবং অভিজ্ঞতা ছাড়া নতুন কোনো বয়ান অথবা দিশা বর্ণনা করতে পারেননি। আজকের তরুণদের কাছে তার পরাজয় অবধারিতই ছিল।
এবার বাংলাদেশে আসি। আমাদের ‘জেন-জি’ হাসিনার মতো এক ভয়ংকর পিশাচ শাসক ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকে জুলাই বিপ্লবে পরাজিত করার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কলুষিত সিস্টেমে পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছিল। আমার মনে আছে, গত বছর ৮ আগস্ট ইস্তানবুলে এক টেলিভিশনে (টিআরটি) সাক্ষাৎকার প্রদানকালে আমি বলেছিলাম, প্রফেসর ইউনূস বিপ্লব-পরবর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিলেও বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক শহীদ আবু সাঈদ এবং তার সহযোদ্ধা বন্ধুরা। আমি সেদিন আশা করেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনীতির ‘স্টেটাস কো’ হয়তো এবার ভাঙবে। কিন্তু পনেরো মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর মনে হচ্ছে এমন একটি মহান বিপ্লবের পরও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। কদিন আগে তরুণ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের একটি বক্তব্য শুনলাম। তিনি মামদানির কথা উল্লেখ করে বললেন, এটি একটি অনন্য ঘটনা। তারপর তিনি বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন করতে ৮-১০ কোটি টাকা প্রয়োজন, সেটিও উল্লেখ করলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করারও ইঙ্গিত দিলেন তিনি। আমি যদি আসিফের বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝে থাকি, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে তিনি বলছেন, মামদানি মডেল বাংলাদেশে চলবে না এবং তিনিও পুরোনো পদ্ধতিতেই রাজনীতি করবেন। আমি জানি না আসিফের ভাষ্যমতে ৮-১০ কোটি টাকার নির্বাচনি তহবিল তিনি কোথা থেকে জোগাড় করবেন। হয়তো যে দলের আনুকূল্যে আসিফ সম্ভবত ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, সে-দলই তাকে এই বিপুল অর্থের ব্যবস্থা করে দেবে। আবার এমনও হতে পারে, সৎ কিংবা অসৎ উপায়ে অর্জিত, বিপুল বিত্তের অধিকারী কোনো একজন ব্যবসায়ী তার বিশেষ স্বার্থে জুলাই বিপ্লবের নায়কদের অন্যতম আসিফকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য ওই অর্থ লগ্নি করবেন। দল বা ব্যক্তি, যার টাকা দিয়েই আসিফের মতো জুলাইযোদ্ধারা নির্বাচন করুক না কেন, তাতে কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির পচে যাওয়া সিস্টেমে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বরং সিস্টেম তাদের হজম করে ফেলবে। ইতোমধ্যে জুলাইযোদ্ধাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বড় মনঃকষ্টে আছি। আমার সন্তানতুল্য ছেলেমেয়েদের আরো আদর্শবান দেখতে চেয়েছিলাম।
জোহরান মামদানির ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি যে তাকেও একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে হয়েছে। মেয়র নির্বাচনে জয়লাভ করার আগে অন্তত স্টেট অ্যাসেম্বলি সিনেটর পদে জিততে হয়েছে। তার অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সময় লেগেছে। সে তুলনায় নাহিদ, আসিফরা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। প্রফেসর ইউনূস তাদের শুধু বিপ্লবের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলেননি, অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগকর্তাও বলেছিলেন। তারা ফ্যাসিবাদের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন। কিন্তু দুঃখ হয় যে আমাদের ‘জেন-জি’ কতগুলো ‘রেটোরিক’ ছাড়া রাজনীতিতে নতুন কোনো অর্থবহ পরিবর্তনের বয়ান আনতে পারল না, নির্বাচনে ৮-১০ কোটি টাকা খরচ করার কলুষিত ধারণা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারল না। কোটি টাকা খরচ করে রোড শোর রাজনীতির পরিবর্তে কেন তরুণের দল পায়ে হেঁটে ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পারল না—সে প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তবে আমি একেবারে হতাশ হতেও রাজি নই। নিউ ইয়র্কের মতো শহরে, বিলিয়নিয়ার ইসলামবিদ্বেষী জায়নবাদী গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিজয়লাভ করা এক মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিমান অভিবাসী মুসলমান তরুণ জোহরান মামদানির গল্প আমাকে আশাবাদী করে। আমি কখনো ভুলি না যে, ২০২৪ সালে আমাদের তরুণরা রক্ত দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানোর মাধ্যমে এমন এক বিপ্লবের সূচনা করেছেন, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিপীড়িত জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে। সম্ভবত অনভিজ্ঞতার কারণেই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের সঠিকভাবে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য ও মতাদর্শ নিয়েও তাদের মধ্যে এখনো একপ্রকার বিভ্রান্তি রয়েছে বলেই আমি মনে করি। আমি প্রত্যাশা করি, ফ্যাসিবাদ হটাতে যারা জীবনের তোয়াক্কা করেনি, তারা এবার না হোক, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন ধরনের রাষ্ট্র ধারণা এবং বহু যুগ ধরে চলমান দুর্নীতির সঙ্গে কোনোভাবে আপস না করার সাহসী বয়ান নিয়ে জুলাইযোদ্ধারা জনগণের দুয়ারে হাজির হবে। আমাদের মতো আধমরাদের ঘা মেরে জাতিকে ইনশাআল্লাহ তারাই বাঁচাবে।

আমেরিকায় রীতিমতো রাজনৈতিক ভূমিকম্প সৃষ্টি করে জোহরান মামদানি যে কদিন আগে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, সেটি সব পাঠকই জানেন। কিন্তু তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার, রাজনীতিতে প্রবেশ, ইত্যাদি সম্পর্কে সবার হয়তো পুরো ধারণা নাও থাকতে পারে। আমি তাই অতি সংক্ষেপে সেই তথ্যগুলো দিয়ে তারপর আজকের আসল আলোচনায় যাচ্ছি।
জোহরান মামদানি ১৯৯১ সালে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় জন্মেছিলেন। তার বাবা ও মায়ের নাম যথাক্রমে মাহমুদ মামদানি এবং মীরা নায়ার। জোহরান এই দম্পতির একমাত্র সন্তান। মাহমুদ মামদানি ভারতের গুজরাটের শিয়া মুসলমান বংশোদ্ভূত হলেও তার বাবা অর্থাৎ জোহরান মামদানির দাদা আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ায় বসতি গেড়েছিলেন। পরে তারা সেখান থেকে উগান্ডায় চলে যান। মাহমুদ মামদানি একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি। অসম্ভব মেধাবী মাহমুদ মামদানি স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসেন। তিনি বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। হার্ভার্ডে পিএইচডি সমাপ্ত করার পর মাহমুদ মামদানি উগান্ডায় শিক্ষকতা জীবন শুরু করে ১৯৯৯ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য এক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়ায় অধ্যাপক হন এবং এখন পর্যন্ত সেখানেই অধ্যাপনা করছেন। জোহরানের মা মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনির্মাতা। মীরা ভারতের পাঞ্জাবের এক হিন্দু পরিবারের মেয়ে। তার বাবা অমৃতলাল নায়ার ভারতীয় উচ্চপদস্থ আইসিএস অফিসার ছিলেন। দিল্লিতে লেখাপড়া শুরু করে মীরা নায়ার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। তিনি ২০১২ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ পেয়েছেন। মীরা ও মাহমুদের সন্তান জোহরান মামদানি এ বছরই সিরিয়ার মুসলমান পরিবারের মেয়ে রামা দুয়াজিকে বিয়ে করেছেন। রামা দুয়াজি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিতে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। গাজার গণহত্যার ওপর তার অনেক চিত্রকর্ম রয়েছে।
জোহরান মামদানির বাবা ১৯৯৯ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি নিলে সাত বছরের বালক জোহরান উগান্ডা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ২০১৪ সালে তিনি নিউ ইয়র্কের বাউডেন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই জোহরান লেখালেখি করতেন এবং সংগীত তার নেশা ছিল। মায়ের সিনেমাতেও তিনি সংগীতের কাজ করেছেন। রাজনীতিতেও তার হাতেখড়ি ছাত্র অবস্থাতেই হয়েছিল। ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি তিনি ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনে আলি নাজমি নামের এক কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর জন্য প্রচার চালিয়েছিলেন। আলি নাজমি সেই নির্বাচনে হেরে গেলেও এখনো দুজনার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। আলি নাজমিকে জোহরান তার ভাই বলে সম্বোধন করেন। ২০১৫-পরবর্তী সময়ে মামদানি ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের পক্ষে বিভিন্ন অ্যাকটিভিজমে ব্যস্ত থেকেছেন। ২০২০ সালে জোহরান সর্বপ্রথম নিউ ইয়র্কের ৩৬ নম্বর স্টেট অ্যাসেম্বলি কুইন্সের সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে তিনি নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে কেউ সেটিকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। সবাই ধারণা করেছিলেন, চূড়ান্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তো দূরের কথা, জোহরান মামদানি তার দলের নমিনেশনই পাবেন না। রাজনীতির সাধারণ বিবেচনায় মামদানির অনেকগুলো অসুবিধা ছিল।
প্রথমত তিনি শুধু মুসলমান বাবারই সন্তান নন, উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসলামোফোবিক সমাজে বসবাস করেও ইসলাম ধর্ম নিয়ে মামদানি কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা বোধ করেননি। উল্টো তিনি বেশ গর্বের সঙ্গে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত নিউ ইয়র্কের জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও, মামদানি ফিলিস্তিন ইস্যুতে সব সময় অবিচলভাবে ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন। ভোটের জন্য তিনি ধর্ম নিয়ে কখনো কোনো ধরনের চালাকি অথবা ভণ্ডামির আশ্রয় নেননি। মামদানি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি আইসিসির ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, ইসরাইলের গণহত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্কে এলে তাকে গ্রেপ্তার করবেন। তৃতীয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটি তার কিংবা তার পরিবারের ছিল না। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে একটি এককক্ষের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। চতুর্থত যেই ধনকুবেররা সাধারণত প্রার্থীদের বিপুল অঙ্কের চাঁদা দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন, মামদানির নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো সরাসরি সেই ধনকুবেরদের স্বার্থবিরোধী ছিল। সুতরাং তারা মামদানিকে পরাজিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। পঞ্চমত মামদানির ফিলিস্তিনপন্থি নীতির কারণে তার নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রভাবশালী জায়নিস্ট অংশ তার বিরোধিতা করেছে। ষষ্ঠত কট্টর ইহুদি সমর্থক, ক্যাপিটালিস্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মামদানিকে পরাজিত করার জন্য নিজে মাঠে নেমেছিলেন। অতীতে ট্রাম্পের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট এভাবে স্থানীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি এবং সপ্তমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া প্রধানত জায়োনিস্ট-নিয়ন্ত্রিত হওয়ায়, মামদানিকে তথাকথিত ‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া’র ভয়ানক বৈরী প্রচারণাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
এতখানি বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তাহলে জোহরান মামদানি কোন জাদুবলে এই অসাধ্য সাধন করলেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এত দূরে অবস্থান করে আমার পক্ষে প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করা অতি কঠিন কাজ। পত্রপত্রিকা পড়ে, টেলিভিশনে সংবাদ দেখে এবং নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে আলাপ করে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, সেটিই আজ পাঠকদের জানাচ্ছি। মামদানি নিউ ইয়র্কের মতো অসম্ভব ব্যয়বহুল শহরে সাধারণ জনগণের দিনযাপনের কষ্টটা ধরতে পেরেছেন। তাই ম্যানিফেস্টোতে তিনি প্রধানত বাসস্থান, যাতায়াত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যের সমস্যা সমাধানের দিকে জোর দিয়েছেন। এতে করে সাধারণ ভোটাররা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা মামদানিকে নিজেদের লোক মনে করেছেন। ‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া’র নেতিবাচক প্রচারণা মোকাবিলা করতে তিনি মুনশিয়ানার সঙ্গে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’কে ব্যবহার করেছেন এবং যথাসম্ভব ঘরে ঘরে গিয়ে তার কথা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মামদানি ভোট পাওয়ার আশায় নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। তার বক্তব্যে তিনি এতটুকু হেরফের করেননি। তার এই ধারাবাহিক সততাকে ভোটাররা পছন্দ করেছেন। মামদানির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, নিউ ইয়র্কের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুওমো এবং বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে নৈতিক ও অর্থনৈতিক স্খলনের গুরুতর অভিযোগ থাকায় মামদানির ব্যক্তিগত সততা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল। সুদর্শন মামদানির তারুণ্য এবং চমৎকার বাগ্মিতাও তরুণ ভোটারদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। ফলে তিরিশ বছর বয়সের নিচের ৭৮ শতাংশ ভোটার মামদানির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। সেখানকার ‘জেন-জি’ গোষ্ঠী এই ভোট প্রদানের মাধ্যমে ধনবান এবং অসৎ শ্রেণির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘স্টেটাস কো’ (স্থিতাবস্থা) ভেঙে দিয়েছে। মেয়র পদের চূড়ান্ত নির্বাচনে ৬৮ বছরের এন্ড্রু কুওমো তার অন্ধ ইসরাইল সমর্থন এবং অভিজ্ঞতাকে প্রধান পুঁজি করে যে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করেছিলেন, সেটি তার জন্য বুমেরাং হয়েছে। আমেরিকার তরুণরা সে দেশের বুড়োদের মতো ইসরাইলের প্রতি বিবেক ও যুক্তিহীন এবং অন্ধ আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে আর সম্মত নয়। তারা উদ্ধত ইসরাইলকে ক্রমেই একটি বোঝা হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। আর এন্ড্রু কুওমো নির্বাচনি প্রচারে তার অভিজ্ঞতার যে বড়াই করেছেন, সেটিকে তরুণ ভোটাররা দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের উদাহরণ হিসেবে দেখেছেন। সাবেক গভর্নর কুওমো কয়েকশ মিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রচারের জৌলুসেও এই সত্য ঢেকে দিতে পারেননি যে, তিনি নৈতিক স্খলনের অপরাধেই নিউ ইয়র্কের গভর্নর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এন্ড্রু কুওমো ইহুদিবাদ এবং অভিজ্ঞতা ছাড়া নতুন কোনো বয়ান অথবা দিশা বর্ণনা করতে পারেননি। আজকের তরুণদের কাছে তার পরাজয় অবধারিতই ছিল।
এবার বাংলাদেশে আসি। আমাদের ‘জেন-জি’ হাসিনার মতো এক ভয়ংকর পিশাচ শাসক ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকে জুলাই বিপ্লবে পরাজিত করার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কলুষিত সিস্টেমে পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছিল। আমার মনে আছে, গত বছর ৮ আগস্ট ইস্তানবুলে এক টেলিভিশনে (টিআরটি) সাক্ষাৎকার প্রদানকালে আমি বলেছিলাম, প্রফেসর ইউনূস বিপ্লব-পরবর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিলেও বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক শহীদ আবু সাঈদ এবং তার সহযোদ্ধা বন্ধুরা। আমি সেদিন আশা করেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনীতির ‘স্টেটাস কো’ হয়তো এবার ভাঙবে। কিন্তু পনেরো মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর মনে হচ্ছে এমন একটি মহান বিপ্লবের পরও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। কদিন আগে তরুণ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের একটি বক্তব্য শুনলাম। তিনি মামদানির কথা উল্লেখ করে বললেন, এটি একটি অনন্য ঘটনা। তারপর তিনি বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন করতে ৮-১০ কোটি টাকা প্রয়োজন, সেটিও উল্লেখ করলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করারও ইঙ্গিত দিলেন তিনি। আমি যদি আসিফের বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝে থাকি, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে তিনি বলছেন, মামদানি মডেল বাংলাদেশে চলবে না এবং তিনিও পুরোনো পদ্ধতিতেই রাজনীতি করবেন। আমি জানি না আসিফের ভাষ্যমতে ৮-১০ কোটি টাকার নির্বাচনি তহবিল তিনি কোথা থেকে জোগাড় করবেন। হয়তো যে দলের আনুকূল্যে আসিফ সম্ভবত ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, সে-দলই তাকে এই বিপুল অর্থের ব্যবস্থা করে দেবে। আবার এমনও হতে পারে, সৎ কিংবা অসৎ উপায়ে অর্জিত, বিপুল বিত্তের অধিকারী কোনো একজন ব্যবসায়ী তার বিশেষ স্বার্থে জুলাই বিপ্লবের নায়কদের অন্যতম আসিফকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য ওই অর্থ লগ্নি করবেন। দল বা ব্যক্তি, যার টাকা দিয়েই আসিফের মতো জুলাইযোদ্ধারা নির্বাচন করুক না কেন, তাতে কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির পচে যাওয়া সিস্টেমে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বরং সিস্টেম তাদের হজম করে ফেলবে। ইতোমধ্যে জুলাইযোদ্ধাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বড় মনঃকষ্টে আছি। আমার সন্তানতুল্য ছেলেমেয়েদের আরো আদর্শবান দেখতে চেয়েছিলাম।
জোহরান মামদানির ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি যে তাকেও একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে হয়েছে। মেয়র নির্বাচনে জয়লাভ করার আগে অন্তত স্টেট অ্যাসেম্বলি সিনেটর পদে জিততে হয়েছে। তার অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সময় লেগেছে। সে তুলনায় নাহিদ, আসিফরা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। প্রফেসর ইউনূস তাদের শুধু বিপ্লবের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলেননি, অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগকর্তাও বলেছিলেন। তারা ফ্যাসিবাদের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন। কিন্তু দুঃখ হয় যে আমাদের ‘জেন-জি’ কতগুলো ‘রেটোরিক’ ছাড়া রাজনীতিতে নতুন কোনো অর্থবহ পরিবর্তনের বয়ান আনতে পারল না, নির্বাচনে ৮-১০ কোটি টাকা খরচ করার কলুষিত ধারণা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারল না। কোটি টাকা খরচ করে রোড শোর রাজনীতির পরিবর্তে কেন তরুণের দল পায়ে হেঁটে ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পারল না—সে প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তবে আমি একেবারে হতাশ হতেও রাজি নই। নিউ ইয়র্কের মতো শহরে, বিলিয়নিয়ার ইসলামবিদ্বেষী জায়নবাদী গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিজয়লাভ করা এক মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিমান অভিবাসী মুসলমান তরুণ জোহরান মামদানির গল্প আমাকে আশাবাদী করে। আমি কখনো ভুলি না যে, ২০২৪ সালে আমাদের তরুণরা রক্ত দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানোর মাধ্যমে এমন এক বিপ্লবের সূচনা করেছেন, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিপীড়িত জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে। সম্ভবত অনভিজ্ঞতার কারণেই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের সঠিকভাবে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য ও মতাদর্শ নিয়েও তাদের মধ্যে এখনো একপ্রকার বিভ্রান্তি রয়েছে বলেই আমি মনে করি। আমি প্রত্যাশা করি, ফ্যাসিবাদ হটাতে যারা জীবনের তোয়াক্কা করেনি, তারা এবার না হোক, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন ধরনের রাষ্ট্র ধারণা এবং বহু যুগ ধরে চলমান দুর্নীতির সঙ্গে কোনোভাবে আপস না করার সাহসী বয়ান নিয়ে জুলাইযোদ্ধারা জনগণের দুয়ারে হাজির হবে। আমাদের মতো আধমরাদের ঘা মেরে জাতিকে ইনশাআল্লাহ তারাই বাঁচাবে।

শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ১০ টাকা সের দরে জনগণকে চাল খাওয়াবেন। ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। এসব দইয়ের ডিব্বা কেমন করে চুন হয়েছিলÑতা সবার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।
৫ ঘণ্টা আগে
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যায় এবং এখন ভারতেই অবস্থান করছে। ফলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের দোর্দণ্ড প্রভাবের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়।
১ দিন আগে
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। ইতিহাসের নজিরবিহীন এই ঘটনায় দলীয় নেতাসহ তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। এদিকে দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় হবে সহসাই। তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ডজন ডজন মামলা বিচারাধীন।
১ দিন আগে
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য এই যে, অতি অল্পসংখ্যক অভিজাত গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে এই দেশটিকে শাসন করছে। তারা গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু আচরণে স্বৈরাচারী। সংস্কারের বুলি তোলে, কিন্তু সংস্কার করে শুধু নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য।
১ দিন আগে