মাহমুদুর রহমান
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই অনভিপ্রেত বিতর্ককে কেন্দ্র করে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ মিলিতভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়িয়ে দেশে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টিরও অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল, বিজেপির সমর্থক, ইংরেজি ভাষার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন, ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় ২৭ মার্চ ২০২৫ তারিখে সুবির ভৌমিক নামের একজন কট্টর বাংলাদেশবিদ্বেষী সাংবাদিক, যিনি একসময় বিবিসিতেও কাজ করেছেন, ‘What’s on Bangladesh Army Chief’s mind?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধে সংবিধান বিশেষজ্ঞের দাবিদার, হাইকোর্টের আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী, তানিয়া আমীর সরাসরি প্রচ্ছন্ন সেনা অভ্যুত্থানের উসকানি দিয়ে বলেছেন, ‘The general can firmly back President Shahabuddin Chuppu to declare an emergency using article 141. The President can dismiss the interim government and set up a new team to hold early and inclusive elections.’ (Subir Bhaumik, “What’s on Bangladesh Army chief’s mind?” India Today, March 27, 2025, https://www.indiatoday.in) সুবির ভৌমিকের লেখা এবং তানিয়া আমীরের মন্তব্যে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া অনুচিত হবে। আমার বিশ্বাস, সেনাবাহিনীর কিছু সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আন্তরিকভাবে ড. ইউনূস সরকারের সাফল্য দেখতে চান।
বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভারতীয় আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না, যাতে করে জনগণ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে কোনো ধরনের দূরত্ব অথবা ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত, সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ কোনো একপক্ষীয় বিষয় নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমরা সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ যেমন দেখেছি, তেমনি রাজনীতিবিদরাও সেনাবাহিনীকে আপন স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতার পরপরই রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনীতিবিদরাই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ শুরু করেছিলেন।
পরে আমরা সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে দেখেছি। পক্ষান্তরে, রাজনীতিবিদরাও বেআইনি ও অনৈতিকভাবে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার হীন প্রচেষ্টায় সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে, ডিজিএফআইকে ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য, পনেরো বছরের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনকালে সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী অফিসারদের অনৈতিকভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে চরমভাবে বিতর্কিত করা হলেও, ভারতে পলাতক ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ও তার আদর্শিক সহযোগীরাই অতীতে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত থেকেছেন। শেখ হাসিনা এবং তার দল, জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপিকে সর্বদা ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠিত দল বলে অভিহিত করে বিদ্রুপ করেছে।
আজকের এই সেমিনারে একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে নির্মোহভাবে আমি, গত পাঁচ দশকে রাজনীতিবিদ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনা কর্মকর্তাদের একে অন্যকে ব্যবহার করার ইতিহাস বর্ণনা করার ইচ্ছা রাখি। এই নিবন্ধের প্রথম অংশে আমি বিগত পঞ্চাশ বছরের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, দ্বিতীয় ভাগে সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করার পন্থা প্রস্তাব করব।
আমি এই প্রত্যাশা করি না যে, সবাই আমার ইতিহাস ব্যাখ্যা এবং আজকের প্রস্তাবনার ব্যাপারে সহমত পোষণ করবেন। তবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকর উন্নতি করতে হলে, সব স্টেকহোল্ডারের খোলা মন নিয়ে সামরিক বাহিনী এবং দেশের জনগণের ঐক্য নিশ্চিত করার পন্থা নিয়ে সুস্থ বিতর্ক করা আবশ্যক। আমি আশা করি, সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এই সেমিনার থেকেই শুরু হবে এবং আমরা এমন একটি সর্বসম্মত ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে সক্ষম হব, যাতে করে সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক সরকারের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ পেশাদার সম্পর্ক নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যকার টানাপড়েন : দশক ওয়ারী বিশ্লেষণ
১৯৭২-১৯৮০ : স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শাসক শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীকে বিশেষ প্রীতির চোখে দেখতেন না। এর একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ছিল। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে ১৪ বছর দেশটি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সেনাশাসনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছিল। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আইউব খান সেনাশাসনের সূচনা করেন, যেটা জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে শোচনীয় পরাজয় ঘটলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাশাপাশি খণ্ডিত পশ্চিম পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সরিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হন।
পাকিস্তানে আবার ১৯৭৭ সালে এবং ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে জেনারেল জিয়াউল হক এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সামরিক শাসন জারি করেন। শেখ মুজিব পাকিস্তানি আমলের সেনাশাসনের সেই ট্রমা থেকে বের হতে না পারার কারণে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকেও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। তা ছাড়া, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার যে দায়িত্ব শেখ মুজিবের ছিল, সেটি তার পরিবর্তে একজন মেজর, জিয়াউর রহমান পালন করায় সম্ভবত তিনি এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব তার সাংবাদিক বন্ধু অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে বলেছিলেন যে তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী গঠন করতে চান না। ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন, “Sheikh Mujib himself told me in February, that he was against a powerful military force, ‘I don’t want to create another monster like the one we had in Pakistan” (For further study read, Mascarenhas, N. A., “Bangladesh: A Legacy of Blood”, Hodder and Stoughton, January 1, 1986)
১৯৭২ সালেই শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীকে হীনবল করার উদ্দেশ্যে ভারতের সহায়তায় আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনৈতিক চেতনাবিশিষ্ট প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন, যাতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত মেজর জেনারেল এস এস উবানকে প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এই জেনারেল উবানই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, যাতে করে তারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দেশ থেকে চীনপন্থি বাম ও ইসলামপন্থি ডান রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূল করতে পারে।
ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টারা শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনাক্রমে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ-সংবলিত, প্যারা মিলিটারি বাহিনী গঠনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর, ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দিয়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনী আইন, ১৯৭২ (President’s Order No. 21 of 1972) জারি করা হয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুজ্জামানকে প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রধান করে তোফায়েল আহমেদকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে এই বাহিনী সরাসরি পরিচালনা করা হতো। (Ahmed Moudud, “Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman”, The University Press Limited, Bangladesh, 1983) বাংলাদেশে রক্ষীবাহিনীই প্রথম গুম-খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়ংকর নজির স্থাপন করেছিল। সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ শেখ মুজিবই শুরু করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদলীয় বাকশাল সরকারের পতন এবং ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের ৭২ ঘণ্টার ক্যু দেতার পরাজয় ঘটলে সেনাপ্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের সর্বাধিক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশের পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমে ১৯৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাগোদল গঠন করেন। তিনি সরাসরি জাস্টিস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত না হলেও তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাদের অধিকাংশই জাগোদলের সদস্য ছিলেন।
১৯৭৮ সালের ১ মে, জাগোদল, ভাসানী ন্যাপ, মুসলিম লীগ, কাজী জাফরের ইউপিপি, মাওলানা মতিনের লেবার পার্টি এবং রসরাজ মণ্ডলের তফসিল জাতি ফেডারেশন নিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয়। জিয়াউর রহমান নবগঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ৩ জুনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে বিপুল ব্যবধানে (৭৭-২২%) পরাজিত করেন। একই বছর ১ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জন্ম নেয়।
সরকারে অধিষ্ঠিত থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক দল গঠন করার কারণে আওয়ামী লীগ সর্বদাই অভিযোগ করে থাকে যে, বিএনপি গঠনে সে সময় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমি বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ সেনা অফিসারদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি যে, বিএনপি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর জেনারেল মাজিদুল হক, লে. কর্নেল আকবর এবং লে. কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও তারা সবাই তখন অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন। জিয়াউর রহমান কর্মরত কোনো সেনা কর্মকর্তাকে দল গঠনে ব্যবহার করেছেন বলে সরাসরি কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, সে সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর নাম বিএনপি গঠনের সঙ্গে বিশেষভাবে উচ্চারিত হতো। বিএনপি ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হলেও আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা দলটিকে ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠিত বলে অভিযোগ করে থাকেন।
সুতরাং, আশির দশক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে রাজনীতিকরণ করেছিলেন। অন্যদিকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এবং বিএনপি গঠনে এস্টাবলিশমেন্ট এবং সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
১৯৮১-১৯৯০
১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে মেজর জেনারেল আবুল মনজুরের নেতৃত্বে সেনা অফিসারদের একাংশের বিদ্রোহে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্যু দেতার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হলে সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাত্তার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পরে একই বছরের ১৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপিদলীয় প্রার্থী জাস্টিস সাত্তার ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার কামাল হোসেনকে পরাজিত করেন। কিন্তু ততদিনে বিএনপির মধ্যে কোন্দল দেখা দিলে সেই সুযোগ নিয়ে নির্বাচনের মাত্র চার মাস অতিক্রান্ত হতেই জেনারেল এরশাদ ২৪ মার্চ ১৯৮২ তারিখে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই ক্যু দেতা নীতিবিবর্জিত রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে এক উচ্চাভিলাষী জেনারেলের ক্ষমতা দখলের এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ। (Ahsan, B. S, “The coup d’etat of March 1982”, Dhaka Tribune, 21 March, 2024. https://www.dhakatribune.com)
ক্ষমতা দখলের ২০ মাসের মাথায় চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এরশাদ সামরিক বাহিনী, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের সহায়তায় তার রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রথমে ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর পুতুল প্রেসিডেন্ট আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে কনভেনর এবং সাবেক বিএনপি নেতা ও মন্ত্রী এম এ মতিনকে সাধারণ সম্পাদক করে জনদল গঠন করা হয়। এরপর জনদল বিলুপ্ত হয়ে বিএনপির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় ফ্রন্ট জন্মগ্রহণ করে।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় ফ্রন্টকে বিলুপ্ত করে জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং দলের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে, বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে এরশাদের অধীনে বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ১৫৩ এবং ৭৬ আসন লাভ করে। বিতর্কিত নির্বাচনের প্রতিবাদে শিগগিরই দেশজুড়ে তীব্র গণবিক্ষোভ শুরু হয়। এরশাদ ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ডিসেম্বরে সংসদ ভেঙে দেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট এরশাদ আর একটি প্রহসনমূলক, ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন, যেটা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল বর্জন করে। (“Ruling Party is declared the winner in Bangladesh”, The New York Times, March 6, 1988. https://www.nytimes.com)
মূলত ১৯৮৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পরই জেনারেল এরশাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। যদিও জেনারেল এরশাদের ক্যু থেকে শুরু করে তার পুরো শাসনকালেই সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ব্যাপক অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু তার পতনের সময় সামরিক বাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদ সামরিক বাহিনীকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান দমনে ব্যবহার করতে চাইলে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দিন আহমেদ অপারগতা প্রকাশ করেন এবং সেনাবাহিনীর জনগণের পক্ষ গ্রহণের কথা জানিয়ে দেন। উপায়ন্তর না পেয়ে এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরশাদের পুরো শাসনকাল উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা এবং নীতিহীন ও সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদদের এক অশুভ যোগের কাল (Period of Military-Politician nexus) হিসেবে বিবেচিত।
১৯৯১-২০০০
এই দশকটি বাংলাদেশে একটি নির্ভেজাল এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের দশক রূপে বিবেচিত হতে পারে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যথাক্রমে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে তার পরাজয়ের জন্য দোষারোপের চেষ্টা করলেও সেই অসত্য অভিযোগ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার, কৃষ্ণন শ্রীনিবাসনও শেখ হাসিনার অভিযোগ নাকচ করে দেন। (For further reading, Srinivasan, K, “The Jamdani Revolution: Politics, Personalities and Civil Society in Bangladesh 1989-1992”, Har Anand Publications Pvt Ltd, New Delhi, 30 August 2008)
তবে, নব্বইয়ের পুরো দশক বাংলাদেশে একেবারে নিরুপদ্রব যায়নি। বিশেষ করে দুটি ঘটনা এই গণতান্ত্রিক দশককেও কলঙ্কিত করেছে। ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সব বিরোধী দলের বর্জনের মুখে বিএনপি সরকার একটি একদলীয় এবং প্রচণ্ড সহিংস নির্বাচনের আয়োজন করে। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সেই বিতর্কিত সংসদ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী হলেও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বিএনপির সংসদ সদস্যরা করে যেতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় বিপজ্জনক ঘটনাটির জন্য উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা এবং হঠকারী রাজনীতিবিদরা দায়ী ছিলেন। আওয়ামী লীগের ইন্ধনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম কিছু আওয়ামী লীগ সমর্থক অফিসারদের নিয়ে ক্যু দেতার চেষ্টা করেন। দেশপ্রেমিক সামরিক অফিসারদের বাধায় জেনারেল নাসিমের ক্যু ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহী সেনাপ্রধানকে চাকরিচ্যুত করা হলেও বিস্ময়করভাবে, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে কখনো তাকে বিচার করা হয়নি।
২০০১-২০১০
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং তাৎপর্যপূর্ণ। পনেরো বছরের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটে ২৭ অক্টোবর ২০০৬। ইন্দো-মার্কিন পরিকল্পনায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এক নতুন ধরনের সেনাশাসনের যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করে। শুধু যে দেশটির গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে তাই নয়, সেই সঙ্গে সার্বভৌমত্ব বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ প্রকৃতপক্ষে দিল্লির বশ্যতাও মেনে নেন। (For details please read, Mukherjee, P. “The Coalition Years: 1996-2012”, Rupa Publications, India, February 1, 2016) ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির পরামর্শে দেশের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে জেতানোর জন্য জেনারেল মইন সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে ডিজিএফআইকে সরাসরি ব্যবহার করেন।
নির্বাচনের আগে বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য ডিজিএফআইয়ের দুই প্রভাবশালী অফিসার ব্রিগেডিয়ার বারী এবং মেজর জেনারেল আমিন (তখন ব্রিগেডিয়ার) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনকালীন সময়ে আওয়ামী লীগকে জেতাতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (তখন ব্রিগেডিয়ার) মামুন খালেদ। অবশ্য, আমি মনে করি, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পেশাদারিত্বের অবক্ষয় বিএনপি আমলেই বিশেষ পুলিশ ইউনিট র্যাব (RAB)-এ পদায়নের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিস্ময়কর বিজয়ের নেপথ্যে ডিজিএফআই এবং ভারত যৌথভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের পর মাত্র ছয় সপ্তাহ অতিক্রান্ত হতেই পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে এক রহস্যময় সৈনিক বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন র্যাংকের ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সৈনিক বিদ্রোহের সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন পরিবারের একাধিক প্রভাবশালী সদস্যসহ (শেখ সেলিম এবং শেখ তাপস) শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত থাকলেও আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বিভিন্ন পর্যায়ের যেসব সাহসী সামরিক অফিসার বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদেরই চাকরিচ্যুতিসহ ভুয়া অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়।
একই সময় সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ভারত কর্তৃক সেনা অভিযান চালানোরও হুমকি দেওয়া হয়। পিলখানা ম্যাসাকারকে ব্যবহার করেই শেখ হাসিনা এবং ভারত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ফলে ২০১০ সালের নভেম্বরে খালেদা জিয়াকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বৈধ বাসস্থান থেকে অমানবিকভাবে উচ্ছেদ করা হলেও সেনাপ্রধান জেনারেল মুবিন এবং অন্যান্য সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তারা সেই অন্যায় কাজে সহযোগিতা করেন অথবা নীরব থাকেন।
ততদিনে ডিজিএফআই এবং র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটে গুম ও নির্যাতনের জন্য আয়নাঘর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই নিবন্ধের লেখককেও ঢাকা বিমানবন্দরের উল্টোদিকে অবস্থিত র্যাব-১-এর আয়নাঘরে জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতনের জন্য মিন্টো রোডের ডিবি অফিস থেকে আইনবহির্ভূতভাবে আনা হয়েছিল। (For details Read, Rahman, M, “Jel theke Jel-e”, Anannya, January 1, 2012)
(চলবে)
বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে ভারত দেখছে রেডলাইন অতিক্রম হিসেবে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বাংলাদেশের কার্যত কোনো পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। এ সময় বাংলাদেশের অবস্থান শুধু ভারতের পক্ষপুটে ছিল না, দিল্লির পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি অনুসরণ করেছে ঢাকা।
৪ ঘণ্টা আগে‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’—নবকুমারের উদ্দেশে বলা কপালকুণ্ডলার এই উক্তি শোনেননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি নেই। এর বহুবিধ ব্যবহার আমাদের কাছে অতিপরিচিত। জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কাজ-কারবার দেখেও সেই পুরোনো প্রশ্নই মনে জাগে।
৪ ঘণ্টা আগেবিশ্ব অর্থনীতি আজ যে কটি বড় ও শক্তিশালী সেক্টরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্যতম হলো কেমিক্যাল সেক্টর। বৈশ্বিক কেমিক্যাল বাজারের মাত্র দুই শতাংশ দখল করলেই বাংলাদেশ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে এই সেক্টর থেকে। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি মাস্টার প্ল্যান, যেখানে থাকবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
৪ ঘণ্টা আগেনেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘যেকোনো সমাজকে সত্যিকারভাবে চেনা যায় দুর্বল সদস্যদের প্রতি তাদের ব্যবহার দেখে।’ সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের কারণে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ভারতের প্রশংসা করেছে। কিন্তু এখন তাদের বাঁক ঘুরছে।
১ দিন আগে