Ad T1

শোনাও নতুন গান স্বাগত নববর্ষ ১৪৩২

সৈয়দ আবদাল আহমদ
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৪২
‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ আজ পহেলা বৈশাখ। আজ নববর্ষ। স্বাগত ১৪৩২।
বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও গর্বিত ঐতিহ্যের রূপময় ছটায় উদ্ভাসিত সর্বজনীন উৎসবের দিন আজ। আনন্দ-হিল্লোল, উচ্ছ্বাস-উষ্ণতায় দেশবাসী আবাহন করবে নতুন বছরকে। ‘নব আনন্দে জাগো আজি’। অর্থ-সঙ্গতি থাকুক আর না-ই থাকুক, সবার হৃদয়ে আজ রবীন্দ্র-নজরুলের সুর জেগে উঠবে— ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো....’ কিংবা ‘...ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’
বাংলা নববর্ষের শুভ এই দিনটি এবার উদ্‌যাপন করা হচ্ছে ভিন্ন আমেজে। বিগত পনের বছরের দুঃশাসন দূর হয়েছে। অন্ধকার সেই সময়ের গ্লানি, দুঃখ-বেদনা অসুন্দর ও অশুভকে ভুলে গিয়ে আমরা নতুন উদ্যমে ও প্রত্যয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। জুলাই বিপ্লবে আমাদের সামনের বৈষম্যহীন দেশ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে।
একটি ভিন্ন পরিবেশে আগত নতুন স্বপ্নের আবির ছড়ানো নববর্ষকে স্বাগত। বাংলা নববর্ষের শুভ এই দিনটি জনজোয়ারে প্রাণময় উৎসবে উদ্ভাসিত, হিল্লোলিত। যার যার সাধ্যমত আনন্দ আয়োজনে উজ্জ্বল, অন্যরকম একটা দিন পহেলা বৈশাখ। নতুন এই দিনটি পুরোনো সব ব্যর্থতা-গ্লানি, বঞ্চনা, দুঃখ-কষ্ট ও আবর্জনার জঞ্জাল সরিয়ে নতুন আশা, কর্মোদ্দীপনা, স্বপ্ন, প্রত্যয় ও প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার ডাক দিচ্ছে। নতুনের কেতন ওড়ানো বৈশাখ এসেছে নতুন সম্ভাবনা, প্রত্যাশা ও সমৃদ্ধি অর্জনের লড়াইয়ে জয়লাভের প্রতিশ্রুতি এবং প্রেরণা নিয়ে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বছরের কাছে মানুষের প্রত্যাশা তাই— ‘শোনাও নতুন গান’। বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ স্বস্তি আনুক দেশে। সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক, প্রগতির স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক— এসো হে বৈশাখ।’ আলোয় স্নিগ্ধ প্রশান্ত হোক সমাজÑ এ আহ্বান জানাচ্ছে বৈশাখ। ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাকÑএসো হে বৈশাখ।’
আজ ভোরে দিগন্তের তিমিরে সূর্যোদয়ের প্রথম রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে ওঠার সঙ্গে উৎসব-আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে দেখা যাবে সবাইকে। আজই সূচিত হবে বাংলা নববর্ষের জন্মক্ষণ। এখন থেকেই বৈশাখের সর্বজনীন উৎসব-আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতে দেখা যাবে সারাদেশ এবং সব বয়সের মানুষকে। শহরের রাস্তা ও উদ্যানে নামবে মানুষের ঢল। শুধু তা-ই নয়, শহর-নগর, গ্রাম-গ্রামান্তরÑ সর্বত্রই বইবে বর্ষবরণের প্রাণোচ্ছল উৎসব-তরঙ্গ। পীড়াদায়ক দাবদাহ তুচ্ছ করে, অস্বস্তি উপেক্ষা করে ভোর থেকে দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-গভীর রাত পর্যন্ত আজ চলবে বৈশাখ বরণ। দেখা যাবে কোথাও গান বাজছে, কোথাও মেলা বসেছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ঢাকের শব্দ, ঢোল, বাঁশি, নাগরদোলার শব্দ, পায়ে পায়ে উত্থিত ধূলিপুঞ্জের মধ্যে মানুষের গুঞ্জরণ-ধ্বনি, নাগরদোলায় ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে ভয়জাগানো কিছু শব্দ, শিশুর কলেরব উচ্ছ্বাস। বৈশাখী মেলায় রকমারি সম্ভার হাতের চুড়ি, কানের দুল, সুগন্ধি সাবান, হাওয়াই মিঠাই, চুলের ফিতা, নেইলপলিশ, রঙিন বেলুন, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, আম কাটার চাকু, জিলাপি, খৈ-বাতাসা, ঘরগেরস্থির দরকারি বস্তু... আরো কত কী!
আজ পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন। সংবাদপত্র অফিসও আজ বন্ধ থাকছে। ভোরেই সূচিত হয়ে যাবে বর্ণাঢ্য বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা। সংবাদপত্রগুলোর বিশেষ ক্রোড়পত্র থাকবে হাতে হাতে। রেডিও-টিভিতে গত রাত থেকেই প্রচার করছে বিশেষ বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা।
মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে তার সভাসদ আমীর ফতেহউল্লাহ খান শিরাজী প্রায় চারশ’ বছর আগে হিজরি সনের সঙ্গে মিল রেখে ফসলি সন হিসেবে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। শস্যভিত্তিক ঋতুকে সামনে রেখে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে প্রচলন করা হয়েছিল বাংলা সনের। তখনই বঙ্গাব্দের সূচনা হয় বৈশাখের প্রথম দিন থেকে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তা এই জনপদের মানুষের গর্বিত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। বৈশাখী উৎসব সংস্কৃতির অন্যতম সমৃদ্ধ এক উপাদানে পরিণত হয়েছে। বাংলা নববর্ষে হালখাতাই মুখ্য ছিল এককালে। তার সঙ্গে ছিল বৈশাখী মেলা। ছিল আরো কিছু উৎসব। ছিল কিছু আনন্দসম্ভার। এখনো হালখাতা আছে। ক্রমেই মুখ্য হয়ে উঠছে আনন্দ-উৎসব। নাচ, গান, মেলা, নতুন হালখাতা, মিষ্টিমুখ, বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রা, নতুন পাঞ্জাবি, শাড়ি, ফতুয়া কেনার ধুম, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, শুভ নববর্ষ জানানোর রেওয়াজ— উৎসবের নানা অনুষঙ্গে নববর্ষ উদ্‌যাপন নিত্যনতুন মাত্রিকতায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে চলেছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত- শিক্ষাবঞ্চিত— সব বয়সি মানুষের সর্বজনীন উৎসব হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে এই পার্বণ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। আমাদের সাহিত্যে, গানে, কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে বৈশাখী নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পহেলা বৈশাখের আজকের দিনটিকে তিনি বলেছেন মহামিলনের দিন।
বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানমালা
ছায়ানট
রমনা বটমূলে অন্যান্য বছরের মতো এবারও ছায়ানটের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নববর্ষ পহেলা বৈশাখের সূচনা হবে। ছায়ানটের পরিবেশনায় থাকছে ৯টি সম্মেলক ও ১২টি একক গান এবং তিনটি পাঠ। সব মিলিয়ে ছায়ানটের দেড় শতাধিক শিল্পী এ আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৪ এপ্রিল ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ভৈরবীতে রাগালাপ দিয়ে ছায়ানটের ১৪৩২ বঙ্গাব্দ বরণের সূচনা হবে। ছায়ানটের এবারের বার্তা— ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’ যথারীতি অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে নতুন আলো, প্রকৃতি এবং মানুষকে ভালোবাসবার গান, দেশপ্রেম-মানবপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। সব মিলিয়ে বাঙালি সমাজকে নিয়ে আলোর পথে মুক্তির পথযাত্রী হওয়ার আহ্বান থাকবে এবারের পরিবেশনায়। রমনা উদ্যান থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী এবারের আয়োজন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল (youtube.com/@chhayanautbd) ও ফেসবুক পেজে (facebook.com/chhayanautbd)। বিটিভিও সরাসরি সম্প্রচার করবে অনুষ্ঠানটি।
চারুকলার বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা
নববর্ষকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ পহেলা বৈশাখে সকাল নয়টায় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা বের করবে চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে। শোভাযাত্রায় পিস্টন বাঁশি, বাংলা ঢোল ও করনেট বাঁশি সহযোগে ত্রিশজন শিল্পীর সম্মিলিত বিন্যাসে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হবে। এর বাইরে চারুকলা অনুষদ থেকে আজ (রোববার) চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান করা হবে বিকাল তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। এতে চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অংশ নেবেন। এছাড়াও চারুকলার উদ্যোগে ২ বৈশাখ চারুকলার বকুলতলায় রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলা’ যাত্রাপালা পরিবেশিত হবে। নববর্ষের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে চারুকলার অভ্যন্তরে নাগরদোলা, চরকি, বায়োস্কোপ ও বৈশাখী খাবারের দোকান বসবে।
সুরের ধারা হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ এবার রবীন্দ্র সরোবরে
বিগত বছরগুলোর মতোই এবারও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চ্যানেল আই-সুরের ধারা হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ। বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে বরণ করতে ১৪ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন থাকবে। এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শিল্পীদের পাশাপাশি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীরাও অংশ নেবেন। থাকবে ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান। লোকজ মেলা। মেলায় থাকবে দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন। নাগরদোলা, লাঠি খেলাসহ দেশীয় নানা তৈজসপত্রের পসরা নিয়ে বসবেন দোকানিরা। অনুষ্ঠান সফল করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অনুষ্ঠানস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
শিল্পকলা একাডেমি
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ১৩-১৪ এপ্রিল নবপ্রাণ আন্দোলনের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, বাউল গান, নাটক ও প্রদর্শনী থাকবে।
বাংলা একাডেমি
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি নববর্ষ বক্তৃতা এবং সাতদিনব্যাপী বইয়ের আড়ং ও বৈশাখাী মেলার আয়োজন করেছে। ১৪ এপ্রিল বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চ প্রাঙ্গণে সকাল ৮টায় বর্ষবরণ সংগীতের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান সূচনা হবে। অনুষ্ঠানে নববর্ষ বক্তৃতায় বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তা হিসেবে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম এবং বক্তা হিসেবে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ উপস্থিত থাকবেন। বেলা ৯টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও বেলা ১১টায় সাতদিনব্যাপী বইয়ের আড়ং ও বৈশাখী মেলার উদ্বোধন করা হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাব
জাতীয় প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে সদস্যদের মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছে। এদিন সকাল ৮টা থেকে সদস্যদের মাঝে পরিবেশন করা হবে খই, মুড়ি, বাতাসা ও গুড়ের পায়েস। এছাড়াও দুপুরে নববর্ষের বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করেছে প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি প্রাঙ্গণে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে। এতে মুড়ি-মোয়া, মুড়ালি, কদমা ও বাতাসার পাশাপাশি দুপুরে বিশেষ খাবারের আয়োজন থাকছে। এতে থাকছে বিশেষ সংগীত পরিবেশনাও।
এছাড়াও ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নিজ নিজ অঙ্গনে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত