২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি। বিডিআর ম্যাসাকারের ঠিক আগে ও ঘটনার সময় চলছিল এক রহস্যময় নীরব যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ অস্ত্রের ছিল না, ছিল সিগন্যালের— মোবাইল নেটওয়ার্কের, কল রেকর্ডের, ডাটা মুছে ফেলার, ট্র্যাকিংয়ের ও বিদেশ থেকে আসা অদৃশ্য নির্দেশনার।
পিলখানায় সংঘটিত বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। তাতে ওঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্রোহের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরের কলরেকর্ড বিশ্লেষণে ভয়ঙ্কর এক ধারাবাহিকতা ওঠে আসে। ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় বিকালে সিঙ্গাপুরের +৬৫ ৮১৫৫৫৬৪৮ নম্বর থেকে বেশ কয়েকবার তোরাব আলীর ফোনে কল আসে। এর মধ্যে একবার রিসিভ করে তোরাব আলী কথা বলেন প্রায় পাঁচ মিনিট। পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা থেকে ১১টা ৩৪ মিনিটের মধ্যে ভারতীয় নম্বর +৯১৯৮৬২৬৭৬০৫৮ থেকে ফোন আসে। একাধিকবার যোগাযোগ হয়, কথা হয় চার মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। বিকাল চারটা ১৭ মিনিটে একই ভারতীয় নম্বর থেকে আবার কল আসে, সেবার তিনি প্রায় এক মিনিট কথা বলেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর দুটার দিকে আগের সিঙ্গাপুরের নম্বর থেকে আবার কল আসে, কথা হয় এক মিনিটের কিছু বেশি সময়। ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর একটার দিকে একই নম্বর থেকে ফোন আসে, কথা হয় ৪৩ সেকেন্ড। সবচেয়ে অস্বাভাবিক তথ্যটি হলো—জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৬ মার্চ ২০০৯ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাড়া তোরাব আলীর মোবাইলে সিঙ্গাপুর বা ভারত থেকে আর কোনো কল আসেনি এবং তিনিও সেসব জায়গায় কোনো কল করেননি। কিন্তু তিনি জীবিত থাকাবস্থায় তাকে এই বিদেশি কলগুলোর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো পূর্ববর্তী তদন্ত কমিটিই উদঘাটন করেনি—কারা ওই নম্বরের পেছনে ছিল, কী কথা হয়েছিল। এ অদৃশ্য যোগাযোগের সময়েই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থার ভেতরে চলছিল আরেক গোপন তৎপরতা।
কমিশন সেনাবাহিনী, এএফডি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ সদর দপ্তর এবং র্যাবের কাছে কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মোবাইল নম্বর চেয়েছিল। পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরও চাওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মকর্তাদের নম্বর দিতে পারেনি।
২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিজিএফআই কার্যালয়ে স্থাপিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোরশেদ আলম মোবাইল নেটওয়ার্ক মনিটর করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল বা সন্ধ্যায় লে. কর্নেল সুলতানুজ্জামান সালেহ (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকের নির্দেশে ওই মনিটরিং সেলের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং দীর্ঘ সময় মনিটরিং কার্যক্রমে অংশ নেন। একই দিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোরশেদ আলম ডিজির মৃত্যুর সংবাদ পান এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা ডিজি, ডিজিএফআইকে অবহিত করেন।
এ সময়ের আরেকটি ভয়ংকর দিক উঠে আসে সিটিসেলের ভেতর থেকে। সিটিসেলের টেকনিক্যাল হেড ছিলেন তানভীর রানা। সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, তিনি নেটওয়ার্ক বন্ধ করা এবং ডেটা মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, অন্য কারো নির্দেশেই তিনি তা করেছিলেন। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে থাকায় এ ব্যাপারে তার সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে মোবাইল মনিটরিং হয়েছে, আবার নির্দিষ্ট কিছু সময়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই নেটওয়ার্ক কখন, কীভাবে, কত সময় বন্ধ রাখা হয়েছিল—এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন দিতে পারেনি।
সবচেয়ে রহস্যময় অধ্যায় হলো কল রেকর্ডগুলো। কল রেকর্ড ডিলিট করা হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও বিদেশি যোগাযোগ সংক্রান্ত সব কল রেকর্ড মুছে ফেলা হয়। ২০০৯ সালে গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিটি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়ে কল রেকর্ড চাইলেও সেনাসদর, ডিজিএফআই ও বিটিআরসি কেউই তা দেয়নি। সবাই ‘প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার’ অজুহাত দেয়। সেকেন্ডারি সোর্স থেকে কিছু কল রেকর্ড পাওয়া গেলেও সেখানে শুধু বিডিআর ও র্যাব সদস্যদের নম্বর ছিল— কোনো রাজনৈতিক বা গোয়েন্দা সংস্থার নম্বর সেখানে ছিল না।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু জুনিয়র অফিসার নিজেদের উদ্যোগে যেসব সিডিআর উদ্ধার করে ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করেছিলেন, সেগুলো থেকেই কমিশন ভয়ংকর কিছু তথ্য উদ্ধার করে। ভারত থেকে কিছু ফোন নম্বরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সিঙ্গাপুর থেকেও বিদ্রোহীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়েছে।
বিদ্রোহীদের সঙ্গে সাহারা খাতুন, ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, এটিএন বাংলার সাংবাদিক এস এম বাবুসহ অন্যরা ঘটনার সময় এবং ঘটনার আগেও কথা বলেছেন— এমন স্বীকারোক্তি ও সাক্ষ্যও পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিদ্রোহীদের একজন ডিএডি তৌহিদের মধ্যে যোগাযোগের তথ্যও পাওয়া গেছে। সাক্ষ্যে উঠে এসেছে—সাবেক ডিজি বিডিআর ও বিডিআরে কর্মরত অফিসাররা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রায় সব স্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
এত কিছুর মাঝেও বিদ্রোহের ভেতরে কাজ করছিল একটি অদৃশ্য কাঠামো—একটি সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বিদ্রোহীদের মধ্যে সিগন্যাল কন্ট্রোলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল, ভেতরে এক ধরনের কমান্ড সেন্টার কাজ করছিল।
মোবাইল কল ট্র্যাক করে ধরে ধরে অফিসারদের অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছিল—এমন সাক্ষ্যও পাওয়া গেছে।
সবশেষে সবচেয়ে গুরুতর তথ্যটি হলো—সেনা তদন্ত আদালত এবং জাতীয় তদন্ত কমিটি কেউই মোবাইল কল রেকর্ড বা সিডিআর সংগ্রহ করেনি এবং এ বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা করা থেকে সচেতনভাবেই বিরত থেকেছে।


লেবাননে ইসরাইলের ভয়াবহ বিমান হামলা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন বনাম ঐক্য