মুজতবা খন্দকার
হাসিনার পতনটা ঠিক হজম করে উঠতে পারছে না প্রতিবেশী দেশ ভারত। পারবেই-বা কী করে, হাসিনা রেজিমের পুরো ফায়দা যে ভারত সুদ-আসলে আদায় করে নিয়েছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেদের স্বার্থে কর্তৃত্ববাদী হাসিনাকে গত পনেরো বছর ভারতই ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল। বিনিময়ে হাসিনা পুরো দেশটাকেই তুলে দিয়েছিল ভারতের হাতে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতে চলছিল হিন্দুস্তানের হেজিমনি। বাংলাদেশি, শিল্প-সংস্কৃতির পরিবর্তে দেশে গেড়ে বসেছিল হিন্দুয়ানি কালচার। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিতেও ভারতের দাদাগিরি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন হাসিনা। শুধু ক্ষমতার লোভে একটা স্বাধীন দেশকে অন্যের হাতে, অন্যের ইচ্ছায়, অন্যের স্বার্থে- এভাবেও যে তুলে দেওয়া যায়, সেটা হাসিনার শাসন না দেখলে আমরা জানতাম না।
আর তাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হঠাৎ হাসিনা সরকারের পতনটা ভারতের জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। যেন হঠাৎ স্বর্গচ্যুতি! যেটা ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত অলিখিত একধরনের যুদ্ধ শুরু করেছে।
ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। দেশটার একসময় পরিচিতি ছিল সেক্যুলার দেশ হিসেবে। কিন্তু গত চার দশকে দেশটির শাসকদের কীর্তিকলাপে কখনো মনে হয়নি সেটা। বরং বিরানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দেশটার নিরপেক্ষতার আলখেল্লা সম্পূর্ণভাবে খুলে পড়ে। পরে গেরুয়া ঝড় আছড়ে পড়ে গোটা ভারতে। আর মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত তো এখন পুরো মাত্রায় একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অবশ্য স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের শীর্ষনেতার আকাঙ্ক্ষায় সব সময় ছিল সম্প্রসারণবাদী মনোভাব। সেই মনোভাব তারা তাদের পরবর্তী শাসকদের মনেও চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। জার্মানদের ফাদার ল্যান্ড এবং ইহুদিদের হলি ল্যান্ডের মতো বৃহত্তর হিন্দুত্ববাদী ভারতের স্বপ্নও ভারতীয় নেতৃশ্রেণির মরমে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। তারা মনে করতেন বৃহত্তর ভারতের স্বপ্ন মিথ্যা হওয়ার নয়, প্রশ্নটা শুধু সময়ের। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালে ভারত হায়দ্রাবাদ দখল করে আর ১৯৭৫ সালে নিজেদের করে নেয় সিকিমকে। আর এসবই ছিল ভারতের নেতাদের সম্প্রসারণবাদী নীতিরই প্রতিফলন থেকে। দেশটির আরও একটি নীতি হচ্ছে, দখল না করতে পারলে সেই দেশে হিন্দুস্তানের কৃষ্টি-কালচার, তথা হেজিমনি এস্টাবলিস্ট করা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙার পেছনেও তাদের এই নীতি কাজ করেছিল। আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের সাহায্য-সহযোগিতাকে বেশ বড় করে দেখেন। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে নতজানু হয়ে ভারতের নেতৃত্বের কাছে ঋণ স্বীকার করেন। কিন্তু ভারত কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, সেটা কী তাদের দয়া ছিল, নাকি এদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে করেছিল? বিষয়টি মোটেও তা নয়। আধিপত্যবাদী ভারত আসলে তার দুই পাশে শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান থাকুক সেটা চায়নি। তারা এজন্য পাকিস্তানকে ভাঙাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল। ভারতের নেতৃত্ব আরও মনে করেছিল, পাকিস্তান না ভাঙলে সাতটি রাজ্য- উত্তর-পূর্ব ভারতে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য অখণ্ড রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর তাই তারা ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিল। ভারতের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ওই সময় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়েছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি। সেই সময় যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তিনি সেটাও ছিল তার সম্প্রসারণবাদী মনোভাবেরই অংশ। ভারতের এই সম্প্রসারণবাদী নীতির অংশ থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের আগ্রহে প্রথম নীতি প্রয়োগ হয় ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পঁচিশ বছর কথিত মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে। যেটা শেখ মুজিব ৭৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন। শেখ মুজিব শ্রীমতি গান্ধির প্রতি এতটাই কৃতজ্ঞ ছিলেন যে, তিনি ভারতের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে বাংলাদেশে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আপনারা অনেক করেছেন। কিন্তু পরস্থিতি এখনই স্থিতিশীল হয়নি, অস্ত্র এখনো জমা দেয়নি অনেকে, কোনো কোনো জায়গায় পাকিস্তানপন্থিরা এখনো রয়ে গেছে। সে কারণে অন্তত এক বছরের জন্য আপনার সশস্ত্র বাহিনী আমাদের দরকার। আনোয়ার জাহিদ
(রাজনীতিবিদ)/ কালের যাত্রার ধ্বনি॥ [গতিধারা- ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ । পৃ: ১৯-২০/ ৩১]
... অথচ ১৯৭২ সাল থেকেই ইতিহাসে লেখা হতো প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিল।
স্বাধীনতার গোড়া থেকেই ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়দের একটি দাসত্বসুলভ মনোভাব ছিল। তবে সেটা নিয়ে তাদের অনেকের মধ্যে অস্বস্তি ছিল, কিছুটা লুকোছাপাও ছিল। কিন্তু হাসিনা গত পনেরো বছরে সব অবগুণ্ঠন যেন খুলে দিয়েছিলেন। ভারতকে দু’হাত ভরে শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেল, বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হলো কি হলো না, সে তোয়াক্কা কখনো করেননি। হাসিনা গণভবনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বড়াই করে বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি তা সারাজীবন মনে রাখবে। কিন্তু বলতে পারেননি, এত এত দিয়ে বিনিময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশ কী পেয়েছে। বলবেনই-বা কেমন করে, ভারতকে পনেরো বছরে হাসিনা নৌ, স্থলবন্দর ট্রানিজট থেকে শুরু করে শুল্কমুক্ত এমন কোনো সুবিধা নেই যে দেয়নি। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খাতা বলতে গেলে শূন্য। শুধু কি তাই, দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক অদ্ভুত ন্যারেটিভ। যার নাম দেওয়া হয়েছিল চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার নাম এবং হিন্দুস্তান বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এই শুভঙ্করের ফাঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভারতের হেজিমনি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তবে ভারতের এই সম্প্রসারণবাদী নীতি বাংলাদেশের দুই জন নেতা চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হন। এর একজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী আর অন্যজন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ভাসানী ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে লংমার্চ করে প্রথম আধিপত্যবাদী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন আর এ ইস্যুটাকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে ভারতের অপ্রতিবেশীসুলভ ও বৈষম্যমূলক মনোভাব তুলে ধরেন। এরপর বেগম খালেদা জিয়াও ভারতের বিরুদ্ধে তার ইস্পাত কঠোর মনোভাব দেখিয়ে ৯১-৯৬ সালে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু এক-এগারোর চক্রান্ত করে লন্ডভন্ড করে দেয় সবকিছু। এরপর গত দেড় যুগের ইতিহাস তো শুধু হতাশার আর স্বপ্ন ভঙ্গের। হাসিনা তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে দিল্লির নিঃশর্ত বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
আর তাই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ভারত মেনে নিতে পারেনি, এখনো পারছে না। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে প্রতিদিনই নানাবিধ চক্রান্ত করে যাচ্ছে। আর তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সে দেশে আশ্রিত হাসিনা ও তার শাগরেদগং। ভারত বুঝতে কিংবা অনুধাবন করতে পারছে না যে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করলে ভারতের অখণ্ডতা যে কোনো সময় হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, তাদের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জিয়নকাঠি অনেকটাই বাংলাদেশের হাতে। বাংলাদেশ যদি সড়ক ট্রানিজট না দেয়, তবে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন ভারতের এই রাজ্যগুলোতে রসদ সরবরাহ করতে ভারতের যে পরিমাণ ঝুঁকি এবং আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে সেটা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই ভারতের শাসকগোষ্ঠী কি আম-ছালা দুটোই হারানোর এই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছে?
শেখ মুজিবের যোগ্য উত্তরসূরি তার কন্যা হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে গত প্রায় দেড় যুগ ছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কিছুটা বৈধপথে আর বাকিটা জোর করে। এই সময়ে কাজকর্মে পিতার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণে তিনি ছিলেন পিতার চেয়ে এক কাঠি সরেস। পিতা মুজিব নির্বিঘ্নে দেশ চালাতে বিরোধী দল নির্মূল করতে বাকশাল গঠন এবং বিরোধী মিডিয়া নিষিদ্ধ করে দেশকে বিরোধী মতশূন্য করে ছেড়েছিলেন। পনেরো বছরের শাসনকালে শেখ হাসিনা কৌশল পালটালেও পিতার দেখানো পথেই হেঁটেছেন… ডিজিটাল আইন করে গণমাধ্যমসহ জনমানুষের মতপ্রকাশের অধিকার করেছিলেন হরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক থেকে তেরো বছর স্কুলপড়ুয়াও তার আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি। বিবেকের তাড়নায়, সরকারের কিছু মাত্র সমালোচনা করলে- এমনকি রেহাই দেয়নি লেখক অ্যাকটিভিস্ট মুশতাককে। কারাগারের প্রকোষ্ঠে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে হাসিনার বাহিনী চালিয়েছিল নিষ্ঠুর নির্যাতন। সব কিছুই বাবার ফরমুলা অনুযায়ী করে গেছেন তার যোগ্য উত্তরসূরি কন্যা!
মুজিবের একদলীয় বাকশাল সরকারের সময়ে গণমাধ্যমের সেই অকাল, দুঃসময়ের খবরটা আমাদের অনকের ঠিক সেভাবে জানা নেই, কিংবা পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম তারাই-বা বাহাত্তর-পঁচাত্তর সালের আসল চিত্র কতটুকু জানেন। আজকে আমরা যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা (কমবেশি) ভোগ করছি, সেটা কাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রামের ফসল সেটা আমাদের এখনকার তরুণ সংবাদকর্মীরা অনেকেই হয়তো জানেন না। তাদের জানানো হয় না। হয়তো জানতে দেওয়া হয় না। হাসিনার পনেরো বছরে শেখ মুজিবকে দেবতার আসনে বসিয়ে সর্বত্র চলছে পূজা। প্রেসক্লাবেও তার মূর্তি বসানো হয়েছিল। অথচ দেশ স্বাধীনের পর তার শাসনামলে গণমাধ্যমের টুঁটিটা যদি এরকম করে চেপে না ধরা হতো, তবে গণমাধ্যম এতদিনে একটি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতো, শেখ মুজিব নিজহাতে সে সম্ভাবনা গলাটিপে হত্যা করেছেন। বাকশাল শাসন প্রবর্তন করে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনা শুরুতেই ধ্বংস করা হয়েছিল। তেমনি মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকিসব গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করে বাকস্বাধীনতা শুধু হরণ করা হয়েছিল তাই নয়, চাকরিচ্যুত করে হাজার হাজার সংবাদকর্মীকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। এক মিনিটে সংসদে চতুর্থ সংশোধনী পাস করে বাকশাল গঠন, আজীবন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত করার পর সে সময় দেশে কার্যত আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না।
হাসিনা পিতার চেয়ে আরও কঠিন ও কঠোরভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেই শুধু ক্ষ্যান্ত হননি। বিরোধী মতের সব টিভি, পত্রিকা বন্ধ করে বিরোধী মতের সাংবাদিক, সম্পাদককে জেলে পুরে আর ক্ষেত্রবিশেষ জেলে পুরে, বাকিগুলোকে বশংবদ সম্পাদক, সাংবাদিককে নিয়োগ দিয়ে তার কথামতো চলতে বাধ্য করেছিলেন। এসব হচ্ছে হাসিনার সময়ে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিপীড়নের খণ্ডচিত্র মাত্র। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ।
হাসিনা গত সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে পিতার স্বপ্ন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে প্রয়োগ করিয়ে দেখিয়েছেন। তবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ এসব ভালোভাবে নেয়নি। তারা শাসকদের অত্যাচার, অনাচার মুখ বুঝে সবকিছু মেনে নিয়ে চুপ থেকেছিল বটে। তবে ভেতরে তাদের যে আকাঙ্ক্ষা, তাদের যে ক্ষোভ, যে আক্রোশ তা একটুও মিইয়ে যায়নি, রয়ে যায়। তার সবশেষে প্রমাণ আমরা পাই শেখ মুজিবের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর। যে হত্যাকাণ্ডে কেউ একটু শোক প্রকাশও করেনি দেশের মানুষের কেউ। যেমন : ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের মানুষ মুক্তির আনন্দে বুনো উল্লাস করেছিল। শেখ মুজিবের শাসন নিয়ে বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ লিখেছিলেন :
‘... কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত মুজিবি শাসন হচ্ছে ত্রাসের, হত্যার, কাড়ার, মারার, জোর-জুলুমের, স্বৈরাচারের, দুর্ভিক্ষের, পীড়নের, শোষণের, জবরদখলের ও জবরদস্তির হৃৎকাঁপানো বীভৎস রূপের। তাই তার সপরিবার হত্যায়ও কেউ দুঃখশোক পায়নি। তাই মুজিব নন্দিত নন, নিন্দিত॥’ মুজিবের কন্যা হাসিনার ১৫ বছরের শাসন অবিকল সেটা ছিল নয় কি? ১৬/১২/১৯৯৭ আহমদ শরীফ/ আহমদ শরীফের ডায়েরি : ভাব-বুদ্বুদ।। [জাগৃতি প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। পৃ. ১৭৩]
লেখক : কলামিস্ট, অ্যাকটিভিস্ট এবং যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, এনটিভি
হাসিনার পতনটা ঠিক হজম করে উঠতে পারছে না প্রতিবেশী দেশ ভারত। পারবেই-বা কী করে, হাসিনা রেজিমের পুরো ফায়দা যে ভারত সুদ-আসলে আদায় করে নিয়েছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেদের স্বার্থে কর্তৃত্ববাদী হাসিনাকে গত পনেরো বছর ভারতই ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল। বিনিময়ে হাসিনা পুরো দেশটাকেই তুলে দিয়েছিল ভারতের হাতে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতে চলছিল হিন্দুস্তানের হেজিমনি। বাংলাদেশি, শিল্প-সংস্কৃতির পরিবর্তে দেশে গেড়ে বসেছিল হিন্দুয়ানি কালচার। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিতেও ভারতের দাদাগিরি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন হাসিনা। শুধু ক্ষমতার লোভে একটা স্বাধীন দেশকে অন্যের হাতে, অন্যের ইচ্ছায়, অন্যের স্বার্থে- এভাবেও যে তুলে দেওয়া যায়, সেটা হাসিনার শাসন না দেখলে আমরা জানতাম না।
আর তাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হঠাৎ হাসিনা সরকারের পতনটা ভারতের জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। যেন হঠাৎ স্বর্গচ্যুতি! যেটা ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত অলিখিত একধরনের যুদ্ধ শুরু করেছে।
ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। দেশটার একসময় পরিচিতি ছিল সেক্যুলার দেশ হিসেবে। কিন্তু গত চার দশকে দেশটির শাসকদের কীর্তিকলাপে কখনো মনে হয়নি সেটা। বরং বিরানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দেশটার নিরপেক্ষতার আলখেল্লা সম্পূর্ণভাবে খুলে পড়ে। পরে গেরুয়া ঝড় আছড়ে পড়ে গোটা ভারতে। আর মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত তো এখন পুরো মাত্রায় একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অবশ্য স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের শীর্ষনেতার আকাঙ্ক্ষায় সব সময় ছিল সম্প্রসারণবাদী মনোভাব। সেই মনোভাব তারা তাদের পরবর্তী শাসকদের মনেও চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। জার্মানদের ফাদার ল্যান্ড এবং ইহুদিদের হলি ল্যান্ডের মতো বৃহত্তর হিন্দুত্ববাদী ভারতের স্বপ্নও ভারতীয় নেতৃশ্রেণির মরমে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। তারা মনে করতেন বৃহত্তর ভারতের স্বপ্ন মিথ্যা হওয়ার নয়, প্রশ্নটা শুধু সময়ের। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালে ভারত হায়দ্রাবাদ দখল করে আর ১৯৭৫ সালে নিজেদের করে নেয় সিকিমকে। আর এসবই ছিল ভারতের নেতাদের সম্প্রসারণবাদী নীতিরই প্রতিফলন থেকে। দেশটির আরও একটি নীতি হচ্ছে, দখল না করতে পারলে সেই দেশে হিন্দুস্তানের কৃষ্টি-কালচার, তথা হেজিমনি এস্টাবলিস্ট করা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙার পেছনেও তাদের এই নীতি কাজ করেছিল। আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের সাহায্য-সহযোগিতাকে বেশ বড় করে দেখেন। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে নতজানু হয়ে ভারতের নেতৃত্বের কাছে ঋণ স্বীকার করেন। কিন্তু ভারত কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, সেটা কী তাদের দয়া ছিল, নাকি এদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে করেছিল? বিষয়টি মোটেও তা নয়। আধিপত্যবাদী ভারত আসলে তার দুই পাশে শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান থাকুক সেটা চায়নি। তারা এজন্য পাকিস্তানকে ভাঙাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল। ভারতের নেতৃত্ব আরও মনে করেছিল, পাকিস্তান না ভাঙলে সাতটি রাজ্য- উত্তর-পূর্ব ভারতে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য অখণ্ড রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর তাই তারা ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিল। ভারতের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ওই সময় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়েছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি। সেই সময় যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তিনি সেটাও ছিল তার সম্প্রসারণবাদী মনোভাবেরই অংশ। ভারতের এই সম্প্রসারণবাদী নীতির অংশ থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের আগ্রহে প্রথম নীতি প্রয়োগ হয় ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পঁচিশ বছর কথিত মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে। যেটা শেখ মুজিব ৭৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন। শেখ মুজিব শ্রীমতি গান্ধির প্রতি এতটাই কৃতজ্ঞ ছিলেন যে, তিনি ভারতের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে বাংলাদেশে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আপনারা অনেক করেছেন। কিন্তু পরস্থিতি এখনই স্থিতিশীল হয়নি, অস্ত্র এখনো জমা দেয়নি অনেকে, কোনো কোনো জায়গায় পাকিস্তানপন্থিরা এখনো রয়ে গেছে। সে কারণে অন্তত এক বছরের জন্য আপনার সশস্ত্র বাহিনী আমাদের দরকার। আনোয়ার জাহিদ
(রাজনীতিবিদ)/ কালের যাত্রার ধ্বনি॥ [গতিধারা- ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ । পৃ: ১৯-২০/ ৩১]
... অথচ ১৯৭২ সাল থেকেই ইতিহাসে লেখা হতো প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিল।
স্বাধীনতার গোড়া থেকেই ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়দের একটি দাসত্বসুলভ মনোভাব ছিল। তবে সেটা নিয়ে তাদের অনেকের মধ্যে অস্বস্তি ছিল, কিছুটা লুকোছাপাও ছিল। কিন্তু হাসিনা গত পনেরো বছরে সব অবগুণ্ঠন যেন খুলে দিয়েছিলেন। ভারতকে দু’হাত ভরে শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেল, বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হলো কি হলো না, সে তোয়াক্কা কখনো করেননি। হাসিনা গণভবনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বড়াই করে বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি তা সারাজীবন মনে রাখবে। কিন্তু বলতে পারেননি, এত এত দিয়ে বিনিময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশ কী পেয়েছে। বলবেনই-বা কেমন করে, ভারতকে পনেরো বছরে হাসিনা নৌ, স্থলবন্দর ট্রানিজট থেকে শুরু করে শুল্কমুক্ত এমন কোনো সুবিধা নেই যে দেয়নি। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খাতা বলতে গেলে শূন্য। শুধু কি তাই, দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক অদ্ভুত ন্যারেটিভ। যার নাম দেওয়া হয়েছিল চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার নাম এবং হিন্দুস্তান বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এই শুভঙ্করের ফাঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভারতের হেজিমনি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তবে ভারতের এই সম্প্রসারণবাদী নীতি বাংলাদেশের দুই জন নেতা চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হন। এর একজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী আর অন্যজন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ভাসানী ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে লংমার্চ করে প্রথম আধিপত্যবাদী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন আর এ ইস্যুটাকে জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে ভারতের অপ্রতিবেশীসুলভ ও বৈষম্যমূলক মনোভাব তুলে ধরেন। এরপর বেগম খালেদা জিয়াও ভারতের বিরুদ্ধে তার ইস্পাত কঠোর মনোভাব দেখিয়ে ৯১-৯৬ সালে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু এক-এগারোর চক্রান্ত করে লন্ডভন্ড করে দেয় সবকিছু। এরপর গত দেড় যুগের ইতিহাস তো শুধু হতাশার আর স্বপ্ন ভঙ্গের। হাসিনা তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে দিল্লির নিঃশর্ত বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
আর তাই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ভারত মেনে নিতে পারেনি, এখনো পারছে না। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে প্রতিদিনই নানাবিধ চক্রান্ত করে যাচ্ছে। আর তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সে দেশে আশ্রিত হাসিনা ও তার শাগরেদগং। ভারত বুঝতে কিংবা অনুধাবন করতে পারছে না যে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করলে ভারতের অখণ্ডতা যে কোনো সময় হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, তাদের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জিয়নকাঠি অনেকটাই বাংলাদেশের হাতে। বাংলাদেশ যদি সড়ক ট্রানিজট না দেয়, তবে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন ভারতের এই রাজ্যগুলোতে রসদ সরবরাহ করতে ভারতের যে পরিমাণ ঝুঁকি এবং আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে সেটা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই ভারতের শাসকগোষ্ঠী কি আম-ছালা দুটোই হারানোর এই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছে?
শেখ মুজিবের যোগ্য উত্তরসূরি তার কন্যা হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে গত প্রায় দেড় যুগ ছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কিছুটা বৈধপথে আর বাকিটা জোর করে। এই সময়ে কাজকর্মে পিতার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণে তিনি ছিলেন পিতার চেয়ে এক কাঠি সরেস। পিতা মুজিব নির্বিঘ্নে দেশ চালাতে বিরোধী দল নির্মূল করতে বাকশাল গঠন এবং বিরোধী মিডিয়া নিষিদ্ধ করে দেশকে বিরোধী মতশূন্য করে ছেড়েছিলেন। পনেরো বছরের শাসনকালে শেখ হাসিনা কৌশল পালটালেও পিতার দেখানো পথেই হেঁটেছেন… ডিজিটাল আইন করে গণমাধ্যমসহ জনমানুষের মতপ্রকাশের অধিকার করেছিলেন হরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক থেকে তেরো বছর স্কুলপড়ুয়াও তার আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি। বিবেকের তাড়নায়, সরকারের কিছু মাত্র সমালোচনা করলে- এমনকি রেহাই দেয়নি লেখক অ্যাকটিভিস্ট মুশতাককে। কারাগারের প্রকোষ্ঠে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে হাসিনার বাহিনী চালিয়েছিল নিষ্ঠুর নির্যাতন। সব কিছুই বাবার ফরমুলা অনুযায়ী করে গেছেন তার যোগ্য উত্তরসূরি কন্যা!
মুজিবের একদলীয় বাকশাল সরকারের সময়ে গণমাধ্যমের সেই অকাল, দুঃসময়ের খবরটা আমাদের অনকের ঠিক সেভাবে জানা নেই, কিংবা পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম তারাই-বা বাহাত্তর-পঁচাত্তর সালের আসল চিত্র কতটুকু জানেন। আজকে আমরা যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা (কমবেশি) ভোগ করছি, সেটা কাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রামের ফসল সেটা আমাদের এখনকার তরুণ সংবাদকর্মীরা অনেকেই হয়তো জানেন না। তাদের জানানো হয় না। হয়তো জানতে দেওয়া হয় না। হাসিনার পনেরো বছরে শেখ মুজিবকে দেবতার আসনে বসিয়ে সর্বত্র চলছে পূজা। প্রেসক্লাবেও তার মূর্তি বসানো হয়েছিল। অথচ দেশ স্বাধীনের পর তার শাসনামলে গণমাধ্যমের টুঁটিটা যদি এরকম করে চেপে না ধরা হতো, তবে গণমাধ্যম এতদিনে একটি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতো, শেখ মুজিব নিজহাতে সে সম্ভাবনা গলাটিপে হত্যা করেছেন। বাকশাল শাসন প্রবর্তন করে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনা শুরুতেই ধ্বংস করা হয়েছিল। তেমনি মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকিসব গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করে বাকস্বাধীনতা শুধু হরণ করা হয়েছিল তাই নয়, চাকরিচ্যুত করে হাজার হাজার সংবাদকর্মীকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। এক মিনিটে সংসদে চতুর্থ সংশোধনী পাস করে বাকশাল গঠন, আজীবন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত করার পর সে সময় দেশে কার্যত আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না।
হাসিনা পিতার চেয়ে আরও কঠিন ও কঠোরভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেই শুধু ক্ষ্যান্ত হননি। বিরোধী মতের সব টিভি, পত্রিকা বন্ধ করে বিরোধী মতের সাংবাদিক, সম্পাদককে জেলে পুরে আর ক্ষেত্রবিশেষ জেলে পুরে, বাকিগুলোকে বশংবদ সম্পাদক, সাংবাদিককে নিয়োগ দিয়ে তার কথামতো চলতে বাধ্য করেছিলেন। এসব হচ্ছে হাসিনার সময়ে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিপীড়নের খণ্ডচিত্র মাত্র। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ।
হাসিনা গত সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে পিতার স্বপ্ন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে প্রয়োগ করিয়ে দেখিয়েছেন। তবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ এসব ভালোভাবে নেয়নি। তারা শাসকদের অত্যাচার, অনাচার মুখ বুঝে সবকিছু মেনে নিয়ে চুপ থেকেছিল বটে। তবে ভেতরে তাদের যে আকাঙ্ক্ষা, তাদের যে ক্ষোভ, যে আক্রোশ তা একটুও মিইয়ে যায়নি, রয়ে যায়। তার সবশেষে প্রমাণ আমরা পাই শেখ মুজিবের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর। যে হত্যাকাণ্ডে কেউ একটু শোক প্রকাশও করেনি দেশের মানুষের কেউ। যেমন : ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের মানুষ মুক্তির আনন্দে বুনো উল্লাস করেছিল। শেখ মুজিবের শাসন নিয়ে বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ লিখেছিলেন :
‘... কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত মুজিবি শাসন হচ্ছে ত্রাসের, হত্যার, কাড়ার, মারার, জোর-জুলুমের, স্বৈরাচারের, দুর্ভিক্ষের, পীড়নের, শোষণের, জবরদখলের ও জবরদস্তির হৃৎকাঁপানো বীভৎস রূপের। তাই তার সপরিবার হত্যায়ও কেউ দুঃখশোক পায়নি। তাই মুজিব নন্দিত নন, নিন্দিত॥’ মুজিবের কন্যা হাসিনার ১৫ বছরের শাসন অবিকল সেটা ছিল নয় কি? ১৬/১২/১৯৯৭ আহমদ শরীফ/ আহমদ শরীফের ডায়েরি : ভাব-বুদ্বুদ।। [জাগৃতি প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। পৃ. ১৭৩]
লেখক : কলামিস্ট, অ্যাকটিভিস্ট এবং যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, এনটিভি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ছয় মাসের মাথায় গণহত্যাকারীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। গত দেড় দশকে মুজিবের রাজপরিবার দেশে যে নিপীড়নমূলক শাসক চাপিয়ে দিয়েছিল, তা স্বাভাবিক করতে ফ্যাসিস্টদের প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান জানানোর বয়ান হাজির করা হচ্ছে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে অন্যতম ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো টোটেম সংস্কৃতি। এর অর্থ হলো, কোনো প্রভাবশালী মৃত ব্যক্তি বা বস্তুকে টোটেম বা ‘পূজার আসনে’ বসানো এবং তাকে ঘিরেই সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নির্ধারণ করা।
১০ ঘণ্টা আগেপ্রতিবছর সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সরাসরি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তাই আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে এবারের তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন।
১১ ঘণ্টা আগেস্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আল্লাহ প্রদত্ত মহান এক নিয়ামত। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর যখনই কোনো নগ্ন থাবা এসেছে, তা রুখে দাঁড়াতে প্রতিবার স্বাধিকার চেতনায় উজ্জীবিত, সৎ-সাহসী কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছেন। দেশের আপামর জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দুর্বার সংগ্রামে।
১২ ঘণ্টা আগে