কাজী জহিরুল ইসলাম
চারটি জাতীয় দিবসের মধ্যে ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে আমরা নতুন আমেজে, নতুন উদ্দীপনায় তিনটি দিবস, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ২৬ মার্চ, উদযাপন করেছি, চতুর্থ দিবসটি এদেশের মানুষ বিপুল উৎসাহে নতুনভাবে উদযাপন করেছে।
১৪৩২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ যে বাংলাদেশের মানুষকে নতুন কিছু উপহার দেবে তা ইতোমধ্যেই সুস্পষ্ট হয়েছে। এই দিবসটিকে বলা হয় বাংলাদেশের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক জাতীয় দিবস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি আমরা এটিকে সকল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্কের উর্ধে রাখতে পেরেছি? না, পারিনি। প্রতি বছরই চারুকলা ইন্সটিটিউট যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে এবং সারা দেশ, প্রবাসের মঞ্চগুলোতে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানা হয় সেগুলো কি বিতর্কের বাইরে থাকে? থাকে না।
এর মূল কারণ হচ্ছে আমরা নববর্ষের এই অসাম্প্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক উৎসবটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারিনি। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিট বাঙালিরা কিছুতেই মুসলমানদের বাঙালি হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, আনন্দবাজার গ্রুপের পাক্ষিক দেশ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখে তারা বাঙালিদের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে বলেন, চতুর্থ একজন মুসলমান হলেও, বাঙালিই। এতোটা কষ্ট করে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তারা বাঙালি হিসেবে মেনে নেয়।
ভারতীয় হেজিমোনির মধ্যে শৃঙ্খলিত আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো সময় জুড়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল পুরোপুরি একপাক্ষিক। ধর্মীয় দিক থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হওয়া সত্বেও প্রতিনিয়ত বাঙালি মুসলমানদের কৃষ্টি, আচার, প্রথা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু উপেক্ষিতই ছিল না, পরিকল্পিতভাবে প্রায় অচ্ছুতের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও একজন শিল্পী গানের মঞ্চে, আবৃত্তির মঞ্চে টুপি পরে উঠতেন না, হিজাব পরে দাঁড়াতেন না, তারা ভয় পেতেন, কারণ এমন একটি সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছিল যে টুপি, হিজাব এগুলো হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রায়, মঞ্চের অনুষ্ঠানে কেউ কখনো মুসলিম সংস্কৃতির প্রতিকৃতি বহন করেনি, গজল, কাওয়ালি গায়নি। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান, জীবজন্তু ও দেব-দেবীর প্রতিকৃতি বহন করার প্রথা পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পছন্দকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তনই করেছেন একজন মুসলমান শাসক, মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, মির্জা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর।
সম্রাট যাকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন, তিনিও আরেক ভিনদেশী মুসলমান, পারস্যের নাগরিক, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ সৈয়দ মীর ফতহুল্লাহ শিরাজী। গত বছর নববর্ষের প্রাক্কালে আমি সর্বমঙ্গল শোভাযাত্রার কথা বলেছিলাম। মূল প্রতিবাদ্য ছিল দিবসটি যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। মঙ্গলের সঙ্গে সর্ব বিশেষণ যোগ করার কোনো দরকার হত না যদি মঙ্গলশোভাযাত্রা প্রকৃত অর্থে সর্ব সংস্কৃতির সমন্বয়ে হত। সব দুধ খাঁটি হলে আমাদের আর খাঁটি দুধ কথাটি বলার যেমন প্রয়োজন হয় না। বাজারে ভেজাল দুধ আছে বলেই চেঁচিয়ে বলতে হয়, আমার খাঁটি দুধ চাই।
ভাষা ও সংস্কৃতির শুদ্ধতা একটি ইউটোপিয়ান সমাজের ধারণার মত অসম্ভব ব্যাপার। জাতিগত শুদ্ধতাও সম্ভব নয়। ইউরোপীয়রা আর্য জাতির শুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য পনেরো লক্ষ রোমা জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে। লক্ষ লক্ষ রোমা নারীকে তারা জোর করে বন্ধ্যা করে দেয়। জার্মান নাৎসি বাহিনী একই লক্ষ্যে ষাট লক্ষ ইহুদি হত্যা করে। তাতে কি শুদ্ধতা নিশ্চিত হয়েছে? উগ্র হিন্দুবাদী মোদি সরকারের নেতারা মাঝে মধ্যেই মুসলিম নিধন করে ভারতকে শুদ্ধ করার হুমকি-ধামকি দেয়। জার্মানরা কি আর্য রক্তের শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে পেরেছে? ২০০১ সালে কসোভোর রোমা পল্লীতে আমি নিজে দেখেছি এক জার্মান পুরুষ রোমা নারীকে বিয়ে করে সংসার করছে। এখন তো মিক্স ম্যারেজ ইউরোপ-আমেরিকায় ভীষণভাবে সমাদ্রিত। বরং মিশ্রবর্ণের মানুষদের প্রতি বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণ আরো তীব্র। এখন বলা হচ্ছে মিশ্র জাতির ছেলে-মেয়েরা মানুষ হিসেবে উন্নততর।
ভাষা ও সংস্কৃতি হচ্ছে একটি প্রবহমান নদীর মত, ছুটে যেতে যেতে সে ধারণ করে দুই তীর থেকে গড়িয়ে পড়া পলি। উপ-মহাদেশে মালিক দিনার নামক একজন ইরাকী সাহাবা এসেছিলেন, তিনি কেরালায় একটি মসজিদ স্থাপন করেন, এটিই উপমহাদেশের প্রথম মসজিদ। ৭৪৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে সেই মসজিদেই তাকে সমাহিত করা হয়।
কাছাকাছি সময়ে মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সিন্ধু বিজয় এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের সুচনা করে। অষ্টম শতকেই বাংলায় ইসলাম প্রচারকদের আগমন ঘটে। ১২০৪ সালে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার শাসনকর্তা হন। সেই সময়ে বাংলা হয়ে ওঠে জান্নাতুল বালাদ। ত্রয়োদশ শতক থেকে ভারতবর্ষে মুসলমানদেরই জয় জয়কার ছিল। কুতুবউদ্দিন আইবেক, শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ, পরবর্তীতে ইব্রাহীম লোদীকে ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করে জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লির শাসন ক্ষমতায় চলে আসেন এবং মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৩৩০ বছর মুঘলরা শাসন করার পর ১৮৫৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষের দখল নেয়।
প্রায় ১১শ বছর ধরে পুরো ভারতবর্ষে, এবং অবশ্যই বাংলায়, মুসলমানদের একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই সংস্কৃতি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালি সংস্কৃতির শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে আজ যদি তাদেরকে সালামের বদলে আদাব, পাজামার বদলে ধুতি, পানির বদলে জল, গজলের বদলে রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাধ্য করা হয় তার পরিণাম কিছুতেই ভালো হতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ যেমন আমাদের, গজল-কাওয়ালীও আমাদের, ভজন, কীর্তনও আমাদের, পীর-ফকিরের মাজার আমাদের, বাউল গান আমাদের, পূজো-পার্বন আমাদের, ঈদ আমাদের, রোজা, ইফতার, সেহরি সবই আমাদের। প্রত্যেকে তার ধর্ম ও সংস্কৃতি নির্বিঘ্নে বুক ফুলিয়ে পালন করবে, কেউ কাউকে বাঁধা দেবে না, কটু কথা বলবে না। আমরা শুধু পরস্পরকে মেনে নেব না, ভালোবেসে ভিন্ন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান উপভোগ করবো, কারণ এর সবই আমাদের। অসাম্প্রদায়িকতার এই ন্যারেটিভ আমাদের তৈরি করতে হবে।
অসাম্প্রদায়িকতা আসলে কী জিনিস, এটা আগে ভালো করে বুঝতে হবে। ধর্মকে, বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের পুজো অর্চনা, দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি, নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদিকে বাতিল করে দিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা করা অসাম্প্রদায়িকতা নয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা হচ্ছে নিজের হৃদয়কে একটি সর্বগ্রাহ্য পাত্রে পরিণত করা, যাতে যে কোনো ধর্ম, যে কোনো মতবাদ, এমন কী নাস্তিক্যবাদকেও আমি সম্মান করতে পারি। এই জায়গাটিতে পৌঁছানোর জন্য উপযুক্ত ন্যারেটিভ আমাদের তৈরি করতে হবে। এই ন্যারেটিভ তৈরি করার প্রধান প্লাটফর্ম হচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ হতে পারে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রধান মঞ্চ। এই লক্ষ্যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ এখন সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়েছে, একটি অন্তর্ভুক্তিমুলক বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ পালনের মধ্য দিয়ে আমরা তা নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক। হলিসউড, নিউইয়র্ক।
চারটি জাতীয় দিবসের মধ্যে ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে আমরা নতুন আমেজে, নতুন উদ্দীপনায় তিনটি দিবস, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ২৬ মার্চ, উদযাপন করেছি, চতুর্থ দিবসটি এদেশের মানুষ বিপুল উৎসাহে নতুনভাবে উদযাপন করেছে।
১৪৩২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ যে বাংলাদেশের মানুষকে নতুন কিছু উপহার দেবে তা ইতোমধ্যেই সুস্পষ্ট হয়েছে। এই দিবসটিকে বলা হয় বাংলাদেশের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক জাতীয় দিবস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি আমরা এটিকে সকল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্কের উর্ধে রাখতে পেরেছি? না, পারিনি। প্রতি বছরই চারুকলা ইন্সটিটিউট যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে এবং সারা দেশ, প্রবাসের মঞ্চগুলোতে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানা হয় সেগুলো কি বিতর্কের বাইরে থাকে? থাকে না।
এর মূল কারণ হচ্ছে আমরা নববর্ষের এই অসাম্প্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক উৎসবটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারিনি। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিট বাঙালিরা কিছুতেই মুসলমানদের বাঙালি হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, আনন্দবাজার গ্রুপের পাক্ষিক দেশ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখে তারা বাঙালিদের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে বলেন, চতুর্থ একজন মুসলমান হলেও, বাঙালিই। এতোটা কষ্ট করে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তারা বাঙালি হিসেবে মেনে নেয়।
ভারতীয় হেজিমোনির মধ্যে শৃঙ্খলিত আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো সময় জুড়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল পুরোপুরি একপাক্ষিক। ধর্মীয় দিক থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হওয়া সত্বেও প্রতিনিয়ত বাঙালি মুসলমানদের কৃষ্টি, আচার, প্রথা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুধু উপেক্ষিতই ছিল না, পরিকল্পিতভাবে প্রায় অচ্ছুতের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও একজন শিল্পী গানের মঞ্চে, আবৃত্তির মঞ্চে টুপি পরে উঠতেন না, হিজাব পরে দাঁড়াতেন না, তারা ভয় পেতেন, কারণ এমন একটি সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছিল যে টুপি, হিজাব এগুলো হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রায়, মঞ্চের অনুষ্ঠানে কেউ কখনো মুসলিম সংস্কৃতির প্রতিকৃতি বহন করেনি, গজল, কাওয়ালি গায়নি। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান, জীবজন্তু ও দেব-দেবীর প্রতিকৃতি বহন করার প্রথা পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পছন্দকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তনই করেছেন একজন মুসলমান শাসক, মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, মির্জা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর।
সম্রাট যাকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন, তিনিও আরেক ভিনদেশী মুসলমান, পারস্যের নাগরিক, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ সৈয়দ মীর ফতহুল্লাহ শিরাজী। গত বছর নববর্ষের প্রাক্কালে আমি সর্বমঙ্গল শোভাযাত্রার কথা বলেছিলাম। মূল প্রতিবাদ্য ছিল দিবসটি যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। মঙ্গলের সঙ্গে সর্ব বিশেষণ যোগ করার কোনো দরকার হত না যদি মঙ্গলশোভাযাত্রা প্রকৃত অর্থে সর্ব সংস্কৃতির সমন্বয়ে হত। সব দুধ খাঁটি হলে আমাদের আর খাঁটি দুধ কথাটি বলার যেমন প্রয়োজন হয় না। বাজারে ভেজাল দুধ আছে বলেই চেঁচিয়ে বলতে হয়, আমার খাঁটি দুধ চাই।
ভাষা ও সংস্কৃতির শুদ্ধতা একটি ইউটোপিয়ান সমাজের ধারণার মত অসম্ভব ব্যাপার। জাতিগত শুদ্ধতাও সম্ভব নয়। ইউরোপীয়রা আর্য জাতির শুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য পনেরো লক্ষ রোমা জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে। লক্ষ লক্ষ রোমা নারীকে তারা জোর করে বন্ধ্যা করে দেয়। জার্মান নাৎসি বাহিনী একই লক্ষ্যে ষাট লক্ষ ইহুদি হত্যা করে। তাতে কি শুদ্ধতা নিশ্চিত হয়েছে? উগ্র হিন্দুবাদী মোদি সরকারের নেতারা মাঝে মধ্যেই মুসলিম নিধন করে ভারতকে শুদ্ধ করার হুমকি-ধামকি দেয়। জার্মানরা কি আর্য রক্তের শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে পেরেছে? ২০০১ সালে কসোভোর রোমা পল্লীতে আমি নিজে দেখেছি এক জার্মান পুরুষ রোমা নারীকে বিয়ে করে সংসার করছে। এখন তো মিক্স ম্যারেজ ইউরোপ-আমেরিকায় ভীষণভাবে সমাদ্রিত। বরং মিশ্রবর্ণের মানুষদের প্রতি বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণ আরো তীব্র। এখন বলা হচ্ছে মিশ্র জাতির ছেলে-মেয়েরা মানুষ হিসেবে উন্নততর।
ভাষা ও সংস্কৃতি হচ্ছে একটি প্রবহমান নদীর মত, ছুটে যেতে যেতে সে ধারণ করে দুই তীর থেকে গড়িয়ে পড়া পলি। উপ-মহাদেশে মালিক দিনার নামক একজন ইরাকী সাহাবা এসেছিলেন, তিনি কেরালায় একটি মসজিদ স্থাপন করেন, এটিই উপমহাদেশের প্রথম মসজিদ। ৭৪৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে সেই মসজিদেই তাকে সমাহিত করা হয়।
কাছাকাছি সময়ে মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সিন্ধু বিজয় এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের সুচনা করে। অষ্টম শতকেই বাংলায় ইসলাম প্রচারকদের আগমন ঘটে। ১২০৪ সালে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার শাসনকর্তা হন। সেই সময়ে বাংলা হয়ে ওঠে জান্নাতুল বালাদ। ত্রয়োদশ শতক থেকে ভারতবর্ষে মুসলমানদেরই জয় জয়কার ছিল। কুতুবউদ্দিন আইবেক, শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ, পরবর্তীতে ইব্রাহীম লোদীকে ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করে জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লির শাসন ক্ষমতায় চলে আসেন এবং মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৩৩০ বছর মুঘলরা শাসন করার পর ১৮৫৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষের দখল নেয়।
প্রায় ১১শ বছর ধরে পুরো ভারতবর্ষে, এবং অবশ্যই বাংলায়, মুসলমানদের একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই সংস্কৃতি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালি সংস্কৃতির শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে আজ যদি তাদেরকে সালামের বদলে আদাব, পাজামার বদলে ধুতি, পানির বদলে জল, গজলের বদলে রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাধ্য করা হয় তার পরিণাম কিছুতেই ভালো হতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ যেমন আমাদের, গজল-কাওয়ালীও আমাদের, ভজন, কীর্তনও আমাদের, পীর-ফকিরের মাজার আমাদের, বাউল গান আমাদের, পূজো-পার্বন আমাদের, ঈদ আমাদের, রোজা, ইফতার, সেহরি সবই আমাদের। প্রত্যেকে তার ধর্ম ও সংস্কৃতি নির্বিঘ্নে বুক ফুলিয়ে পালন করবে, কেউ কাউকে বাঁধা দেবে না, কটু কথা বলবে না। আমরা শুধু পরস্পরকে মেনে নেব না, ভালোবেসে ভিন্ন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান উপভোগ করবো, কারণ এর সবই আমাদের। অসাম্প্রদায়িকতার এই ন্যারেটিভ আমাদের তৈরি করতে হবে।
অসাম্প্রদায়িকতা আসলে কী জিনিস, এটা আগে ভালো করে বুঝতে হবে। ধর্মকে, বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের পুজো অর্চনা, দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি, নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদিকে বাতিল করে দিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা করা অসাম্প্রদায়িকতা নয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা হচ্ছে নিজের হৃদয়কে একটি সর্বগ্রাহ্য পাত্রে পরিণত করা, যাতে যে কোনো ধর্ম, যে কোনো মতবাদ, এমন কী নাস্তিক্যবাদকেও আমি সম্মান করতে পারি। এই জায়গাটিতে পৌঁছানোর জন্য উপযুক্ত ন্যারেটিভ আমাদের তৈরি করতে হবে। এই ন্যারেটিভ তৈরি করার প্রধান প্লাটফর্ম হচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ হতে পারে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রধান মঞ্চ। এই লক্ষ্যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ এখন সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়েছে, একটি অন্তর্ভুক্তিমুলক বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ পালনের মধ্য দিয়ে আমরা তা নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক। হলিসউড, নিউইয়র্ক।
দেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। আওয়ামী লীগমুক্ত মাঠ রাজনীতির প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন করে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলের আভাস মিলছে। মধ্যম ও পেছনের সারির রাজনৈতিক দলগুলো নতুন করে অবহেলা-অনাদরের শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অবশেষে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে – এমন একটা স্বস্তির আবহ যখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে, তখন রোহিঙ্গারা এ নিয়ে কী ভাবছে? তারা কি আশ্বস্ত হয়েছে যে তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে? বিশেষ করে যারা মিয়ানমার সরকারের যোগ্যতার সূচকে দেশে ফেরার জন্য ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হয়েছে
১১ ঘণ্টা আগেএকাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছরে আমরা একটি জনগোষ্ঠীকে জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে দিইনি। বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেছে।
১৪ ঘণ্টা আগেএযাবৎ দেশে যত এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের ৯৫ ভাগ নিজেদের স্ত্রী-সন্তানকে পরবর্তী এমপি বানাতে চেয়েছেন, অনেকেই এই প্রচেষ্টায় কামিয়াব হয়েছেন। দেশের ৯৮ ভাগ মন্ত্রী নিজেদের পোষ্যকে মন্ত্রী করার খায়েশ প্রকাশ করে গেছেন।
১ দিন আগে