খলিফা হাফতার বিপ্লবী না সিআইএ এজেন্ট?

ড. মুস্তাফা ফেতুরি
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪৪

লিবিয়ার যুদ্ধবাজ বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খলিফা হাফতার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন গাদ্দাফিবিরোধী লড়াই ও পরবর্তী সময়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু এবং লিবিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল দখলের জন্য। এখন আবার নতুন করে হাফতারের নাম সামনে এসেছে গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। এ কাজে সহযোগিতা করলে যুক্তরাষ্ট্র হাফতারকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

লিবীয় সেনাবাহিনীতে একসঙ্গে চাকরি করতেন গাদ্দাফি ও হাফতার। ১৯৬৯ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন শাসক ইদ্রিস আল সেনুসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন গাদ্দাফি। গাদ্দাফির ক্ষমতায় আসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল হাফতারের। এই অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত খলিফা হাফতার ছিলেন গাদ্দাফির খুবই ঘনিষ্ঠ।

বিভিন্ন সূত্রের খবর এবং হাফতারের সাক্ষাৎকার থেকে এটা স্পষ্ট, অনেক বছর ধরেই তিনি ছিলেন গাদ্দাফির একজন ভক্ত। লিবিয়ার দুটি উপজাতীয় গোত্রে দুজনের জন্ম। কিন্তু এটি তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার মূল কারণ ছিল না। বরং তাদের সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল আরব জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা চেতনার ঐক্য। গাদ্দাফি তার এই আদর্শ ও চেতনা গ্রহণ করেছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের কাছ থেকে। তরুণ বয়স থেকেই গাদ্দাফি ও হাফতার ছিলেন নাসেরের ভক্ত। সে সময় নাসের ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন আইকন।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে লিবিয়া মিসরকে যুদ্ধবিমান, মিসাইল, জ্বালানি তেল ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল। এমনকি হাফতার নিজেও এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। লিবীয় সেনাদের একটি গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে তিনি মিসরীয় বাহিনীর সফলভাবে সুয়েজ খাল পার হতে সহায়তা করেছিলেন সেই যুদ্ধে।

১৯৮৭ সালে প্রতিবেশী দেশ শাদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ৩০০ সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যসহ শাদের সেনাদের হাতে আটক হন হাফতার। সেখানে বন্দি থাকার সময়ই তিনি অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। এ খবর গাদ্দাফির কাছে পৌঁছার পর তিনি হাফতার ও তার সহযোগীদের মুক্ত করে দেশে ফেরত আনার কোনো উদ্যোগ নেননি।

আর এই সুযোগটি কাজে লাগায় গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় থাকা যুক্তরাষ্ট্র। তারা শাদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাফতার ও তার সহযোগী সেনাদের মুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ সময়ই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে হাফতারের।

আরব বিশ্বে ২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’ নামের গণআন্দোলনের সময় গাদ্দাফিবিরোধীদের সহায়তার নামে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে গাদ্দাফিবিরোধী এই লড়াইয়ে যোগ দেন হাফতার। ওই বছরের অক্টোবর মাসে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। এর মাধ্যমে গাদ্দাফির টানা ৪২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

এরপরই হাফতার নিজস্ব বাহিনী লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) সহায়তায় বেনগাজীসহ লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে সেখানে আলাদা প্রশাসন গড়ে তোলেন। রাশিয়া, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত হাফতারকে সব ধরনের সহায়তা দেয়। এতে শক্তিশালী হয়ে তিনি রাজধানী ত্রিপোলি দখল করে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টাও করেন। তবে তা ব্যর্থ হয় তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে।

খলিফা হাফতার লিবিয়াকে ঐক্যবদ্ধ একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দেশের পূর্বাঞ্চলের তেলের খনিগুলো দখল করে তেল বিক্রির মাধ্যমে আয় করছেন বিপুল অর্থ। সম্প্রতি তিনি তার দুই ছেলে সাদ্দাম ও খালেদকে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে (এলএনএ) কমান্ডার পদে নিয়োগ দিয়ে এলএনএকে জাতীয় সেনাবাহিনীতে একীভূত করার পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন।

এর মাধ্যমে হাফতার তার ক্ষমতার ভিতকে আরো শক্তিশালী করার পথ বেছে নিলেও ত্রিপোলিভিত্তিক জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার তার এই পদক্ষেপকে পূর্ব ও পশ্চিম লিবিয়াকে আগের মতো ঐক্যবদ্ধ করে একটি সরকারের অধীনে প্রশাসন পরিচালনার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন। এ সরকারের কর্মকর্তারা মনে করেন, হাফতার তার দুই ছেলেকে এলএনএর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে পূর্ব লিবিয়ায় পারিবারিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে রাখার পথ বেছে নিয়েছেন।

তবে হাফতারের দাবি, এলএনএকে আধুনিক একটি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘ভিশন ৩০’ নামে যে কর্মসূচি নিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের জন্যই দুই ছেলেকে এই বাহিনীতে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু ত্রিপোলিভিত্তিক প্রেসিডেন্সি কাউন্সিল হাফতারের এই উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, যুদ্ধবাজ হাফতারের এই পদক্ষেপ দেশকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার ২০১৫ সালের সমঝোতা চুক্তির পরিপন্থী।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, প্রায় ৮০ বছর বয়সি হাফতারের দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা পূরণ না হওয়ায় তিনি এখন তার পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছেন। তার মৃত্যুর পর যাতে পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, সে জন্যই নিজের ছেলেদের এলএনএতে নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু এর ফলে পশ্চিম লিবিয়ার কিছু অঞ্চলে তার প্রতি মানুষের যে সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল, সেটি হারাতে পারেন তিনি। হাফতারের বিরোধীদের অনেকেই তার বিরুদ্ধে পূর্ব লিবিয়ায় নির্যাতন-নিপীড়ন ও গুম-খুনের অভিযোগও এনেছেন। তারা বলছেন, এক ‘স্ট্রং ম্যান’কে বিদায় করে আরেক ‘স্ট্রূ ম্যান’-এর আবির্ভাব ঘটার জন্য লিবিয়ায় বিপ্লব হয়নি।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, হাফতারের ক্ষমতার মূল ভিত্তি হচ্ছে তার সাহস ও হিসাবনিকাশ করে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা। অদম্য সাহসের জোরেই তিনি অনেক বাধা পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছান। সিআইএর সঙ্গে খলিফা হাফতারের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কারণে অনেকেই তাকে সিআইএর একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেন।

তবে, হাফতারের সমর্থকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনের দিনগুলোয় হাফতারের সিআইএর সঙ্গে হাত মেলানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র যেমন চাইছিল গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে, হাফতারেরও লক্ষ্য ছিল সেটাই। ফলে হাফতার ও সিআইএর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পর লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে হাফতারকে যথেষ্ট সহায়তা করে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। অনেক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মনে করেন, ন্যাটো বাহিনীর সহায়তা ছাড়া বিদ্রোহীদের পক্ষে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা হাফতারের বাহিনীর পক্ষে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল দখল করা সম্ভব হতো না।

সাম্প্রতিক সময়ে হাফতার নতুন করে আলোচনায় এসেছেন আরো একটি কারণে। গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল, সেই তালিকায় লিবিয়ার নামও আছে। সম্প্রতি মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ১০ বছরের জন্য গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই উপত্যকাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিনোদন কেন্দ্র ও পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এ জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি হাফতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে পূর্ব লিবিয়ায় তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পুনর্বাসন করার জন্য।

বিনিময়ে তাকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের গ্রহণে রাজি হলে পূর্ব লিবিয়ার শাসক হিসেবে হাফতাকে বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি এই অঞ্চলের তেলখনিগুলোর ওপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে হাফতার ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছেন। হাফতারের পাশাপাশি লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের সঙ্গেও এই ইস্যুতে যোগাযোগ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন করা হলে ২০১১ সাল থেকে আটকে রাখা লিবিয়ার ৩০ বিলিয়ন ডলার ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দেবিবাহ যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, গাজার ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের কোনো ‘অপরাধ’-এর সঙ্গে যুক্ত হবে না লিবিয়া।

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত