Ad T1

বিজয়লগ্নে তৌহিদের প্রাণ কেড়ে নেয় ঘাতকের বুলেট

আহসান কবীর, যশোর ও ওয়াজেদ খান ডবলু, কেশবপুর
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ০৮

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালানোর খবরে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা যখন আনন্দ মিছিলে, তখনো আশুলিয়ায় নির্বিচার গুলি ছুড়ে মানুষ হত্যায় মত্ত ছিল পুলিশ আর আ.লীগ অস্ত্রধারীরা। থানা চত্বরে আন্দোলনকারীদের কয়েকটি লাশ পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। লাশ উদ্ধারে ক্রলিং করে এগিয়ে যাওয়ার সময় তৌহিদুর রহমানের (২৮) প্রাণ কেড়ে নেয় ঘাতকের বুলেট।

যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভালুকঘর গ্রামের এই সন্তান যেন ভালুকের মতোই ছিলেন সাহসী। পুলিশের ছোড়া গুলি যেন তাকে বিদ্ধ না করতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছিলেন তৌহিদুর । সড়কের ডিভাইডারের অংশবিশেষ আর তেলের ড্রাম সামনে রেখে কয়েকজনের সঙ্গে ক্রলিং করে এগোচ্ছিলেন থানার দিকে। কিন্তু পেছন থেকে ছুটে আসা একটি উত্তপ্ত বুলেট পিঠে বিদ্ধ হয় তার। যা তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়।

ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় বসবাসরত বড় ভাই জাহিদ হাসান বলছিলেন, পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরাও সেদিন নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মেরেছে। বিশেষ করে বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-১৯ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের মার্কেটসহ আশপাশের বহুতল ভবনগুলো থেকে থেমে থেমে গুলি করা হচ্ছিল। এর একটি বিদ্ধ হয় তৌহিদুরের পিঠে।

স্থানীয় একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে জাহিদ নিশ্চিত হয়েছেন, তৌহিদুরের শরীরে বুলেট বিদ্ধ হয় ৫ আগস্ট বিকাল ৪টা ৩৭ মিনিটে। তবে পুলিশ, নাকি আওয়ামী ক্যাডারদের গুলিতে তৌহিদুরের মৃত্যু হয়, তা নিশ্চিত করতে পারেননি জাহিদ।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তৌহিদুরকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল কি না অথবা তিনি কত সময় জীবিত ছিলেন, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নন জাহিদ হাসান।

ভালুকঘর গ্রামের আব্দুল জব্বার মোল্লার স্ত্রী রাশিদা বেগমের ছয় সন্তানের চার সন্তানই মারা যান ভূমিষ্ট হওয়ার সময়। দুই ছেলে বেঁচে ছিলেন। তাদেরই একজন তৌহিদুর রহমান । আদরের সেই সন্তান হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে জীবন দিলেন।

অন্যজন জাহিদ হাসান ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে গিয়ে হাসিনার পেটোয়া বাহিনীর হামলায় গুরুতর আহত হন শাপলা চত্বরে। শ্রমিক নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পরের বছরই আশুলিয়া এলাকায় রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়েছিলেন এই যুবক। দীর্ঘ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়েছেন জাহিদ।

জব্বার মোল্লার বাড়িতে দারিদ্র্যের ছাপ। চাষাবাদের কোনো জমি নেই। জমি আছে সাকুল্যে সাড়ে ১০ কাঠা। পুরোটাই ভিটা। বাড়িতে মুরগি পালন করে সামান্য উপার্জন হতো। ঢাকায় চাকরি করা দুই ছেলের পাঠানো সামান্য টাকায় মূলত চলত জব্বার-রাশিদার সংসার। এখন এক ছেলের আয় বন্ধ হয়ে কষ্টের মধ্যে পড়েছেন তিনি।

আব্দুল জব্বার মোল্লা আমার দেশকে বলেন, ‘৫ আগস্ট ছেলের সঙ্গে কথা হয় দুপুর পর্যন্ত। বিজয় মিছিলে স্লোগানরত অবস্থায় সে বলছিলÑ আব্বা ভালো খবর আছে। আমরা জিতে গেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে।’ তখনো বুঝতে পারিনি বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না আমার ছেলে। তার লাশ আসবে অ্যাম্বুলেন্সে।’

জব্বার মোল্লা যখন এই কাহিনি বলছিলেন, তখন তার পাশে বসে ছিলেন স্ত্রী রাশিদা। তার চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছিল পানি। কোনো কথা বলার ভাষা তার ছিল না।

এক ছেলে শহীদ হওয়ায় কষ্ট বাড়বে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন জব্বার। ছেলেদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে গেলেও ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি আমার দেশকে বলেন, ‘আমার ছেলেরা কোনো অন্যায় করেনি। দেশকে জালেমমুক্ত করতে জীবন দিয়েছে তৌহিদুর। আর জাহিদ লড়েছে ইসলাম ও শ্রমিক অধিকার রক্ষায়। সে (জাহিদ) এখনো বেঁচে আছে। দরকার হলে শহীদ হবে। কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথানত করবে না।’

তৌহিদুর হত্যার ব্যাপারে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাহিদের রুজু করা মামলার আসামি ১১৯ জন। এদের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন। এর আগে আশুলিয়া থানায় একই অভিযোগে মামলা করেছেন তৌহিদুরের স্ত্রী নাসরিন আক্তার সাথীও।

প্রতিবেশী জিয়াউর রহমান গাজী ও আইয়ুব আলী জানান, জব্বার মোল্লা খুবই অভাবি কিন্তু সৎলোক। জব্বার ও তার দুই সন্তান খুবই ধর্মভীরু। তারা তাবলিগ জামাতের অনুসারী। জব্বার মোল্লা জানান, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নন। তবে ছেলে জাহিদের দাবি, তিনি বিএনপির সমর্থক।

ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় বসবাসরত জাহিদ হাসান জানান, ৫ আগস্ট সকাল থেকে অনেকবার ফোনে কথা হয়েছে ছোট ভাই তৌহিদুরের সঙ্গে। কিন্তু সাড়ে ৪টার পর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যায়নি। রাতে তৌহিদুরের ফোন রিসিভ করেন এক নারী। ওই নারী কোনোভাবে গুলিবিদ্ধ তৌহিদুরের ফোনসেটটি পেয়েছিলেন। তিনি জানান, তৌহিদুরের লাশ রয়েছে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করে যশোরের গ্রামের বাড়িতে আনা হয়।

শহীদ তৌহিদুর চাকরি করতেন সাভারে অবস্থিত ঢাকা ইপিজেড এক্সটেনশনের সিকেডিএল নামে একটি পোশাক কারখানায়। স্ত্রী ও আয়েশা নামে আড়াই বছর বয়সি একটি সন্তান রয়েছে তার। সন্তানসহ স্ত্রী সাথী এখন বসবাস করেন কুষ্টিয়ার মিরপুরে বাপের বাড়িতে।

জব্বার মোল্লা ও জাহিদ হাসান জানান, তৌহিদুরকে শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, জেলা প্রশাসন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। কিন্তু সহযোগিতার বড় অংশ পাচ্ছেন তৌহিদুরের স্ত্রী সাথী। এতে কোনো আপত্তি না তুললেও জব্বার ও জাহিদ তাদের পরিবারের প্রতিও দৃষ্টি রাখার আবেদন করেন সংশ্লিষ্টদের কাছে।

Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত