যেকোনো নির্বাচন ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যিকার অর্থে জনমতের প্রতিফলনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের আবর্তন ও বিবর্তন থেকে নানা ধরনের প্রথা ও পদ্ধতির উৎপত্তি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি অনুসৃত পদ্ধতিটির নাম সংখ্যাগরিষ্ঠতা পদ্ধতি, আসন পদ্ধতি বা আঞ্চলিক পদ্ধতি। এই ব্যবস্থায় যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন। তার বিপরীতে অন্যান্য প্রার্থীর ভোট বেশি হলেও তিনি বিধি মোতাবেক জনগণের রায় পেয়েছেন বলে বৈধতা লাভ করেন। এজন্য অনেকে এই নির্বাচন ব্যবস্থাকে ‘First Pass the Post–FPTP’ বলে অভিহিত করা হয়। সহজ বাংলায় বোঝার জন্য ‘প্রথম হয়ে জেতা’ বা ‘প্রথম নিশানা অতিক্রমকারী’ বলে অভিহিত করা যায়। এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সব কর্তৃত্বের মালিক-মোক্তার হয়ে বসেন। যেহেতু বিজয়ী সবকিছু নিয়ে নেয়, সেজন্য সমালোচকরা এটিকে ‘Winner takes all’ বা সবকিছুর মালিক একজন—এ ধরনের সমালোচনা করে থাকেন। এভাবে এই ব্যবস্থায় সামান্য কিছু বেশি ভোট পেয়ে সারা দেশে একটি দল ক্ষমতা লাভ করে। একটি নির্বাচনী এলাকায় এক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছে—এদেশে এরকম উদাহরণও বিরল নয়। অথচ তার সব প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোট একত্র করলে বড় ধরনের অস্বাভাবিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা বাংলাদেশে বা অন্যত্র একক প্রাধান্যশীল হয়ে থাকে। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল সাংবিধানিকভাবেই ন্যায্যতা অর্জন করে। ব্রিটেনে বলা হয়, ‘His/Her majesty’s opposition’ সরকার, যেমন রাজা বা রানির, বিরোধী দলও তার কর্তৃত্বের অংশ। উন্নত গণতন্ত্রে বিধিবদ্ধ নিয়মকানুনের চেয়ে অনুসৃত রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি সতত-স্বাভাবিক আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে আমাদের মতো রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যেখানে গণতন্ত্র এখনো সমাজের গহিন-গভীরে প্রোথিত হয়নি, সেখানে আইন বা সাংবিধানিক বিধিবদ্ধতা দ্বারাও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এভাবেই বাংলাদেশের মতো সংসদীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও স্বৈরাচারের উদ্ভব ঘটে। বিগত ১৫ বছরে তার একটি প্রামাণ্য সমীক্ষা আপনারা দেখেছেন। এই দলীয় স্বৈরাচার বেপরোয়াভাবে দেশ শাসন করে। আর ব্যক্তিটি যদি হয় বিকারগ্রস্ত, তাহলে আমরা তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে পারি—বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্র (Perverted individual dictatorship)।
বাংলাদেশ যেহেতু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির উত্তরাধিকার বহন করে, সেহেতু ব্রিটেন অনুসৃত নির্বাচন পদ্ধতি আমাদের ওপর বর্তায়। ১৯৩৫ সাল থেকে কার্যকরভাবে আসনভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক ব্যবস্থাটির অনুশীলন এই অঞ্চলে হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে অর্জিত স্বাধীনতার পরও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভিন্ন কিছু চিন্তা করেনি। বাংলাদেশে এখন যে নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল আছে, তা আসন বা অঞ্চলভিত্তিক। এটি গোটা দেশকে সংবিধান-নির্দেশিত সংখ্যা মোতাবেক ভাগ করা হয়। একে বলা হয় নির্বাচনী এলাকা (Constituency)। এর সপক্ষে বড় যুক্তি হলো—(ক) সহজ ও সরল প্রক্রিয়া, এই পদ্ধতিটি সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। প্রতিটি ভোটার একটি ভোট দেয় এবং যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পায়, সে নির্বাচিত হয়। (খ) ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ। এর মাধ্যমে দেশের সব ভৌগোলিক অংশের প্রতিনিধিত্ব সমহারে নিশ্চিত হয়। (গ) দীর্ঘকাল ধরে এভাবে নির্বাচন হওয়ায় এই অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে। (ঘ) এই পদ্ধতিতে দ্রুত ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব। ভোট গণনাও সহজ ও দ্রুত হয়। নির্বাচন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল জানা যায়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। (ঙ) অঞ্চলভিত্তিক প্রার্থিতা ওই অঞ্চলের জনগণের চেনা-জানা বা নিকটবর্তী ব্যক্তিকে ভোট দেয়, ফলে তার সঙ্গে জনগণের সংযোগ ও ঘনিষ্ঠতা থাকে। অন্য কোনো ব্যবস্থায় এই ঘনিষ্ঠতা বা নৈকট্য সম্ভব নয়। (চ) আসন ব্যবস্থার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের প্রতিফলন ঘটে। (ছ) আসনভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থায় সাধারণত কয়েকটি বড় দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে, কারণ ছোট দলগুলোর পক্ষে এ পদ্ধতিতে আসন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে দুই বা তিনটি প্রধান দল ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে এগিয়ে থাকে, যা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করে। (জ) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতিতে অনেক ছোট দল সংসদে প্রবেশের সুযোগ পায়, যার ফলে প্রায়ই জোট সরকার গঠিত হয়, যা অনেক সময় দুর্বল ও অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু আসনভিত্তিক (FPTP) নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি দল সহজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে, ফলে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার গঠন করা সম্ভব হয়। (ঝ) আসনভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থায় (FPTP) কট্টরপন্থি বা উগ্র রাজনৈতিক ডান/বাম দলগুলো সাধারণত সফল হতে পারে না, কারণ এই পদ্ধতিতে জয়লাভের জন্য কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যাপক জনসমর্থন প্রয়োজন হয়। দেশজুড়ে ছড়ানো সামান্য সমর্থন দিয়ে আসন পাওয়া সম্ভব না হওয়ায় এই পদ্ধতি রাজনৈতিক চরমপন্থা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। (ঞ) যেহেতু ভোটাররা একজন নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেন, তাই প্রার্থী তার এলাকার জনগণের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকেন। জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বাদ দিতে পারেন।
আসন ব্যবস্থার বিপরীতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে সিভিল সোসাইটি বেশ সরব মনে হচ্ছে। বাম ধারার একজন শীর্ষ বুদ্ধিজীবী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক অতিসম্প্রতি (নভেম্বর, ২০২৪) ‘আনুপাতিক নির্বাচন কী এবং কেন’ নামে একটি গবেষণা প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। এই পরিসরে নাতিদীর্ঘ বইটির বিষদ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের আনুপাতিক নির্বাচনের বিভিন্ন সম্ভাব্য সুফল সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা এরকম—১. এতে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলকতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ২. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান ও সহনশীলতার তাগিদ বৃদ্ধি পাবে। ৩. নির্বাচনে কারচুপির সুযোগ এবং প্রণোদনা হ্রাস পাবে। ৪. সংসদ সদস্যদের গুণমান বৃদ্ধি পাবে। ৫. নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মান বৃদ্ধি পাবে। ৬. প্রাক-নির্বাচনী জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে। ৭. রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। ৮. স্থানীয় সরকারের বিকাশের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। ৯. সংসদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ক্ষুদ্র দল ও জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের অবসান হবে। ১০. উপ-নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার অবসান হবে। ১১. বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। এসব প্রস্তাবনার পর বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের আনুপাতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন, তাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের জনগণ আনুপাতিক নির্বাচনের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয়। তা ছাড়া অপেক্ষাকৃত জটিল আনুপাতিক নির্বাচনের জন্য সর্বসাধারণের যে ধরনের উন্নত মানের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে এখনো অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশে বিষয়টিকে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। অবশেষে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘ভৌগোলিক ক্ষুদ্রতা, জনবসতির ঘনবদ্ধতা, জনমিতির আপেক্ষিক সমধর্মিতা, সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে আনুপাতিক ব্যবস্থা প্রয়োগের জন্য পরিস্থিতি খুবই অনুকূল।
বর্তমান বাংলাদেশে সর্বত্র যখন সংস্কারের ঢেউ, তখন নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়েও বড় ধরনের বাদ-বিতর্ক চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। গঠিত নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ পেশ করেছে। পদ্ধতিগতভাবে বর্তমান ব্যবস্থার বিপরীতে সমানুপাতিক ব্যবস্থা বা অন্যতর কিছুর সুপারিশ করা হয়নি। সম্ভবত কমিশন বর্তমান ব্যবস্থাকেই উত্তম বিবেচনা করছে। তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই বেশকিছু রাজনৈতিক দল সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কথা বলে আসছে। ওই সময়ে ঢাক-ঢাক গুরু-গুরু করে সমানুপাতিক ব্যবস্থার পক্ষে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশিত হলেও এখন এই সময়ে ব্যবস্থাটির পক্ষে বড় বড় রাজনৈতিক দলের কঠিন অবস্থানের জানান দেওয়া হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ডান ও বামের সব পক্ষ থেকে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। এমনিতেই অনেক আগে থেকে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো সমানুপাতিক ব্যবস্থার পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আমার যতটা মনে পরে, বাম ধারার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, হায়দার আকবর খান রনো ও অমল সেনের গ্রন্থনা রয়েছে। ডান ধারার নাজিম কামরান চৌধুরী, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও জামায়াত নেতা কামরুজ্জামানের বিষয়টির ওপর একই ধরনের লেখালেখি রয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে ডান ও বামের বিভেদের মাঝে ঐক্য রয়েছে। ব্যবস্থাটির বিপক্ষে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে অনেক আগে থেকেই। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ জনগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত, সেহেতু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করে ১ জুলাই বিএনপি আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কি না, তা সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব।
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন তথা চরমোনাই এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দল সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে শক্ত অবস্থান ঘোষণা করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতী সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম, পীর সাহেব চরমোনাই স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করার কোনো বিকল্প নেই। তিনি গত ২৮ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পিআর পদ্ধতির পক্ষে গণপ্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’
জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পারোয়ার দাবি করেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চেয়ে তারা দেশের গরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন।’
আমরা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় তথা আসন বা আঞ্চলিক পদ্ধতির সপক্ষের বক্তব্য শুনলাম। এর বিপরীত ব্যবস্থা হিসেবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সপক্ষে একজন বিদ্বজ্জনের বিবরণী দেখলাম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দ্বৈত অবস্থা বা বিতর্ক সম্পর্কেও অবহিত হলাম। সবকিছু দেখেশুনে আমাদের মনে হয়েছে, অন্যান্য জটিল বিষয়ের মতো নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে উত্থিত বিতর্কটিও অনতিক্রম্য নয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিপরীতে অবস্থানরত রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও আলোচনার টেবিলে ডাকলে তাদের আরো নমনীয় ও সমঝোতাকামী হিসেবে দেখবেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের বিশ্বাস। জাতীয় স্বার্থে কোনো পক্ষেরই ইগো বা জেদ ধরার কারণ নেই। বিশেষ করে বিএনপি যেহেতু যেকোনো বিবেচনায় ভবিষ্যতের সরকার (Government in Waiting), সেহেতু তাদের আরো দায়-দায়িত্বের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। নির্বাচন যখন সন্নিকটে তখন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বিভেদ ও বিতর্ক নাগরিক সমাজকে বিচলিত করছে। সিভিল সোসাইটি তথা বিদ্বজ্জনদের পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত মধ্যস্থতা প্রস্তাবনা উভয় পক্ষ গ্রহণ করলে সম্ভবত জাতি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক ও অগ্রহণযোগ্য অবস্থান থেকে উৎরাতে পারবে—(ক) নির্বাচন পদ্ধতি বিতর্কে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে অনেক ভালো ভালো কথা উচ্চারিত হয়েছে, এটা সত্য। তবে বাস্তব অবস্থা, দেশজ পরিস্থিতি, নির্বাচনের সময়সীমা ও আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে গণ-অজ্ঞতা প্রভৃতি বিষয়ে বিবেচনা করে এবারের মতো এই নির্বাচনে সমানুপাতিক ব্যবস্থার প্রায়োগিক বাস্তবতা অনুপস্থিত। (খ) প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের নির্বাচনে সমানুপাতিক পদ্ধতির বিষয়ে ইতোমধ্যে কেউ কেউ রাজি হয়েছে। এ বছরের জন্য উচ্চকক্ষের ১০০টি আসনে সব রাজনৈতিক দল সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিন। (গ) যেহেতু সমানুপাতিক ব্যবস্থাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিষয়টির জনগুরুত্ব বিবেচনা করে নীতিগতভাবে সব রাজনৈতিক দল আগামীতে এটি গ্রহণ করার ব্যাপারে ঐকমত্য ঘোষণা করতে পারে। এটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঘোষণায় অথবা সনদ আকারে জনসমক্ষে প্রকাশিত হতে পারে।
বাংলাদেশ সমাজের গতি-প্রকৃতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখেই যেকোনো সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বেরও নানা আকার-প্রকার রয়েছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উচিত হবে বিষয়টিকে যথাযথ আমলে নেওয়া এবং সম্ভাব্য সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা। বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনে তারা একটি কমিশনও গঠন করতে পারে। মনে রাখতে হবে, পতিত স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীর কারণে আমরা একটি সংকট সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছি। সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য তথা জাতীয় ঐকমত্যই সব প্রশ্নের অনিবার্য উত্তর।


বিশ্ববিদ্যালয় ও মেধার মাশরুম-ফলন