Ad T1

জন্মগত হৃদরোগ

অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট

ডা. সিয়াম আল ইসলাম
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৩: ২৫

কেস স্টাডি : আবিদ ও নুসরাত দম্পতির ছোট্ট মেয়ে নুহা এবার পাঁচ বছরে পা দিয়েছে। কিছুদিন ধরে নুসরাত লক্ষ করছেন তার মেয়ে অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করছে না। বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক মিনিট খেলেই আবার এসে বসে কিংবা শুয়ে পড়ছে। বন্ধু-বান্ধবরা ওকে ডাকাডাকি করেও আর খেলায় অংশগ্রহণ করাতে পারছে না। ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু না হলেও নুসরাতের মনে গেঁথে রইল।‌ কিছুদিন ধরে তিনি মেয়ের কর্মকাণ্ড মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে কিছুটা অস্বাভাবিকই লাগল। নুহার ছোটবেলা থেকেই মাঝেমধ্যে ঠান্ডাকাশি লেগে থাকত। সে জন্য শিশু ডাক্তারও কম দেখানো হয়নি। শিশু ডাক্তার দেখেশুনে অ্যান্টিবায়োটিকসহ আরো কিছু ওষুধ দিয়েছেন। বেশ কিছুদিন ভুগে আবার সুস্থও হয়ে গিয়েছে মেয়েটি। এভাবে কিছুদিন মেয়েকে লক্ষ করার পর ব্যাপারটা স্বামীকে জানালেন নুসরাত।‌ দুজন মিলে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলেন এ রকম উপসর্গ থাকলে শিশুটির জন্মগত হৃদরোগ থাকতে পারে। যেহেতু বারবার শিশুবিশেষজ্ঞ দেখানোর পরও হার্টের কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি, তাই তারা এবার একজন জন্মগত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। জন্মগত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ নুহাকে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ইসিজি এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফি করতে দিলেন। ইকোকার্ডওগ্রাফি রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক জানালেন যে তাদের মেয়ের হার্টে একটি ছিদ্র রয়েছে, যার নাম অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট বা ASD।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় এমন একটি জন্মগত হৃদরোগ, যা অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট বা ASD নামে পরিচিত। একজন সুস্থ মানুষের হৃৎপিণ্ডে চারটি প্রকোষ্ঠ বা চেম্বার থাকে। এগুলো হলো ডান অলিন্দ (রাইট অ্যাট্রিয়াম), ডান নিলয় (রাইট ভেন্ট্রিকল), বাম অলিন্দ (লেফট অ্যাট্রিয়াম) এবং বাম নিলয় (লেফট ভেন্ট্রিকল)। এই রোগে হৃৎপিণ্ডের ডান ও বাম অ্যাট্রিয়ামের মধ্যে প্রাচীর বা সেপ্টামে এক বা একাধিক ছিদ্র থাকে।

এ রোগের লক্ষণ

অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাস, ছোটবেলা থেকেই ঘন ঘন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে কাশি/ সর্দি লেগে থাকা, বয়সের তুলনায় ওজন না বাড়া। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চার বৃদ্ধির স্বাভাবিক থাকতে পারে। যেহেতু হার্টের অ্যাট্রিয়াম বা অলিন্দের রক্তচাপ কম, তাই এ রোগের লক্ষণগুলো সাধারণত একটু দেরিতে প্রকাশ পেয়ে থাকে। ছিদ্রটি বড় হলে জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পায়।‌ তবে মাঝারি বা ছোট ছিদ্রের ক্ষেত্রে চার-পাঁচ বছর বয়স কিংবা অনেক ক্ষেত্রে ৩০-৪০ বছর বয়সেও তা প্রকাশ পায়।

যেভাবে রোগ নির্ণয়

হার্টে ছিদ্র থাকলে রোগীর বুকে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে একটি বিশেষ শব্দ পাওয়া যায়, যা চিকিৎসা পরিভাষায় মার্মার নামে পরিচিত। কিন্তু ASD রোগীর ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মার্মার পাওয়া যায় না, তাই সাধারণ চিকিৎসকরা অনেক সময় ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে ASD নির্ণয়ে ব্যর্থ হন। বুকের এক্স-রে ইসিজি এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফি এই তিনটি মাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ASD নির্ণয় করা সম্ভব।

চিকিৎসা পদ্ধতি

ছোট ছিদ্রযুক্ত এএসডি (৩/৪ মিলিমিটার) সাধারণত নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে বড় ছিদ্রযুক্ত এএসডির ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

ক্যাথেটারভিত্তিক পদ্ধতি একটি বিশেষ বোতাম (সেপ্টাল অক্লুডার) ব্যবহার করে ছিদ্র বন্ধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো কাটাছেঁড়া প্রয়োজন পড়ে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই বোতাম জায়গা থেকে সরে গিয়ে হার্টের অন্য জায়গায় আটকে যেতে পারে, তখন গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় এবং জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হয়। যেসব : ASD-এর ছিদ্রের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ রিম থাকে না, তাদের ক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারি করে ছিদ্র বন্ধ করে দিতে হয়। ছিদ্র বন্ধ করার জন্য হৃৎপিণ্ডের চারপাশে আবরণী, যা পেরিকার্ডিয়াম নামে পরিচিত, তা ব্যবহার করা হয়। সার্জারি দুই ধরনের হয়ে থাকে, প্রথাগত (Conventional) এবং মিনিমালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি (MICS)। প্রথাগত অপারেশনে বুকের মাঝ বরাবর কাটা হয়, এতে একটু বেশি পরিমাণে ইনসিশন দিতে হয়। MICS ডান বগলে ছোট (৫ সেমি) ইনসিশন দিয়ে করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা খরচ একটু বেশি এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন সার্জনের প্রয়োজন হয়। কিছু ক্ষেত্রে অতি দ্রুত ছিদ্র বন্ধ করতে হবে। যদি দেখা যায় ফুসফুসের সিস্টোলিক রক্তচাপ (PASP) ৬০ মিলিমিটার মার্কারির চেয়ে বেশি, তাহলে অতি দ্রুত ছিদ্র বন্ধ করতে হবে।

চিকিৎসা না করালে

ASD আক্রান্ত শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে অপারেশন ছাড়াই দীর্ঘদিন সুস্থ থাকতে পারে। তাই অনেক অভিভাবক অপারেশনে আগ্রহী হন না। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর বয়সের মধ্যে যদি ছিদ্র আপনা আপনি বন্ধ না হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে অপারেশন বা বোতামের সাহায্যে ছিদ্র বন্ধ করা উচিত। তা না হলে ধীরে ধীরে ফুসফুসের রক্তচাপ বাড়তে থাকে এবং একসময় ফুসফুস স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তখন ছিদ্র বন্ধ করেও কোনো লাভ হয় না। এ ছাড়া হার্ট ফেইলিউর, নিয়মিত হৃৎস্পন্দন (Arrhythmia) এবং স্ট্রোক হতে পারে। প্রি স্কুল এজ অর্থাৎ স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই ASD-এর অপারেশন করে ফেলা উচিত।

লেখক : জন্মগত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

বিষয়:

হৃদরোগ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত